ভোলাঃ জেলার মনপুরায় শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও ভাতাভোগীদের টাকা নিশ্চিত করার নাম করে নগদ এর মাধ্যমে তাদের হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র।
বোর্ড কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তার, সমাজসেবা কর্মকর্তা, নগদ কর্মকর্তার ও নগদ এজেন্ট এর নাম ভাঙিয়ে চক্রটি এ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, উপজেলার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকারিভাবে দেওয়া উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নিতে বেশ কিছুদিন ধরে একটি প্রতারক চক্র কাজ করছে।
এদিকে টাকার শোকে হতদরিদ্ররা আহাজারি করলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। কিন্তু এ ব্যাপারে মোবাইল ব্যাংকিং নগদ ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের গড়িমসির কারণে এই দ্বীপ গ্রামাঞ্চলে শত শত বিধবা, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ব্যক্তি এবং ছাত্রছাত্রী মাঝে হতাশা বাড়ছে বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি প্রাথমিক পর্যায়ে উপবৃত্তিপ্রাপ্তদের প্রকাশিত তালিকা ধরে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তারা টাকা হাতিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে তারা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পরিচয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে বিভিন্ন নম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের নাম-ঠিকানা ও বাবা-মায়ের নাম এমনকি স্কুলের ক্লাস রোল পর্যন্ত ঠিকঠাক বলে।
প্রত্যন্ত এলাকার শিক্ষার্থী ও সরকারি ভাতা ভোগীদের মোবাইল ব্যাংকিং সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান ও তাদের সরলতার সুযোগে নগদ অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর হাতিয়ে নিতে ফাঁদ পাতছে প্রতারকেরা।
গত এক সপ্তাহে উপজেলার অন্তত ৫০ শিক্ষার্থী তাদের উপবৃত্তির ও ৩০ ভাতা ভোগীদের টাকা খুইয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বেশি হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্থানীয় নগদ এজেন্টরা জানিয়েছেন, শিক্ষার্থী ও ভাতা ভোগীরা প্রতারকের কাছে টাকা খোয়ানোর অভিযোগ নিয়ে তাদের কাছে আসছে। এবং তাদের মোবাইল ব্যাংকি সম্পকে জ্ঞান না থাকায় তারা খুব উত্তোজিত হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারছেন না।
প্রতারণার শিকার বেশ কয়েকজন ভাতাভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের মোবাইলে নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরকারি ভাতার টাকা দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে তাদের ফোনে খুদে বার্তা আসে। এরপর এক ব্যক্তি ফোন করে বলেন, আমি নগদ এর কাষ্টমার কেয়ার থেকে বলছি। আপনার নগদ অ্যাকাউন্টে সচল করতে হবে একটি বার্তাটি পাঠানো হয়েছে। খুদে বার্তায় পাঠানো পিন কোডটি বলতে অনুরোধ করেন। পিন কোডটি তারা সরল মনে ওই ব্যক্তিকে বলে দেন। কিছুক্ষণ পর নগদ অ্যাকাউন্টে ঢুকে দেখেন তাদের সব টাকা ক্যাশ আউট করা হয়েছে।
কেউ কেউ অভিযোগ করেন, তারা কোনো ফোন বা খুদে বার্তা পাননি। তারপরও নগদ পিন নম্বর পরিবর্তন করে তাদের সব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় নগদ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহখানেক হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে শিক্ষাথীদের অ্যাকাউন্টে টাকা আসছে। এর মধ্যে সরকারি সহয়তা প্রতিবন্দী ও বিধবা ভাতা ভাতাভোগীদের নগদ অ্যাকাউন্টে আসছে। এতে করে সংক্রিয় হচ্ছে চক্রটি।
মনপুরা উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট ভাতাভোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ৫শত ৯৪ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ১ হাজার ৪ শত ২৭ জন, বিধবা ২ হাজার ২৫৪ জন ও বয়স্ক ৩ হাজার ৯শত ১৩ জন। এসব ভাতাভোগী মানুষ নগদের মাধ্যমে ভাতা পাচ্ছেন।
সমাজসেবা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, ভাতার টাকার জন্য উপজেলা থেকে পে-রোল করা হয়। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা জমা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভাতার টাকা নগদের মাধ্যমে ভাতাভোগীদের মোবাইলে পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কতজনের টাকা হ্যাক করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। তবে প্রতিদিনই বেশ কয়েকজন ভাতাভোগী অফিসে এসে এ ধরনের অভিযোগ করছেন।
দক্ষিণ সাকুচিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাইজিদ এর মা স্বপনা বেগম ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে আসলে। তিনি জানায়,নগদ অ্যাকাউন্টে টাকা আসার পর মুঠোফোনের অপরিচিত নম্বর থেকে প্রতারক চক্রের কল আসে।
সেখানে বলা হয়, ‘হ্যালো, আমি নগদ থেকে বলছি। আমাদের এখানে সিকিউরিটি প্রবলেম হচ্ছে। আমরা আপনার নগদ অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেব। তার আগে দেখেন আপনার অ্যাকাউন্টে উপবৃত্তির টাকা ঢুকেছে কি না। যদি টাকা ঢুকে থাকে, তবে ওই টাকা আপনি তুলতে পারবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের অফিস থেকে সিকিউরিটি পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে না নেবেন। ততক্ষণ পযন্ত আপনার ছেলের টাকা তুলতে পারবেন না। তখন একটি ওটিপি আসে সেটি আবার তাদের কে বলতে হয়। এ রকম কথা বলে প্রতারকেরা গ্রামের শিক্ষার্থীদের বাবা মাদের বিভ্রান্ত করে ফাঁদে ফেলছে। কথার মারপ্যাঁচে কৌশলে পিন নম্বর সংগ্রহ করে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ অ্যাকাউন্টের সব টাকা। গত এক সপ্তাহে এই দ্বীপ উপজেলা প্রত্যন্ত এলাকায় এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিধবা ভাতাভোগী জাহানারা বেগম বলেন, গতবছর স্বামী মাছ শিকার করতে গিয়ে নদীতে পরে মারা গেছে। কোন ডাল কুল নেই। সরকারি সহয়তার উপর চলে আমার সংসার। গতকাল একটি নাম্বারে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা পরিচয়ে এক ব্যক্তি আমাকে জানান, আমি ভাতার ১৫ শত টাকা পেয়েছি। তিনি মোবাইল ফোনে আমার নাম, বাসার ঠিকানা সবকিছু ঠিক ঠাক বলেন। তারপর বলেন, আপনার মোবাইলে একটি নম্বর যাবে সেই সেটি আমাকে তাড়াতাড়ি জানাবেন। সব কিছু ঠিকঠাক বলাতে আমি বিশ্বাস চলে আসে এবং আমি তার কথার ফাঁদে পড়ে তাদের দেওয়া ওটিপি পিন নম্বর বলে দেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার মোবাইল থেকে ভাতার ১৫শত টাকা ও আমার ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নেয়া ২৫০০ টাকা উধাও হয়ে যায়। এতে করে এখন আমার সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছি।
এ ব্যাপারে মনপুরা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিক অভিযোগ এর তীর নগদ এর দিকে দিচ্ছেন। তিনি বলেন নগদ এর কর্মকর্তা বা তাদের কোন প্রতিনিধিরা এই সব করে বেড়ায় বলে ধারনা করছেন। প্রতারক চক্রের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতারক চক্রটি তথ্যপ্রযুক্তিতে বেশ পারদর্শী।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, মনপুরা থেকে ঠিক কত জনের টাকা নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তুলে নেওয়া হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। তবে আমরা প্রাথমিক ভাবে কয়েক জন ভাতাভোগীকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাদের তালিকা নগদ কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি। টাকা উদ্ধারের কোনো সুখবর নগদ এর কাছে পাননি। অভিযোগকারীদের কোনো সহায়তা দিতে পারছি না।
তবে, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। যাতে করে ভাতাভেীদের গোপন পিন নাম্বার কাহুকে না দেয়।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সুনিল দেবনাথ বলেন, আসলে ব্যাপারটি বেশ দুঃখজনক ‘কোনো শিক্ষার্থী যাতে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা না দেয়, সে ব্যাপারে আমরা শিক্ষকদের মেসেজ দিচ্ছি। শিক্ষকেরা দ্রুত বিষয়টি শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেবেন।’
এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মা সবাবেশ করে অভিবাকদের সচেনত করছি। কোন ভাবেই যাতে তাদের পিন নম্বর কাউকে না বলতে সতর্ক করে দিয়েছি।
এদিকে উপজেলা সচেতন মহল মনে করেন নগদ এর মাধ্যমে টাকা আসে এতে করে প্রতারকচক্র কি করে ভাতাভোগী ও ছাত্রছাত্রীদের নাম্বার এবং তাদের সম্পূন তথ্য পায়? এতে করে নগদ এর লোকজন এর সাথে জড়িত থেকে এই ভাবে অসহায় মানুষের হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর প্রতিকার ও তদন্ত দাবি করে তারা।
এ ব্যাপারে মনপুরা থানার কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম বলেন, তাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ নিযে অনেকে আসছে। প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভাতাভোগী থানায় জিডি করেছেন। সেই জিডির কপি ভোলা সাইবার ইউনিটে দিচ্ছি তারা কাজ করছে। বেশিরভাগ ভাতাভোগী সহজ-সরল এবং তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। তাই সহজেই প্রতারকরা তাদেরকে ফাঁদে ফেলতে পারছেন। নগদ গ্রাহকদের পিন নম্বর সংরক্ষণের ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে আটকের চেষ্টা চলছে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/০২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.