কিশোরগঞ্জঃ নিকলী ও বাজিতপুরের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিয়েই। খণ্ডকালীন অদক্ষ শিক্ষক দিয়েই চালিয়ে যেতে হচ্ছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পাঠদান। এ ছাড়া বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতদের আচরণও বাণিজ্যমনা। নিকলী বাজিতপুরে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ হাজার ২০৬। শিক্ষক সংখ্যা ৪৮৮। এ ছাড়াও প্রাথমিকে ৪৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে এক হাজার ৬৩ জন শিক্ষক। ১৭১টি প্রতিষ্ঠানের ৬৪ বিদ্যালয়ে এখনো প্রধান শিক্ষকের পদ খালি। উপজেলা পর্যায়েও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত।
নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলা ছাড়াও আশপাশের বেশ কিছু উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠেছে। কৌশলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বেতন ও ফ্রি আদায় করে নিচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাবরেটরি না থাকলেও নিচ্ছে ল্যাব ফি, নিচ্ছে বৈদ্যুতিক বিলের নামে অতিরিক্ত টাকা। এ ছাড়াও রসিদে লেখা থাকে বিবিধ খরচ। তা ছাড়াও অনিয়মের জরিমানাতো আছেই। অভিযোগ উঠেছে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়াও অতিরিক্ত পরীক্ষা বাবদ ফি তো রয়েছেই। স্থায়ী শিক্ষকদের তুলনায় খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের লক্ষ্য ও উদ্দশ্যই থাকে কৌশলে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে প্রাইভেট পড়ানো। অনেকে আবার শ্রেণী কক্ষের ভেতরেই প্রাইভেট পড়ানোর সুযোগ করে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূত বেত্রাঘাতেরও অভিযোগ উঠেছে। অনেকে স্কুলে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মানের অসঙ্গতির জন্য শ্রেণী শিক্ষকের মন জয় করতে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়ে। সাময়িক সুবিধার আশায়ও অনেকে প্রাইভেট পড়ে। এভাবেই বাধ্য হয়ে অনেকে প্রাইভেট নির্ভর হয়ে উঠেছে। তবে সে ক্ষেত্রে নিম্নবিত্ত পরিবারকে এর জের পোহাতে হচ্ছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও স্থানীয় একাধিক কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তারা বলেন, শ্রেণী শিক্ষকের নিকটে প্রাইভেট পড়লে বার্ষিক পরীক্ষায় সুবিধা পাওয়া যায়। তা ছাড়া যারা শ্রেণী শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে ভিন্ন নজরেও দেখা হয়। প্রাইভেট নির্ভর পড়াশোনর জন্য প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে অভিভাবক ও সচেতন মহলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খণ্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন দেয়া হচ্ছে অতি নগণ্য। তিন হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকার মধ্যে। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সাবজেক্ট ভিত্তিক পাঠদান অনেকেই করতে ইচ্ছুক নন। অনেকে কলা অনুষদে পড়াশোনা করে প্রধান শিক্ষককে ম্যানেজ করে ইংরেজি ও গণিত পড়াচ্ছেন। তাদের লক্ষ্যই প্রাইভেট পড়ানো। এতে করে শিক্ষার গুণগতমান ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে গ্রাম ও মফস্বলের এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
অপর দিকে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার মান তুলনামূলক একটু ভালো- সেসব প্রতিষ্ঠান আরো অধিক বাণিজ্য মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে বলেও জানান অসংখ্য অভিভাবক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মান অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে এমন অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি তদারকির ঘাটতিকেও দায়ী করেন অনেকে।
বাজিতপুর উপজেলার আফতাব উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, জেলার এমপিওভুক্ত অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে আফতাব উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেতন তুলনামূলক অনেক বেশি। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। প্রতিষ্ঠানটির শিশু শ্রেণীতে ভর্তি বাবদ নেয়া হয় তিন হাজার ৫০০ টাকা করে। এ ছাড়াও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত এই ফি একই বলে জানান প্রধান শিক্ষক। এ ছাড়াও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছেলেদের কাছ থেকে নেয়া হয় পাঁচ হাজার ৭৯৫ টাকা। মেয়েদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার ৮২০ টাকা করে। নবম ও দশম শ্রেণীর ছেলেদের কাছ থেকে ৬৮৪৫ টাকা আর মেয়েদের কাছ থেকে ৬৮৭০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ৬০০। স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা ১০০ জন আর খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬ জন। যাবতীয় স্টাফ রয়েছেন ৩৫ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনিচ্ছুক একাধিক ছাত্রের অভিভাবক বলেন, আফতাব উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গরিবের পড়াশোনা চালিয়ে নেয়া খুবই কষ্টকর। জেলা পর্যায়ের মধ্যে তুলনামূলক বেতন ফ্রিসহ অন্যান্য খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। শিশু শ্রেণীর বেতন ৬০০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণীর ৬৫০ টাকা, ষষ্ঠ শ্রেণীর ৭০০ টাকা, সপ্তম শ্রেণীর ৭৫০ টাকা। অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৮০০ টাকা। এ ছাড়াও হোস্টেলে থাকা খাওয়া বাবদ গুনতে হয় প্রতি মাসে চার হাজার ১০০ টাকা করে। এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ ও দুই মাসের কোচিং ফি যোগ করে বরাবরই নেয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। চলতি বছর এখনো নির্ধারণ করা হয়নি অতিরিক্ত টাকা এমনটি জানান প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক। তবে সে ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি এসব নির্ধারণ করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেগম রহিমা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ শতাধিক। মোট শিক্ষের সংখ্যা ৪০ জন। এর মধ্যে খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন ১৯ জন। এই প্রতিষ্ঠানেও শিশু শ্রেণীতে ভর্তি বাবদ নেয়া হয় ২০২০ টাকা। মাসিক বেতন ১৮০ টাকা। এই ধারাবাহিকতা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী ২৫০ টাকা আর নবম ও দশম শ্রেণীতে ৩০০ টাকা। অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর ভর্তি বাবদ দুই হাজার ২০০ টাকা।
অপর দিকে নিকলীর জারইতলা উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১১ শতাধিক। মোট শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ২৭ জন। স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা ১৩ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা আটজন।
খণ্ডকালীন শিক্ষকের বেতন দেয়া হচ্ছে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা করে। এরই মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীর বেতন ১৫০ টাকা, সপ্তম শ্রেণীর ১৬০ টাকা, অষ্টম শ্রেণীর ১৭০ টাকা, নবম ও দশম শ্রেণীর ১৮০ টাকা করে। ফরম ফিলাপ দুই হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া বিদায় অনুষ্ঠান ৫০০ টাকা, প্রস্তুতিমূলক মডেল টেস্ট বাবদ ৫০০ টাকা নেয়া হলেও এগুলো বাধ্যতামূলক নয় বলেও জানান বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন বাদল।
এ ছাড়াও নিকলী জিসি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬০০ শতাধিক। শিক্ষকের সংখ্যা ১৯ জন। খণ্ডকালীন শিক্ষকের সংখ্যা সাত। সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক পড়াচ্ছেন গণিত। এতে পাঠদানের প্রকৃত মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক বলছেন, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
নিকলী জিসি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রশিদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সমাজের শ্রেণী শিক্ষকও গণিত পড়াতে পারেন যদি অভিজ্ঞতা থাকে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.