শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সম্পূর্ণ চাবিকাঠি শিক্ষকদের হাতে!

জসীমউদ্দীন ইতিঃ  কিছুদিন আগে সংঘটিত হওয়া রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অভিভাবকদের প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রতিবাদ সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, ঝড় বয়ে গিয়েছিলে নেটিজেনদের মধ্যে। কিন্তু কী আছে এই নতুন শিক্ষাক্রমে? তাই এই নতুন শিক্ষাক্রমের ইতিবাচক ও নেতিবাচক কিছু দিক নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। মূলত আমাদের শিক্ষাক্রমকে একদম নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার কিছুটা প্রয়োগ এই বছর লক্ষ করা যাচ্ছে। এই শিক্ষাক্রমের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখন থেকে একাদশ শ্রেণির আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও মানবিক বলতে কোনো বিভাগ বিভাজন থাকবে না। এখন থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীদের নিজে নিজে শেখার ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। আর শিক্ষক হবেন কেবলই একজন সহায়তাকারী যিনি নিজে শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দেবেন না। থাকবে না শ্রেণির রোল বিভাজন, অর্থাৎ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলতে কোনো আলাদা স্থান থাকবে না, যেখানে সবাই থাকবে সমান। আরেকটা বড় পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এখনকার মূল্যায়ন পদ্ধতি আগের মতো শুধু পরীক্ষার ভিত্তিতে থাকবে না, বরঞ্চ বছরব্যাপী শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং তার সঙ্গে দুটি সামষ্টিক মূল্যায়নের পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। বিষয়গুলো তো আপাতদৃষ্টিতে বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। তাহলে এরপরেও এত প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে কেন?

প্রথমেই চলে আসি মূল্যায়ন পদ্ধতির দিকে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী বিষয়টুকু কতটুকু শিখছে, তার আগ্রহ কেমন, ক্লাসে সে কী রকম ব্যবহার করছে এবং দলগত কাজ সে কতটা দক্ষভাবে করে উঠতে পারছে, সেটারই মূল্যায়ন। এরপর চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচটি বিষয়ে শিখনকালীন এবং সামষ্টিকভাবে উভয় মূল্যায়নের পদ্ধতি চালু করা হবে। এরই মধ্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিটি শ্রেণিতে এর প্রয়োগ যথাযথভাবে চালু করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

সবই তো বোঝা গেল। তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়। প্রথমত, পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে এবং পরীক্ষার ফলাফলের ওপরে মূল্যায়নের গুরুত্ব কমে যাওয়ার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকাংশেই পড়ালেখার প্রতি অনীহা কাজ করছে। তাছাড়া সামষ্টিক মূল্যায়নের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনাও সুনির্দিষ্ট নয়। আরও ভেঙে বললে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করেছে ৫ নভেম্বর থেকে। কিন্তু স্কুলে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে ২৯ অক্টোবর। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের হাতেই সময় রয়েছে মাত্র ছয় দিন মূল্যায়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য। এতে অবশ্যই একটি হযবরল পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটেছে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপাত বেশ অবাস্তব। এমনিতেই আমাদের দেশের শিক্ষকদের একটি স্বাভাবিক আদর্শ মাত্রার তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষার্থীদের সামলাতে হয়। সেই দিক বিচারে একটি নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি আয়ত্ত করে সে হিসেবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার চাপ একজন শিক্ষক কতটুকু নিতে পারবেন, সেটা নিয়ে যথেষ্ট ভাবার অবকাশ রয়েছে। উপরন্তু আমাদের দেশের প্রান্তিক শিক্ষকদের সেই দক্ষতা আছে কি না, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

তৃতীয়ত, এখানে একটি নৈতিকতার প্রশ্নও দেখা দেয়। যেহেতু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের সম্পূর্ণ চাবিকাঠি শিক্ষকদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে, সেহেতু শিক্ষকদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া-না পড়ার ওপর মূল্যায়নের ব্যাপক প্রভাব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের দিয়ে রাজনৈতিক স্লোগান দেয়ানো, নির্দিষ্ট কোনো দলে থাকাকে বাধ্যতামূলক করে দেয়ার নজিরও আমরা এরই মধ্যে দেখতে পেয়েছি। আবার সরকারি-বেসরকারি অনেক বিদ্যালয়ের কমিটির গভর্নিং বোর্ডের সদস্য, রাজনীতিবিদ, অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানদেরকে অনেক সময় শিক্ষকদের অনেকটা জোরপূর্বকভাবে যোগ্যতার চেয়ে অনেক বেশি নম্বর প্রদান করতে হয়। এতে শিক্ষকরা অনেক সময়ই তাদের নৈতিকতা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। এখন যেসব শ্রেণিতে সরকারি বৃত্তি প্রদান করা হয়, তাতেও যদি মূল্যায়নের এমন পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে শিক্ষকদের ওপর ব্যাপক চাপ পড়বে। এতে হয়তো যোগ্য লোকরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবে।

চতুর্থত, এত বছর যেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে সর্বনিম্ন ৩০ শতাংশ নম্বর বরাদ্দ ছিল, সেখানে সেটাকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বিষয়ের ওপর তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দেবে। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

পঞ্চমত, যেখানে আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোর পর্যাপ্ত স্যানেটারি সুবিধা নেই, সেখানে বর্তমান শিক্ষাক্রমের কার্যাবলি সম্পন্ন

পরিশেষে আসছে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার প্রশ্ন। ভেবে দেখুন তো আগের যুগের মেট্রিক পাশ একজন ব্যক্তির সঙ্গে বর্তমান সময়ের এসএসসি পাশ একজন শিক্ষার্থী কোনোভাবে টক্কর দিতে পারবে কি না। এটা ইংরেজির ক্ষেত্রেই হোক, গণিতের ক্ষেত্রেই হোক, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই হোক, অথবা ভূগোলের ক্ষেত্রেই হোক না কেন। আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে—কোনোভাবেই এটা সম্ভব নয়। এর কারণ কী? তাদের সময় তো মোবাইল, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। তাহলে আগের থেকে শিক্ষার্থীদের হার বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষার মান বেড়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। গোটা বিশ্ব এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজের অন্তর্ভুক্ত। সে ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে কাজ করার যেমন সুযোগ বেড়েছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে প্রতিযোগিতাও। আর যেখানে এসএসসিতে জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীদের ‘আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি’র অনুবাদ করতে বললে তারা উত্তর দেয়: Iam a GPA-5 আবার SSC -এর পূর্ণরূপ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয়, এখন মনে পড়ছে না, সেখানে গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক হিসেবে প্রতিযোগিতা করার মতো দক্ষতা এবং বিশ্বদরবারে নিজের আওয়াজ তুলে ধরার সক্ষমতা কতটুকু বা আদৌ সেটা তৈরি হয়েছে কি না, তা নিয়ে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান।

বলা হচ্ছে, এই শিক্ষাক্রম ফিনল্যান্ডের আদলে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে পৃথিবীর সেরা শিক্ষকরা পাঠদান করে থাকেন। আমাদের সেই সক্ষমতা এবং দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে কি না, সেটা নিয়েও ভাবা উচিত।

আবার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অথবা অ্যাসাইনমেন্ট তৈরিতে ব্যাপকভাবে ডিজিটাল ডিভাইসের অন্তর্ভুক্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। আর এটা প্রাথমিকভাবে কিছু সুবিধা বয়ে আনলেও ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা ডিজিটাল ডিভাইসকে ডিজিটাল ড্রাগও বলা হয়। এই বাড়ন্ত বয়সে ডিজিটাল ডিভাইসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কাউকে করবে গেমে আসক্ত, কাউকে করবে পর্নে আসক্ত, আবার কাউকে বানাবে সময় নষ্টের মেশিন।

পরিশেষে বলা যায়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনাটা চমৎকার। কেননা, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়তো এতটা আস্থা অর্জন করতে পারেনি, যার কারণে আমাদের দেশেরই মন্ত্রী-এমপি এবং এলিট শ্রেণির লোকেরা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাঠাচ্ছেন, দেশের সরকারি-বেসরকারি লিডিং পজিশনগুলোয় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে কয়েকগুণ বেশি বেতনে লোক নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা আলুভর্তা বানানো, বিছানা প্রস্তুত করা, ব্যাং লাফ দেয়ার মাধ্যমে নয়। লাইফ-লং লার্নিং এবং টেক্সটবুক লার্নিংয়ের মাঝে অবশ্যই একটি লাইন তৈরি করে দিতে হবে। এ দুটোকে কোনোভাবেই জগাখিচুড়ি বানানো যাবে না। দুটোর মধ্যে অবশ্যই একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন বিশ্বদরবারে আমরা সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। বাংলাদেশি পরিচয়টা যেন আমাদের জন্য লজ্জার নয় বরং গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

লেখকঃ সাংবাদিক 

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/১২/২০২৩

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়

“মুক্তমত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.