ঢাকাঃ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদধারীরা পদত্যাগ শুরু করেন। কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। কেউ পদত্যাগ করেন শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে। ফলে তখন থেকেই শীর্ষ এই পদগুলো শূন্য। তবে শীর্ষপদ শূন্য থাকায় বেতন ভাতা নিয়ে যে শঙ্কা ছিল, তা সমাধানে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দায়িত্ব পালনে নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষামন্ত্রণালয়। জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক কীভাবে নির্ধারণ হবে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ—গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি পদ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক সমস্যায় পড়তে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। শুধু শীর্ষ পদ নয়, এই পদের বাইরে প্রক্টর ও কোথাও কোথাও বিভিন্ন বিভাগের পরিচালকরা পদত্যাগ করেছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব ধরনের কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কোথাও কোথাও ঠিকমতো পাঠদানও হচ্ছিল না। নেই কোনো শৃঙ্খলাও।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তাদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বেতন-ভাতা নিয়ে। মাস শেষ হলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দায়িত্বশীল কেউ না থাকায় বেতন-ভাতা পাওয়া নিয়েও শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
তবে আপত্কালীন সমস্যা সমাধানে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দায়িত্ব পালন করতে বলেছে। গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, পদত্যাগ ও অনুপস্থিতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন কাউন্সিল, ক্ষেত্রবিশেষে বিভাগীয় চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা করে একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে দিয়ে সাময়িকভাবে জরুরি প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
গত সপ্তাহে দেশের ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। একই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। এর পরের দিন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) ডিনদের থেকে মনোনীত এক জনকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ ভুক্ত শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। এ তালিকা ধরেই শীর্ষ পদগুলো পূরণ করা হবে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার বুঝেশুনে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করেই শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ দিতে চায়। এ কারণে সময় নিচ্ছে।
সম্প্রতি শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘৪০টিরও বেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যত দ্রুত সম্ভব পরিবর্তন আনতে হবে। এটিকে সুযোগও মনে করি। আমরা চাই, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক। তাদের শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকতে হবে। এত দিন এ জায়গায় আমাদের অবমূল্যায়ন হয়েছে।’
তবে উপাচার্য পদ শূন্য থাকায় এরই মধ্যে শিক্ষকরা বিভিন্ন মাধ্যমে তদ্বিরও করছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে নিজের বায়োডাটা পাঠাচ্ছেন।
শিক্ষকরা বলছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত পৃথক শিক্ষক সংগঠন রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষকরা এবার নৈতিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষপদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে।
কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত করার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের ১৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছিল। এই বিবৃতির পালটা বিবৃতি দিয়েছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সংগঠনের শিক্ষকরা। সেখানে তারা স্বাক্ষরও করেছিল।
সাধারণ শিক্ষকরা মনে করছেন, নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত শিক্ষক যারা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, তারা এখন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে প্রার্থী হচ্ছেন না নৈতিক কারণেই। নিজ থেকেই তারা সরে গেছেন। ফলে সাধারণ ও অন্যান্য দল-সমর্থিত শিক্ষকদের উপাচার্য, উপউপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ হওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী-সমর্থিত শিক্ষকদের মধ্যে মানসিক টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। তবে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ দেখা যায়নি।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, সততা যোগ্যতা দেখেই শীর্ষ পদগুলো পূরণ করা হবে। এভাবে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হলে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা দুটোই ভালোভাবে চলবে।’
বর্তমানে দেশে ৫৫টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ২৭ জন উপাচার্য, ১২ জন উপ-উপাচার্য এবং সাত জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানায়, দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৫টি। এর মধ্যে বর্তমানে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৩/০৯/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.