নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ শিক্ষাবার্তায় সংবাদ প্রকাশের পর ‘নির্ধারিত রেটে ঘুস’ নেওয়া হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ রুহুল্লাহকে চাঁদপুর জেলা শিক্ষা অফিসার পদে বদলি করা হয়েছে। মাউশির সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) জিয়াউল হায়দার হেনরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে তাকে চাঁদপুরে বদলি করা হয়।
এর আগে গত ২৪ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে “এখনও স্বপদে বহাল ‘নির্ধারিত রেটে ঘুস’ নেওয়া হবিগঞ্জের ডিইও রুহুল্লাহ” শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হয়। শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশের আগে মোহাম্মদ রুহুল্লাহকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একটি সিন্ডিকেট মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ডিডি পদে অথবা মাউশির অন্য আট অঞ্চলের ডিডি পদে পদায়নের তৎপরতা চালায়। পরবর্তীতে মোহাম্মদ রুহুল্লাহ’র ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশের পর ঐ সিন্ডিকেট তাকে আর ডিডি পদে পদায়ন করাতে পারেননি। তবে সেই একই সিন্ডিকেট জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন থেকে রেট বেঁধে ঘুষ নিয়ে আলোচনায় আসা এই কর্মকর্তাকে পুনরায় অন্য একটি জেলায় শিক্ষা অফিসার পদে বদলি করেছে। অথচ একাধিক সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তি নাম সর্বস্ব বিভিন্ন সরকারি হাইস্কুলে বছরের পর বছর প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন থাকলেও এবং আওয়ামী আমলে বঞ্চিত থেকেও তারা জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন পাননি।
আরও পড়ুনঃ
- দীপু মনি সিন্ডিকেটের ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মজিদ এখনও বহাল তবিয়তে
- ঢাকাতেই কর্মজীবন আয়নাঘরের হোতার আপন বোন ‘ঘুসখোর’ মাউশির নাজমুন নাহার
- মাউশিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী নাহিদ সুলতানা ও মেজবাহের দাপট
- এমপিওভুক্তিতে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের ডিডি খালেক নিয়েছেন ১০ কোটি টাকা!
শিক্ষাবার্তা’য় ঐ প্রতিবেদনে জানা গেছে, মোহাম্মদ রুহুল্লাহ ১৯৯১ সালে সহকারী শিক্ষক (ইসলাম ধর্ম) পদে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যোগদানের এক বছর পরেই মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পদায়ন বাগিয়ে নিয়ে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। এরপর ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডির গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ২০১০ সাল পর্যন্ত পদায়ন ছিলেন। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কর্মরত থেকে চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদায়ন বাগিয়ে নিয়ে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এবং ২০১৮ সালে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নিয়ে হবিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদায়ন নেন এবং ২০২২ সালে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি নিয়ে একই জেলায় কর্মরত রয়েছেন। মোহাম্মদ রুহুল্লাহর কর্মজীবনের ৩৩ বছরের মধ্যে প্রথম ২৫ বছর রাজধানী ঢাকায় এবং ৮ বছর ধরে হবিগঞ্জ জেলা সদরে রয়েছেন।
হবিগঞ্জের জেলা শিক্ষা অফিসে যোগদান করার পর থেকেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। নামে বেনামে রয়েছে তার কোটি কোটি টাকার সম্পদ। দুদক অনুসন্ধান করলেই তার সত্যতা পাওয়া যাবে। এমপিওভুক্তির আবেদনের ফাইল, টাইমস্কেল, ডিজি প্রতিনিধি মনোনয়ন থেকে শুরু করে সব কিছুইতেই ‘ঘুসের রেট’ নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তিনি। হবিগঞ্জ জেলার বেসরকারি মাধ্যমিকের প্রায় ৮০ জন প্রধান শিক্ষক তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে ২০২০ সালে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি সে অভিযোগ আমলে না নিলেও হবিগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক তা আমলে নিয়ে তদন্ত করেন। তদন্তে এমপিওভুক্তিতে ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি প্রমাণিত হয় এবং জেলা প্রশাসক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করে। তবে সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ করা হলেও তা না করে ২০২২ সালে তাকে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি প্রদান করা হয়। এতে জেলার শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
হবিগঞ্জের অন্তত পাঁচ জন প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা অভিযোগ দিলেও মন্ত্রণালয় কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি ডিসির তদন্তে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে পদন্নোতি দিয়েছেন। তারা জানান, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি আরও বেপড়োয়া হয়ে উঠেছেন। হবিগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসে এখন কোন নিয়ম নেই, অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি ফাইল নাড়াচাড়া করতেই টাকা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিয়েও কাজ হয় না। তার থেকে পরিত্রাণ চান জেলার সকল শিক্ষক-কর্মচারীরা।
ঘুস বাণিজ্য তদন্তে প্রমাণের পরেও সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ রুহুল্লাহ
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের তদারকি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কর্ণার স্থাপণ করে এবং কয়েকটি জাতীয় গণমাধ্যমে জেলা শিক্ষা অফিসের ছাদে করা ছাদ বাগানের সংবাদ পরিবেশন করে ২০২৩ সালে সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসারের পুরষ্কার বাগিয়ে নেন মোহাম্মদ রুহুল্লাহ। অথচ তার বিরুদ্ধে ২০২০ সালের অক্টোবরে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের তদন্তে ঘুস বাণিজ্যে প্রমাণিত হওয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলেও তা আমলে না নিয়ে বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা শিক্ষা অফিসারের খেতাব দেওয়া হয় তাকে। জেলার প্রায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দিলেও সেগুলোর কোন কর্ণপাত করা হয়নি। ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান’কে নিয়ে লিখে শেখ হাসিনার দৃষ্টি গোচর হয়েছিলেন তিনি।
একাডেমিক জীবনে সকল ডিগ্রিতে ২য় শ্রেণি পাওয়া মোহাম্মদ রুহুল্লাহ ক্ষমতার উৎস কোথায়?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হবিগঞ্জের ত্রাস সদর আসনের আওয়ামী লীগের (২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত) সাবেক সাংসদ আবু জাহিরের সঙ্গে ঘনিষ্টতায় তিনি ২০১৬ সালে হবিগঞ্জে পদায়ন বাগিয়ে নেন এরপর সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে এবং জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি নিয়ে হবিগঞ্জেই কর্মরত আছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৬ সালে চলতি দায়িত্বের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে, ২০১৮ সালে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি এবং ২০২২ সালে জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদন্নোতি বাগিয়ে নিতে এমপি জাহিরের সুপারিশ নেন তিনি। একই সময়ে যোগ্য ব্যক্তিরা পদন্নোতি বঞ্চিত হলেও তিনি পদন্নোতি বাগিয়ে নেন পতিত সরকারের সুপারিশে। তার বিরুদ্ধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অর্ধশত অভিযোগ জমা থাকলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। মাউশির মাধ্যমিক শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আজিজ উদ্দিন এবং একই শাখার সহকারী পরিচালক দূর্গা রানী সিকদার মোহাম্মদ রুহুল্লাহ বিরুদ্ধে যত অভিযোগই উঠুক না কেন সেই ফাইল আর কর্ম তালিকায় উঠাননি। এছাড়াও মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক কর্মকর্তা রুহুল্লাহর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় মন্ত্রণালয়ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিকের যুগ্মসচিব কাজি মোঃ আবদুর রহমান, উপসচিব মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু আলম রুহুল্লাহকে ঢাকার ডিডি পদে পদায়নের জন্য সরাসরি কাজ করছেন। এই সিন্ডিকেটে শিক্ষা ভবন সহ ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের জন্য তালিকায় রয়েছেন ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল মজিদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ ইউনুছ ফারুকী এবং তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহরীন খান রুপা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নিকট প্রায়ই দৌড়ঝাঁপ করছেন রুহুল্লাহ। উদ্দেশ্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কোন পদ। আওয়ামী লীগের আমলের সুবিধাভোগী মোহাম্মদ রুহুল্লাহ নিজেকে আওয়ামী লীগের আমলের বঞ্চিত কর্মকর্তা সাজিয়ে পদন্নোতি নিতে নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে ঘুরছেন। তাকে পদায়নের জন্য মন্ত্রনালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও কাজ করছেন বলে সূত্র মারফত নিশ্চিত হওয়া গেছে।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৫/১২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.