এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষা প্রশাসন এখনও আওয়ামীকরণ

নিজস্ব প্রতিবেদক।। শিক্ষা প্রশাসনে পদায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের দাপট এখনো কমেনি। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের ক্রমাগত চাপের মুখে আওয়ামী ভিসি এবং অধ্যক্ষ পরিবর্তন হলেও দফতর সংস্থার অফিসগলোতে এখনো রাজত্ব করছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীরা। মন্ত্রণালয়ের একটি সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় প্রজেক্টগুলোতেও নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখছে। সুবিধাভোগী এসব কর্মকর্তার পুনর্বহাল এবং গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের পর সমালোচনার মুখে গত সাড়ে ৫ মাসে অন্তত শতাধিক কর্মকর্তার পদায়ন বাতিল করা হয়েছে। এসব বদলি পদায়নে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগও উঠছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৮ জানুয়ারি যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ পদায়ন পান অধ্যাপক খোন্দকার কামাল হাসান। তিনি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোনের বগুড়ায় সরকারি আজিজুল হক কলেজের ছাত্রদের ওপর ককটেল মারে ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে অবস্থান নেন। সেই কর্মকর্তাকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে পদায়নের পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপর ১০ দিনের মাথায় ২০ জানুয়ারি তাকে ওএসডি করা হয়।

গত ২৬ জানুয়ারি বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় মোজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফাতেমা হেরেনকে। শেখ হাসিনার পতনের পর বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের উপধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন বাগিয়ে নেন এই কর্মকর্তা। এরপর ৬ অক্টোবর সেখানে যোগদান করতে গেলে তাকে বাধা দেয় শিক্ষার্থীরা।

তাদের অভিযোগ, অধ্যাপক ফাতেমা হেরেন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থী বরিশালের সাবেক মেয়র ও এমপিদের সাথে প্রকাশ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। একই সাথে তিনি ছাত্রদের আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর বিরোধিতা করে বিভিন্ন পোস্ট করেছেন।

বনমালী গাঙ্গুলিতে সুপার থাকাকালীন তার স্বেচ্ছাচারিতা চরম আকার ধারণ করেছিল। এ কারণে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন সেখান থেকে।

তাকে পুনরায় বিএম কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মানছে না। শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পরে এই কর্মকর্তাকে মাউশিতে সংযুক্ত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এবার তিনি বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের সচিব হিসেবে পদায়ন বাগিয়ে নিয়েছেন।

১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে পদায়ন পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ভাগ্নি জামাই ড. ছরওয়ার আলম। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সময় তিনি মাদরাসা অধিদফতরের প্রশাসন শাখার পরিচালক ছিলেন।

ওই সময় শেখ হাসিনা পরিবারের লোক ও গোপালগঞ্জ বাড়ি পরিচয় দিয়ে সব জায়গা প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কথায় কথায় রাষ্ট্রপতির ও আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতা দেখাতেন।

গত ১৬ আগস্ট শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয়ার পরও মাউশিতে কিছু আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা পদায়ণ পান। তারা বিগত সরকারের বৈষম্যের শিকার দাবি করে শিক্ষা উপদেষ্টার দফতরে গিয়ে টেবিল থাপড়িয়ে পদায়ন নেন। এর মধ্যে রয়েছেন মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক প্রিম রিজভী ও সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর।

প্রিম রিজভী বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যানবেইসের উপপরিচালকসহ বিভিন্ন প্রকল্পে চাকরি করেছেন। এক দিনের জন্য তিনি ঢাকার বাইরে যাননি। এনসিটিবির সাবেক সচিব ও সর্বশেষ কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নিজামুল করিমকে গত ১৫ দিনে একবার প্রত্যাহার করে সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সর্বশেষ তিন দিন আগে তাকে আবার প্রত্যাহার করা হয়েছে।

গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান সরকারি তিতুমীর কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক নাছিমা আক্তার চৌধুরী। অবসরে যাওয়ার তিন দিন আগে তাকে এই পদে পদায়ন করা হয়। একজন সমন্বয়কের চাপে তাকে পদায়ন করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমন অভিযোগ রয়েছে। যদিও ইতোমধ্যে তিনি অবসরে চলে গেছেন। তার আদেশ প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন করে উপাধ্যক্ষের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন।

জুলাই বিপ্লবের পর শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। এই রদবদল করতে গিয়ে নানামুখী চাপে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সাড়ে পাঁচ মাসে অন্তত শতাধিক পদায়ন স্থগিত করা হয়। এ ছাড়াও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ পর্যন্ত পদায়ন হয়নি বেশ কিছু কর্মকর্তার।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান ড. শেখ আব্দুর রশীদ। এ সময় মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন শুরু হলে তাকে মন্ত্রপরিষদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় ৫ম ব্যাচের কর্মকর্তা সিদ্দিক জোবায়েরকে। মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বদলি-পদায়ন মূলত সচিবের অধিক্ষেত্র।

এই কর্মকর্তার পিডিএস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চাকরিতে থেকে অবসরে যান। এর আগে ২০১৪ সালের ৯ মার্চ পতিত শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাত ধরে যুগ্মসচিব হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগে পদায়ন পান। এই মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে ২০১৭ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। অতিরিক্ত সচিব পদোন্নতি নিয়ে একই মন্ত্রণালয়ে ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদে থেকে অবৈধ উপায়ে জ্ঞাতবহির্ভূত ৩৬ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন ও ৯৮টি ব্যাংক হিসাবে মোট ছয় হাজার কোটি টাকা অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেন করায় তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে দুদক।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নুরুল ইসলাম নাহিদ, ডা: দীপুমনি ও মাহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের যে চক্র শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন অফিস এবং উল্লেখযোগ্য কলেজগুলো নিয়ন্ত্রণ করত তাদের এক বড় অংশ এখনো প্রভাব বিস্তার করে আছে। শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নায়েমে বিপ্লব-পরবর্তীকালে তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি। অথচ এই প্রতিষ্ঠানটি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে নায়েমে প্রতিবেশী দেশের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ট্রেনিং ম্যানুয়াল এবং সূচি প্রণয়ন করা হতো। মাত্র একজন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা সৈয়দ আহসান হাবিব ছাড়া আরা কাউকে বদলি করা হয়নি। অথচ পরিচালক, উপপরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক এবং প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ পূর্বের দীপুমনি-নওফেল গংয়ের কর্মকর্তারাই রয়ে গেছেন।

অথচ একেকজন গত ৮-১০ বছর থেকে ১৩-১৪ বছর পর্যন্ত নায়েমে কর্মরত আছেন। এমনকি সরাসরি ইসকনের সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাও রয়ে গেছেন যিনি নওফেলের বিশেষ পছন্দের ছিলেন। গত জানুয়ারি ’২৪ থেকে জুন ’২৪ পর্যন্ত যাদের পদায়ন করা হয়েছে তাদের বড় অংশই নওফেল ও শামিম ওসমানের লোক বলে খ্যাত। এটি তারা সে সময় গোপন করতেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি, যেখান থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যবই মুদ্রণ ও বিতরণ করা হয়। এনসিটিবির শীর্ষ পদে পরিবর্তন এলেও মধ্য পর্যায়ের পদগুলো যারা মূলত কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি জড়িত তাদের সরানো হয়নি।

বিশেষ করে ২০২২ এর কুখ্যাত কারিকুলাম প্রস্তুতের সাথে জড়িতদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো স্বপদে বহাল আছেন। সরকার নতুন কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ২০২২ কারিকুলামের সাথে জড়িতরা তারা যদি স্বপদে বহাল থাকে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে গেলে সরকার আগের মতোই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

মাউশির উপপরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অফিস হলো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। মাউশির ঢাকা অফিসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলেও আঞ্চলিক অফিসগুলোতে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেমন মাউশির ডিজির দায়িত্ব পালন করে পিআরএলে গেছেন নওফেলের আস্থাভাজন প্রফেসর রেজাউল করিম।

ভারপ্রাপ্ত ডিজি আছেন প্রফেসর শফিউল আজম যিনি দিপুমনির ধামাধরা হিসেবে পরিচিত। ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক প্রফেসর মনোয়ার হোসেনকে গত সপ্তাহে বদলি করা হলেও তিনি প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগার হওয়া সত্ত্বেও দাপটের সাথে ক্ষমতা চর্চা করে যাচ্ছিলেন। অনুরূপভাবে রাজশাহীর আঞ্চলিক উপপরিচালক হিসেবে আছেন ড. আলমগীর কবির। নওফেল মন্ত্রী থাকাবস্থায় যাকে অধ্যাপক না হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক পদে পদায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তাকে রাজশাহীর উপপরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এ ধরনের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি করছে।

এসব বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.