ফকির ইলিয়াসঃ বাঙালি জাতিকে শিক্ষায় আলোকিত করা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রধান লক্ষ্য। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পের উন্নয়ন শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া সম্ভব নয়। জাতির পিতা তার শিক্ষা ভাবনা ও দর্শন ১৯৭০ সালের নির্বাচনি প্রচারে একাধিকবার- অন্তত ১৩২টি শিক্ষা সংক্রান্ত ভাবধারা উপস্থাপন করেন। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল- অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, প্রয়োজনে শিক্ষালয়গুলোতে দু’শিফটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
স্কুল সংলগ্ন ল্যাবেরেটরি এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ওয়ার্কশপে বয়সভেদে বিভিন্ন ব্যক্তির নানামুখী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মেধা যোগ্যতার ভিত্তিতে মনোনীত শিক্ষার্থীরাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরি করবে। বয়স্ক শিক্ষা প্রসারে রেডিও, টেলিভিশন, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষার্থীদের কাজে লাগাতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহপাঠক্রমিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে প্রসার করে শিক্ষালয়ের অভ্যন্তরে ও বাহিরে খেলাধুলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। মেয়েদের শিক্ষাপ্রসারে গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির উন্নতি করা সম্ভব নয়। তার ভাষায়- ‘শিক্ষা হচ্ছে বড়ো অস্ত্র যা যেকোনো দেশকে বদলে দিতে পারে।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলতেন- ‘জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের মতো প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন দেশ শুধু মানবসম্পদ সৃষ্টি করে যদি উন্নত দেশ হতে পারে, তাহলে বাংলাদেশও একদিন উন্নত দেশ হবে।’ আর সে জন্যই তিনি নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সেসব উদ্যোগের কিছু ছিল তাৎক্ষণিক আর কিছু ছিল দীর্ঘমেয়াদি।
জাতির পিতা অনেককিছুই করে যেতে পারেননি। সেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন শেখ হাসিনার হাতে। কেমন চলছে আজকের বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন। অভিযোগ অনেক আছে। তারপরেও দেশ এগোচ্ছে শিক্ষার আলো নিয়ে। বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি বিব্রত করেছে বারবার। এর মাঝে আরেকটি উপদ্রব প্রশ্ন তুলেছে এই অঙ্গনে। শিক্ষাসনদ নিয়ে আবারও কথা উঠেছে বাংলাদেশে। থিসিস নকল (মতান্তরে চুরি) করে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করার অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। এই কাজ অনেকে করেন বলে শোনা যায়। এখানে একটি বিষয় মোটা দাগে দেখা দরকার। সনদ বিক্রি করে চাকুরি পাওয়া যায়। কিন্তু জ্ঞান অর্জন কি থেমে যায় কোনো বয়সে?
আমরা একটি কথা প্রায়ই শুনি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক ভূমিকা রাখছে। সতেরো কোটির বেশি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। এই দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ ও স্কুলগুলো সব ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাব্যবস্থার সংকুলান করতে পারবে, এমন প্রত্যাশা করার কোনো কারণ নেই। বিশ্বের অন্যসব দেশেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ই অধিকসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা নিশ্চিত করে থাকে। সরকার কর্তৃক পরিচালিত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক দেশে ছাত্রছাত্রী যেতেই চায় না। ফলে সরকারনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের বেশি সুবিধা যেমন ফাইনান্সিয়াল এইড, স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। যাতে তারা সহজে ছাত্রছাত্রী জোগাড় করতে পারে।
একটি বিষয় আমাকে খুব বেশি ভাবায়। আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন থেকেই বিষয়টি আমাকে বেশ পীড়া দিতো। কলেজের প্রতিটি ক্লাসেই সে সময় রোলকল হতো। এখনো কি হয়? বর্তমানের অবস্থা আমার জানা নেই। পাঠক, ক্ষমা করবেন। কলেজের প্রতিটি ক্লাসের স্থায়িত্ব হয় ৪০-৪৫ মিনিট। এর মধ্যে ১২-১৫ মিনিট চলে যায় রোলকল করতে করতে। এই সময়টি কোনো সৃজনশীল কাজেই লাগে না। শুধু হাজিরা রক্ষার মহড়া পালিত হয়। যদি প্রতিদিন ছয়টি ক্লাস থাকে তবে দেখা যাচ্ছে গড়ে প্রতিদিন দেড় ঘণ্টা (১৫ মিনিট হিসেবে ছয় ক্লাসে) শুধু হাজিরা খাতেই ব্যয় হচ্ছে। এই সময় কিন্তু শিক্ষার কাজে ব্যয় করা যেত। বর্তমানের অবস্থা আমার জানা নেই।
প্রতিটি ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার এমন রেওয়াজ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নেই। একজন ছাত্রকে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয় নিজ নিয়মানুবর্তিতা থেকেই। উপস্থিত না থাকলে ক্ষতিটা নিজেরই হচ্ছে। এই যে মানসিক পরিবর্তন, তা হওয়া উচিত প্রতিটি সৃজনশীল ছাত্রছাত্রীর। সমতা রক্ষা করা উচিত গোটা বিশ্বের সঙ্গে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই এখন কম্পিউটারাইজড অ্যাটেনডেন্স কার্ড পাঞ্চিং সিস্টেম চালু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসে ঢোকার সময় ওই কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হয়। এতে সময় সাশ্রয় হয় অনেক বেশি। বাংলাদেশের বর্তমান আধুনিক স্কুল-কলেজগুলো কি এসব ব্যবস্থার কথা ভাবছে? মনে রাখতে হবে, পরিবর্তনের কথা শুধু মুখে বললেই হবে না। ডিজিটাল পরিবর্তন বলুন আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের কথাই বলুন, ব্যাবহারিক জীবনে এর ব্যাপক প্রয়োগ ঘটাতে হবে, চালু করতে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানাভাবে এগোনোর চেষ্টা করছে। শিক্ষা এর একটি অন্যতম বিষয়। পাশ্চাত্যের সব দেশেই যে উচ্চশিক্ষিতের হার খুব বাড়ছে, তা ঠিক নয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রতন্ত্রের একটি অন্যতম নীতি হচ্ছে, রাষ্ট্রের সব মানুষই যেন উচ্চশিক্ষিত না হয়। যদি তা-ই হয়, তবে ম্যাকডোনাল্ড, বার্গার কিং, পিজা হাটয়ের মতো ফাস্টফুডের দোকানে কে কাজ করবে? অথবা ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোর বড়ো বড়ো দফতরে নৈশপ্রহরীর কাজগুলো কে করবে?
না, আমি কোনো পেশার প্রতি কটাক্ষ করে এমনটি বলছি না। বলছি বৈষম্যের সিঁড়ি বজায় রাখার সনাতনী প্রথার কথা। করপোরেট বাণিজ্যবাদীরা সব সময়ই চায় একটি শ্রেণি কুলি-মজুরের কাজের জন্য তাদের গুদামঘরগুলোর ধরনা অব্যাহত রাখুক। এটা বিশ্বের সেরা ধনী দেশগুলোর মনন থেকে এখনো সরে যায়নি। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আরও বিচিত্র। এখানে রাজনীতিবিদদের অনেকেই চান না প্রজন্ম সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তাদের অধিকার বুঝে নিক। কারণ সেটাই যদি ঘটে যায় তবে জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল-ঘেরাওয়ের মতো কাজগুলোতে মাঠে থাকবে কে!
সমকালীন প্রকৃত শিক্ষা প্রদান এবং গ্রহণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে একটি আধুনিক ক্যারিকুলাম। বেশ দুঃখের সঙ্গেই বলতে পারি, স্কুলজীবনে ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমরা পানিপথের যুদ্ধ আর আকবর, বাবর, আওরঙ্গজের আলীবর্দী খাঁদের কৃতিত্বের কথা পড়েছি। ভাবি, এসব বিষয় কি এখন আমার প্রাত্যাহিক জীবনে কোনো কাজে লাগছে? না লাগছে না। ধরা যাক, অঙ্কশাস্ত্রের কথা। সুদকষা শিখতে গিয়ে আমরা শিখেছি গোয়ালা দুধ বিক্রি করতে গিয়ে অনুপাত-সমানুপাত হারে কীভাবে দুধের সঙ্গে পানি মেশায়। তারপর কীভাবে তা বিক্রি করে। সন্দেহ নেই, বিষয়টি খুবই অনৈতিক। এক ধরনের প্রতারণার শামিল। অঙ্কের তো আরও অনেক চমৎকার বিষয় আছে। তাহলে এসব বিষয় আমাদের শেখানো হয়েছিল কেন? বাংলাদেশের শিক্ষা ক্যারিকুলামে এসব বিষয়ের সংযোজন-বিয়োজন খুবই জরুরি। সত্তর দশকের পরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সায়েন্স, আর্টস, কমার্সই ছিল প্রধান বিভাগ। সে সময় যারা অনার্স পড়তেন তারা ছিলেন অধিক ভাগ্যবান। মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল কলেজে ছাত্রদের প্রতিযোগিতা বেশি থাকলেও কৃষি, শিল্প, ফাইন আর্টস, লিবারেল আর্টস, ফ্যাশন ডিজাইন- এসব অনুষদে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলক ছিল কম।
আশার কথা, গত তিরিশ বছরে এমন অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ব্যাচেলর কিংবা মাস্টার্স করার ইচ্ছে এখন অনেক ছাত্রছাত্রীই করেন। এর পাশাপাশি কম্পিউটার সাইন্স, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ফ্যাশন আর্টস, ভূতত্ত্ব, খনিজসম্পদ তত্ত্ব, সৌরতত্ত্ব, বন ও পরিবেশতত্ত্ব, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণতত্ত্ব, পুষ্টিতত্ত্ব- এমন অনেক সমকালীন আধুনিক বিষয় পঠিত হচ্ছে বিশ্বে এ সময়ের বিদ্যা নিকেতনে। মনে রাখা দরকার নরসুন্দর কিংবা নাপিতের পেশার জন্যও পাশ্চাত্যে স্কুল রয়েছে। সেই পাঠ চুকিয়ে লাইসেন্স নিয়েই তবে সেলুনে কাজ পেতে হয়। কথায় কথায় আমরা ‘তুমি কি বেবি সিটিং করছ’ বলে যে মশকরা করি, সেই বেবি সিটিং করতে হলেও পাশ্চাত্যে ট্রেনিং এবং লাইসেন্স দুটোই নিতে হয়। এ বিষয়গুলো মনে রেখেই আমাদের বাঙালি প্রজন্মকে গড়ে উঠতে হবে।
বাংলাদেশে মাদ্রাসাশিক্ষা একটি স্থান দখল করছে ক্রমে। যারা মাদ্রাসায় পড়বে তাদের আধুনিক প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সৃজনশীল আধুনিকতা শিক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে আছে, বর্তমান সরকার ‘ভিশন-২০২১’- নামে একটি ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিল। এর বেশ কিছু পরিকল্পনাই এই সরকার সফল করতে পেরেছে। বাকিগুলো নিয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নের লক্ষ্যে সুশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ জন্য ‘শিক্ষাকে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার’ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি করা হয়েছিল। কমিটি চার মাসের মধ্যেই একটি খসড়া শিক্ষানীতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সর্বজনগ্রাহ্য একটি শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য খসড়াটির ওপর ব্যাপক জনমত গ্রহণের লক্ষ্যে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও সভা-সমাবেশ, সেমিনার-ওয়ার্কশপ থেকে মতামত গ্রহণ করা হয়। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গবেষক, অভিভাবক, রাজনীতিক, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, পেশাজীবীসহ সমাজের নানা পর্যায়ের মানুষের মতামত, সুপারিশ ও পরামর্শ বিবেচনায় নিয়ে খসড়া শিক্ষানীতিকে আরো সংশোধন-সংযোজন করে চূড়ান্তরূপ দেওয়া হয়। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর আলোকে দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণ এবং আগামী প্রজন্মকে দক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উদ্ভাসিত এবং আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করছে। বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতি অত্যন্ত আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক। এ শিক্ষানীতি অতীতের পশ্চাৎপদতা ও বিভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে যুগের চাহিদা পূরণে সক্ষম। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশ নতুন মাইলফলকে পৌঁছাবে।
শিক্ষা মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক বিষয়। তা কোনোদিনই শেষ হয় না। কর্মজীবনের জন্য অপরিহার্য শিক্ষা গ্রহণ করে কাজ করে খাওয়া যায়। কিন্তু মেধা বিকাশ এবং মননের উৎকর্ষসাধনের কাজটি থেকে যায় আজীবন। বিভিন্ন দেশে ষাট বছর বয়সেও পিএইচ-ডি করার খবর আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় পড়ি। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীই শুধু পাঠ্যবই নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সংবাদপত্র, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, চিত্রকলা, নাটক প্রভৃতি মননের বাতায়ন খুলে দেয়। প্রকৃত শিক্ষার্থীর উচিত এসব বিষয়ে পড়াশোনা করা। জ্ঞানের পরিচর্যা নিয়মিত অব্যাহত রাখা।
এ প্রসঙ্গে আমার এক সুহৃদ ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, গবেষক ড. জনসন বার্নস বলেন, আমার মা আমাকে নিয়ে খুব দরিদ্র জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু কিছু অর্থ হলেই তা থেকে তিনি আমাকে বই কিনে দিতেন। পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ভালো ভালো মুভি এনে দেখাতেন। তাই আমি প্রতিবছরই বিভিন্ন লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার ডলারের বই ডোনেট করি। এটাই হচ্ছে জ্ঞান বিতরণের চক্রবাক।
সনদ নয়, মানুষকে এগোতে হবে জ্ঞানার্জনে। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর অংশংগ্রহণকে সাফল্যের একমাত্র সূচক হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও আরও কিছু করণীয় রয়েছে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ইউনেস্কোর ‘এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এডুকেশন’ এর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমে ৪২ শতাংশ শিক্ষকই অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শতাংশের হিসাবে বলা যায়, প্রায় অর্ধেকসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষকই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ না নিয়েই শিশুদের পাঠদান করে যাচ্ছেন। শিক্ষার সাফল্য শুধুই যে কেবল পরিমাণগত সম্প্রসারণ নয়, গুণগত মানের বিকাশেই প্রধানত শিক্ষার সাফল্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আর শিক্ষার গুণগত মান অনেকাংশেই নির্ভর করে শিক্ষকের যোগ্যতার ওপর। আর শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মান নিশ্চিত করে শিক্ষার প্রতিটি ধাপে পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ এবং যথার্থ পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন না করার জন্যই এক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ও অংক বিষয়ের দক্ষ শিক্ষক সংকট ব্যাপক। এ সংকট উত্তরণের জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা। প্রয়োজনে অবসরে যাওয়া প্রবীণ প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের সহায়তায় শিক্ষকদেরকে উন্নতমানের ট্রেনিং কর্মশালার মাধ্যমে যোগ্যরূপে গড়ে তুলতে হবে।
এটা খুবই বেদনাদায়ক যে, এই সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি, নিপীড়নের অভিযোগ উঠছে। আবার একটি মহল বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ভালো! অথচ এরা নিজেরা পিএইচডি করে গিয়েছে ইংল্যান্ড-আমেরিকা থেকে। তাদের উদ্দেশ্য কী? তারা কী চান- বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কলোনিয়াল মৌলবাদ প্রতিষ্ঠা করতে? কিংবা ধরে রাখতে?
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে, সেই ছুরিতেই শান দিতে চাইছে একটি মহল। এরা মহান মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী। এরা বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতিকে বিসর্জন দিয়েই এগোতে চায়। আগেই বলেছি, বাংলাদেশকে তাকাতে হবে বিশ্বের দিকে। বিশ্বের কোথায় কীভাবে শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠিত, তা নজরে রাখতে হবে। সমকালীন দুনিয়ার সাথে তাল মিলিয়েই প্রজন্মকে দাঁড়াতে হবে। বুয়েটে এই মৌলবাদী মহল জিতে গেলে, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারা হানা দেবে। এই হানা রোধ করতে হবে। না, আজও বাংলাদেশে সেই পরাজিত শক্তির দাপট চোখে পড়ার মতোই। তারা প্রজন্মের মননে যে বিষবাষ্প ছড়াতে চাইছে- তা দেখতে হবে দিব্যচোখে।
লেখক: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৩/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.