মো. রহমত উল্লাহ্।।
“বিতর্ক এড়িয়ে রমজান মাসে ছুটি কার্যকর রাখতে আগামীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল হতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মঙ্গলবার (২৬ মার্চ ২০২৪) আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায় এ কথা জানান তিনি।” শিক্ষার্থীদের বৃহত্তর স্বার্থে যে কোন গঠনমূলক সিদ্ধান্ত বিবেকবান শিক্ষক সমাজ আন্তরিকভাবে মেনে নিবেন এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। তথাপি কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পূর্বে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের শিক্ষক, অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মতবিনিময় করে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথকভাবে বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘন্টা যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করে নেওয়া উত্তম। এক্ষেত্রে ডাবল শিফট ও সংযুক্ত বিদ্যালয়ের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। রমজান মাসের ছুটি নিশ্চিত করার জন্য শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি কাটছাঁট করা এখন আর সহজ হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন ঘোষণা করার আগেই এমন আরো অনেক বিষয় বিবেচনা করা উচিত ছিল। রমজান মাসের ছুটি ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি সংক্রান্ত আরো অনেক বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, আলোচনা করতে হবে, ঐক্যমতে পৌঁছতে হবে। সকল ক্ষেত্রেই অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে আন্তর্জাতিক মান। সেই সাথে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে শিক্ষকদের জীবনমান।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবারের পরিবর্তে বৃহস্পতি ও শুক্রবার নির্ধারণ করা অধিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে; যা শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। বিশেষ করে কর্মজীবী অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের শুক্রবারে নিজেদের মত সময় দিতে পারবেন এবং শনিবারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সন্তানদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে শিক্ষকগণের পরামর্শ নিতে পারবেন ও প্রয়োজনীয় মতামত দিতে পারবেন। অর্থাৎ অভিভাবক-শিক্ষক সমিতি (পিটিএ) এর কার্যক্রম আরো জোরদার করা যাবে। পরিচালনা পরষদ (জিবি, এসএমসি, এমএমসি) এ অধিক শিক্ষিত কর্মজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে শনিবারে সভা করে উপস্থিতি বৃদ্ধি করে অধিক সহযোগিতা নেওয়া যাবে। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মচারীরা বৃহস্পতিবারে ছুটি না নিয়ে নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট অপারেট করাসহ অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে পারবেন। তদুপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন চাইলে বৃহস্পতিবারে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিসিয়াল কাজও সম্পাদন করতে পারবেন। অপরদিকে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও পানি-বিদ্যুৎ বন্টনের ক্ষেত্রেও তা সামান্য সহায়ক হবে।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের ছুটির তালিকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা এবং উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরেক ধরনের ছুটির তালিকা কাঙ্খিত নয়। সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই রকম ছুটির তালিকা থাকা উচিত। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিবস ছুটি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেমন: ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, বাংলা নববর্ষ, ১৫ আগস্ট ও ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু সে সকল দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। দিবস উদযাপনের জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন বিধায় কর্মচারীদেরও প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মত শিক্ষক-কর্মচারীরা ঐ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে বাস্তবে ছুটি ভোগ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে অনেকের মনে অসন্তোষ বিরাজ করে। এসকল দিবস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ছুটির দিন নাকি খোলার দিন তা পরিষ্কার নয়! তাই প্রতিষ্ঠান প্রধানরাও শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হন। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে শিক্ষকদের মতপার্থক্য হয়, দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছুটির দিনে এক বা একাধিক শিক্ষক-কর্মচারী অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে তা পরিষ্কারভাবে বলা না থাকায় প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ চরম বেকায়দায় পড়েন।
শিক্ষার্থীদের বিশেষ দিবসে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ও বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত করে কিছুটা বাধ্যবাধকতা আরোপ করা গেলেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার তেমন কোন নির্ধারিত উপায় ঘোষণাকৃত নেই। কোন শিক্ষক-কর্মচারী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ দিবসে স্বপ্রণোদিত হয়ে স্বেচ্ছায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে অর্থাৎ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকতে চাইলে বা বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকলে প্রতিষ্ঠান প্রধান কী করবেন বা কী ধরনের ব্যবস্থা নিবেন তা পরিষ্কার করে উল্লেখ থাকা উচিত। একজনকে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঐদিন অনুপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হলে ১০ জন ১০ রকমের সমস্যা উত্থাপন করে অনুপস্থিত থাকার আবদার করেন! সবার আবদার রাখতে গেলে দিবস উদযাপন করা সম্ভব হয় না। আবার অনুপস্থিতির সংখ্যা হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানের ক্ষমতা বলে ওই দিনের অনুপস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর একদিনের নৈমিত্তিক ছুটি কমিয়ে দেওয়া হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন; যদিও ছুটিবিধি অনুসারে কর্মী বৎসরে পূর্ণ বিশ দিন নৈমিত্তিক ছুটি অধিকার হিসেবে প্রাপ্য নন এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান তা দিতে বাধ্য নন। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবস উদযাপনের দায়িত্ব কেবল প্রতিষ্ঠান প্রধানের ও আগ্রহী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে একটা পরিষ্কার দিকনির্দেশনা থাকা আবশ্যক।
অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু ছুটি বিদ্যমান যে সকল ছুটির দিনে বা ভ্যাকেশনে সরকারি অফিস খোলা থাকে। তাই সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস থেকে বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ এসে থাকে; যা জরুরি ভিত্তিতে সমাধান করতে হয় বিধায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অফিস খোলা রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অফিসিয়াল কাজ বা হিসাব সংক্রান্ত কাজেও ভ্যাকেশনের সময় অফিস খোলা রাখার প্রয়োজন পড়ে। ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিলাপ, বেতন-বিল তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রতিষ্ঠান নিয়মিত খোলা না রেখে উপায় থাকে না। তখন প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারীদের উপস্থিত থাকতে হয়। অর্থাৎ তারা ওই ভ্যাকেশন উপভোগ করতে পারেন না। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্টর কর্মী হিসেবে ট্রিট করার কারণে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা ছুটি অর্জন ও বিক্রির সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং তারা পিআরএল ভোগের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারী প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না চাইলে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা থাকা উচিত। তবে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অবকাশ বিভাগের সুবিধা ভোগ করতে পারেন না তাদেরকে অবকাশ বিভাগের কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তাও ভাবতে হবে।
সর্বোপরি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অফিসের জন্য পৃথকভাবে যৌক্তিক বার্ষিক মোট কর্মদিবস তথা মোট কর্মঘন্টা নির্ধারণ করে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে ও অন্যান্য ভ্যাকেশনে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধান, সহপ্রধান, শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য পুরস্কার-তিরস্কার নির্দিষ্ট করা আবশ্যক।
লেখক: অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.