ঢাকাঃ প্রবীণ শিক্ষক আবদুর রউফ। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তিনি যশোর সদরের ‘ছাতিয়ানতলা চুড়ামনকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ থেকে অবসরে যান। প্রায় ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের পাওনাদির জন্য ওই মাসেই আবেদন করেন। দীর্ঘ চার বছর যশোর থেকে ঢাকা ঘুরলেও টাকা পাননি তিনি। আবদুর রউফের মতো সারাদেশে ৭২ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী তিন মাস ধরে অবসর ও কল্যাণ ভাতার টাকা পাচ্ছেন না। জীবন সায়াহ্নে এসে চরম দৈন্যদশায় পড়েছেন তারা।
সারাদেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের মতো। তাদের কল্যাণ ও অবসর ভাতা হয় যথাক্রমে– বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে। কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যালয় রাজধানীর পলাশীর বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতার আবেদন করেছেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা আবেদনের নিরীক্ষা (অডিট) নিষ্পত্তি হয়। এর পর ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত আবেদনের বিপরীতে অবসর সুবিধার অর্থ দেওয়া হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় আটকে আছে অন্যদের অর্থ। অন্যদিকে, কল্যাণ ভাতার জন্য এ পর্যন্ত আবেদন পড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পড়েছে ১০ হাজার ২৪২টি। নিয়ম অনুযায়ী, অবসরের পরপরই অবসর ও কল্যাণ ভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে চার বছর পর্যন্ত লেগে যায় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড পরিচালিত হয় দুটি কমিটির মাধ্যমে। পদাধিকারবলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব এই কমিটির চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক। কমিটির সচিব ও অন্যান্য সদস্য হন বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক নেতারা কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেশির ভাগ শিক্ষক নেতা পলাতক। এতে থমকে গেছে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে সরিয়ে শিক্ষক নেতারা ব্যক্তিগত লাভের আশায় বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংকে রাখেন। ফার্স্ট সিকিউরিটির মালিকানা এস আলম গ্রুপের; সিটিজেনস ব্যাংক সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের।
কর্মকর্তারা জানান, লুটপাটের কারণে দুটি ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। বেশির ভাগ গ্রাহক তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন। ব্যাংক দুটি চাহিদামতো অর্থ দিতে না পারায় শিক্ষক-কর্মচারীর টাকা পরিশোধ করতে পারছে না কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ব্যাংক দুটির পরিবর্তে সরকারি ব্যাংকে তহবিল রেখে লেনদেনের নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের পূর্ণাঙ্গ কমিটি সভা করতে না পারায় আটকে গেছে তহবিল স্থানান্তরের নির্দেশনা। এ কারণে গত তিন মাস শিক্ষক-কর্মচারীরা টাকা পাচ্ছেন না।
জানা যায়, অবসর ও কল্যাণ সুবিধার অর্থের বড় অংশ নেওয়া হয় শিক্ষক-কর্মচারীর কাছ থেকে। চাকরিকালে প্রতি মাসে তাদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা কেটে রাখে অবসর সুবিধার জন্য। এ খাত থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আসে। আর কল্যাণ সুবিধার জন্য কাটা হয় মূল বেতনের ৪ শতাংশ। এর সঙ্গে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসর ও ৩০ টাকা কল্যাণ) যুক্ত হয়। দুটি সুবিধার অর্থ পরিশোধে বাকি টাকা সরকার ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করার কথা। কিন্তু নিয়মিতভাবে সরকার কোনো বরাদ্দ দেয়নি। মাঝেমধ্যে সহায়তা হিসেবে থোক বরাদ্দ দিয়েছে। ফলে ট্রাস্ট ও বোর্ডের তহবিল শক্ত ভিত্তি পায়নি।
কেটে রাখা ৭০ কোটি টাকার সঙ্গে প্রতি মাসে এফডিআরের লভ্যাংশ যুক্ত হয় প্রায় তিন কোটি টাকা। বিপরীতে প্রতি মাসে গড়ে অবসর সুবিধাভোগীর আবেদন পড়ে এক হাজার, যা নিষ্পত্তিতে দরকার প্রায় ১১৫ কোটি টাকা। প্রতি মাসে ৪২ কোটি টাকার মতো ঘাটতি থাকে। বর্তমানে ৩৭ হাজার অবসর সুবিধার আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। একই চিত্র কল্যাণ ট্রাস্টেও।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিক্ষক-কর্মচারীর ভোগান্তির কথা চিন্তা করে গত ২৭ আগস্ট কল্যাণ ট্রাস্টের উপপরিচালক আবুল বাশারকে প্রতিষ্ঠানের সচিবের (রুটিন দায়িত্ব) আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর গত সপ্তাহে অবসর সুবিধা বোর্ডের সদস্য সচিবের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয় বোর্ডের পরিচালক অধ্যাপক জাফর আহম্মদকে। কিন্তু ব্যাংক লেনদেন-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তারা কিছুই করতে পারছেন না। দীর্ঘ হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীর হাহাকার।
অধ্যাপক জাফর আহম্মদ বলেন, ব্যাংক দুটির সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে শিগগির মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বৈঠক হবে। সেখানে সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে, আশা করছি। অন্যদিকে আবুল বাশার বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকে পিএল (পার্সোনাল লেজার) হিসাব খুলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আইবাস প্লাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণের টাকা দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। শিগগির সংকট কেটে যাবে। সূত্রঃ সমকাল
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২৬/১১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
