ঢাকাঃ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পূর্বশর্ত ও শিক্ষা খাতের অন্যতম অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা হয় পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের উপস্থিতিকে। যদিও বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার কমে আসছে বলে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এক যুগ আগে ২০১১ সালেও দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা খাতে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শিক্ষকের হার ছিল ৭৫ শতাংশের কিছু বেশি। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় ৬৮ শতাংশে।
প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষক বলতে প্রধানত বিভিন্ন শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া শিক্ষকদের বোঝানো হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ শেষে এসব শিক্ষকের যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে সনদ দেয়া হয়ে থাকে। ব্যানবেইসের প্রতিবেদনেও প্রশিক্ষিত শিক্ষক হিসেবে মূলত ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড), ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন (বিপিএড), ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার এডুকেশন (বিএজিএড), মাস্টার্স অব এডুকেশন (এমএড) অথবা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রিধারীদেরই বিবেচনা করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশে মোট শিক্ষকের মধ্যে প্রশিক্ষিতের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। নারী শিক্ষকদের মধ্যে এ হার ছিল ৭৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর পর পরই দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার নিম্নমুখী হয়ে ওঠে। গত দশকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে ২০১৪ সালে। ওই সময়ে মোট শিক্ষকের ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং নারী শিক্ষকদের ৬০ দশমিক ২৪ শতাংশ ছিলেন প্রশিক্ষিত। পরে ২০১৬ সালে প্রশিক্ষিত মোট শিক্ষকের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের হার পৌঁছে ৬৭ দশমিক ৭৮ শতাংশে। কিন্তু এর পর থেকে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার আবারো কমতে শুরু করে। সর্বশেষ ২০২২ সালে প্রশিক্ষিত মোট শিক্ষকের হার ৬৭ দশমিক ৯১ শতাংশে এবং প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের হার ৬৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছে।
পুরনো দক্ষ শিক্ষকদের অবসর গ্রহণ ও নতুনদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় এক যুগে এমন পরিসংখ্যানগত পার্থক্য তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ড (মাউশি) কর্মকর্তারা। যদিও শিক্ষকরা বলছেন, চাকরিরত প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জনের জন্য ছুটি না পাওয়া এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জটিলতা থাকায় শিক্ষকদের অনেকেই বিএড ডিগ্রি নিতে পারছেন না। ফলে মোট শিক্ষকের মধ্যে দক্ষ ও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হারও এখন কমে চলেছে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত না করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়নে আমরা যত পরিকল্পনা করি না কেন বা শিক্ষাক্রমে যতই পরিবর্তন আনি না কেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে না পারলে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। যেমন সম্প্রতি যে শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়ন শুরু হলো এর লক্ষ্য অর্জন তখনই সম্ভব হবে, যখন আমাদের শিক্ষকরা ভালোভাবে প্রশিক্ষিত হবেন।’
দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে নারী শিক্ষকদের এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় সবচেয়ে বেশি। পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেয়াটা তাদের কারো কারো জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন তারা।
এমনই এক শিক্ষক শারমিন আক্তার। এমপিওভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এ শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটিতে আমার বিষয়ে একমাত্র শিক্ষক আমি। আর কেউ না থাকায় আমি বিএডের জন্য ছুটি চাইলেও পাইনি। আবার বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের বিএড সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ পেলেও অনেক সময় বিএড স্কেল পাওয়া যায় না। এ কারণে এখনো আমার পক্ষে বিএড করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পরিবার থেকেও অনেক সময় দূরে গিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ছাড়তে চায় না। আর বেসরকারি থেকে মোটা টাকায় সনদ নেয়াটাও অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। এছাড়া নারী শিক্ষকদের বেশির ভাগকেই চাকরির পাশাপাশি পরিবার ও সন্তান সামলাতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে প্রশিক্ষণের জন্য বাড়তি সময় বের করাও অনেকের জন্য সম্ভব হয় না।’
বিগত দশকগুলোয় শিক্ষা খাত নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের অভাব। এর বড় দুটি উদাহরণ হিসেবে ২০০৭ সালের সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি ও ২০১২ সালে নতুন শিক্ষাক্রমকে সামনে আনছেন শিক্ষাবিদরা। এমনকি মাউশির গত বছরের মে মাসে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর প্রায় দেড় দশক পরও সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারছেন না এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি শিক্ষক।
মাউশির আওতাধীন নয় অঞ্চলের ৬ হাজার ৭৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিচালিত সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ শিক্ষকই সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। তারা বাইরে থেকে তৈরি করা প্রশ্নপত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেন। এর আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একই ধরনের আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না ৪১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক।
প্রশিক্ষিত ভালো শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করছেন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদাতারা। রংপুর সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘একজন স্নাতক, স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও তিনি ছাত্রদের কীভাবে শেখাবেন, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় কীভাবে সামাল দেবেন—এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শিক্ষক যদি এসব বিষয়ে প্রশিক্ষিত না হন, তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি করতে চাইলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাকে অবশ্যই সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আর কিছুদিন পরই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে দেশের নতুন শিক্ষাক্রম। এক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করাকে। গণসাক্ষরতা অভিযানের গবেষণা প্রতিবেদন এডুকেশন ওয়াচ ২০২২- এর তথ্য অনুযায়ী ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষক এবং ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মকর্তা মনে করেন, নতুন পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতি করতে হলে আমাদের শিক্ষকদের অবশ্যই যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় আনতে হবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে একটা বড় চ্যালেঞ্জ দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। নতুন যে শিক্ষাক্রমটি ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে। তবে এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলেও সবার আগে আমাদের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এ কারণে এই মুহূর্তে শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে গুরুত্ব দেয়াটা আরো বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে।’
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। বিশেষ করে বেসরকারি কয়েকটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের মানহীন প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কোনো কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে মোটা টাকার বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র পরীক্ষা দিয়ে বিএড-এমএড সার্টিফিকেট সংগ্রহ করার অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে বর্তমানে যেসব শিক্ষক বিএড, এমএড সম্পন্ন করছেন তাদের একটি বড় অংশ নামমাত্র পরীক্ষা দিয়ে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে সার্টিফিকেট নিচ্ছেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে সনদ মিললেও যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত হচ্ছেন না শিক্ষকরা। সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমেও এর প্রভাব পড়ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ রাজশাহীর অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. শওকত আলী খান বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রশিক্ষিত শিক্ষক কম। আবার বর্তমানে যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাদের বড় একটি অংশ যাচ্ছে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের মান নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সপ্তাহে ছয়দিন ক্লাসের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাদের ক্ষেত্রে তা নেই। তাই এখানে যারা বিএড করছেন, তারা কতটা শিখছেন—এ বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যেহেতু শিক্ষার উন্নয়নে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই, তাই সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানে মনিটরিং চালানো ও মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট জনবলের। এ সংকট কাটিয়ে উঠলে বাকি সব সংকটও ধীরে ধীরে কেটে যাবে। তবে এই জনবলের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমাদের যা যা করণীয় আমরা তার সবই করছি।’ বণিক বার্তা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.