নজরুল ইসলামঃ গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস অতিবাহিত হলো। বিশেষ দিবসে শিক্ষকদের প্রতি অনেককে ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তবে শিক্ষকদের প্রতি ভালোবাসা শুধু দিবসে নয় সারা জীবন থাকা উচিত। শিক্ষকরা যুগে যুগে এক একটি জাগরণকারী তৈরি করে, আর জাগরণকারীরা তৈরি করে এক একটি ইতিহাস। যেমনটি আল্লামা ইকবালের মতো দার্শনিক তৈরি করেছিলেন তার শিক্ষক মীর হাসান। আর আল্লামা ইকবাল তৈরি করেছিলেন নতুন চিন্তা, দর্শন ও মতাদর্শের বৃহৎ ইতিহাস।
শিক্ষকরা আমাদের মানসিকতা ও জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। জীবনকে সমৃদ্ধি ও উন্নত করতে পথ বাতলে দেয়। রঙিন ছায়ার পরিবর্তে পৃথিবীকে বাস্তব ছায়ায় দেখতে শেখায়। এসব গুণে গুণান্বিত আমারই এমন একজন শিক্ষক। তিনি শুধু আমাদের পাঠ্যপুস্তক শেখানোতে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, জীবনে চলার পথে কি প্রয়োজন তা যেন বাতলে দিতেন। তিনি শুধু আমাদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেনি, প্রচেষ্টায় ছিলেন জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে। তার শেখানোর প্রভাব আমার জীবনের প্রতিটি পদে পদে আমাকে বিস্মিত করে। রঙিন মোহে পড়ে কখনো কখনো জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে গেলেও তার অনুপ্রেরণাগুলো ছায়া হয়ে সাড়া দেয় প্রতিনিয়ত।
বয়স ২২-এর কাঠগড়ায়। স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখেছি। শিক্ষাজীবনের প্রায় ১৪ বছরে পদার্পণ করেছি। পরিচিত হয়েছি বহু প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে। এর মধ্যে ভুলে গিয়েছি অনেককে। তবে কিছু মানুষকে ভোলা অকল্পনীয়। জীবনের বিক্ষিপ্ত ঘটনাচক্রে তাদের ভুলে গেলেও সময়ে সময়ে সাড়া দিয়েছে তারা ছায়ার মতো। নানা পরিস্থিতিতে, নানা গতিবিধিতে কাটানো স্মৃতি ও উঞ্চ মুহূর্তগুলো কখনো-সখনো নাড়া দেয় বক্ষস্থলে। হৃদয়ের গহিনে গেঁথে আছে শিক্ষকদের প্রতি অপ্রকাশ্য এক আবেগ-ভালোবাসা, যা শুধু অনুভব করতে পারি। লিখে বা বলে প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সর্বোপরি তাদের যে অমলিন স্বভাব-চরিত্র, ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, উৎসাহ- উদ্দীপনা, আচার-আচারণ জীবন চলার পথে সফলতার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে।
তাদেরই একজন আমার প্রিয় শিক্ষক আলী স্যার। পড়াতেন বাংলা। এ বিষয় পড়ালেও দক্ষ ছিলেন অন্যান্য বিষয়েও। দীর্ঘ ১৪ বছরের এই ভ্রমণে সাক্ষাৎ পেয়েছি অনেকের। আদর-ভালোবাসা পেয়েছি অনেক শিক্ষকের। পড়েছি-শিখেছি অনেকের কাছ থেকে। তাদের এই ভালোবাসা ও বিসর্জনের মাত্রা নির্ণয় করা আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়। তবে প্রিয় আলী স্যারের ঠাঁই যেন হৃদয়ের মণিকোঠায় রাখতে আমাকে বাধ্য করে।
জীবনের ভ্রমণবৃত্তান্তে প্রতিটি চরণে গুটিকতক মানুষকে খুবই মনে পড়ে। তার মধ্যে তিনি একজন। যেদিন স্কুলে প্রথম ভর্তি হয়েছি সেদিনই প্রথম দেখা প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে। সেদিন স্যার আমার গালে একটি চিমটি দিয়ে বলল, কি বেটা ভর্তি হয়েছো? কোনো উত্তর দি নাই। পরক্ষণেই আবার বলল, পড়ালেখা শেখে অনেক বড় মানুষ হতে হবে। তখন সেটারও মানে বুঝি নাই। ভাবলাম, লম্বায় অনেক হতে হবে বুঝি।
এরপর প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা। দেখা হলেই গালে একটি মুখে মৃদু চিমটি দিয়ে বাবার মতো আদর দিয়ে বলতেন, কেমন আছত বেটা। বোধ হয় এটা আমার স্কুল গমনে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা একমাত্র উৎস ছিল। আমার মতো প্রতিটি শিক্ষার্থীকে তিনি এভাবে ভালোবাসার আদলে আবৃত করে রাখতেন।
তিনি শুধু একজন ভালো শিক্ষকই ছিলেন না ভালো অভিভাবকও বটে। অভিভাবকের মতো স্নেহের চাদরে আগলিয়ে রাখতেন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। অন্য শিক্ষকের ক্লাসে মনোযোগ না থাকলেও স্যারের ক্লাসে ঠিকই মনোযোগ থাকত। কারণ তিনি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিতে বলতেন না বরং তার গুণাবলি যেন আমাদের তার দিকে নিয়ে যেত।
শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ফলাফল যা-ই হোক তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মেধাবী বল সম্বোধন করতে ভুলতেন না। স্যারের কথা শুনে হয়তো আমার মতো অনেকের ভেতরে একটি উদ্দীপনা জন্মাতো যে আমিও একজন ভালো ছাত্র।
তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। জটিলতাকে খুব সরলে পরিণত করতে অনেক পটু ছিলেন। ক্লাসে একবার দুই ছাত্র মারামারিতে লিপ্ত হয়েছিল। বিষয়টি স্যারের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। স্যার ইচ্ছা করলে ওই ছাত্রদের বেত্রাঘাত বা কোনো শাস্তি দিতে পারতেন। তবে তিনি সেটা না করেই তার অতীত থেকে এক গল্প বলা শুরু করলেন। সেদিন তিনি তার গল্প দিয়ে তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিলেন। সেদিন প্রতিটা শিক্ষার্থী এ গল্প শুনে শান্ত ও হতভম্ব হয়ে গেল। আর ওই দুজন মিলে গেল ভালোবাসার বন্ধনে। সেদিনের শিক্ষাটি হয়তো কেউ গ্রহণ করেছে কেউ করেনি। তবে গল্পটি সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে।
এভাবে স্যার যেমন শিক্ষামূলক গল্প শোনাতেন তেমনি কিছু ভয়-অভয়ের গল্প বলতেও ভুলতেন না। যা শুনে শিক্ষার্থীরা স্যারকে প্রচন্ড রকমের ভয় পেত। শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল হিসেবে তিনি একটি বেত রাখতেন। যেটা দিয়ে তিনি মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের মৃদৃ আঘাত করতেন। তবে আঘাত পেয়ে কান্নার পরিবর্তে অনেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন।
স্যার যেমনটা ছিলেন অভিভাবকের ভূমিকায় তেমনিই ছিলেন সুপ্রিয় বন্ধুর মতো। প্রথম শ্রেণিতে থাকাকালে স্যারের বন্ধত্বপূর্ণ আচারণ সব সময় মুগ্ধ করত আমাকে। কেমন শিশু মনরঞ্জন মানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করতেন! সেটা আজ ভাবতেও বিস্ময় বোধ হয়।
স্কুল গ্রামের মধ্যে হওয়ায় দরিদ্র শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল বেশি। অনেকে পরীক্ষার ফি, স্কুলের বেতন প্রদান করতে বেগতিক অবস্থায় পড়ত। এ শিক্ষার্থীদের কাছে স্যার ছিলেন এক আস্থার প্রতিক। এমন অনেকেই ফি না দেওয়ায় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারছিল না, স্যার তার সাধ্যমতো তাদের সহযোগিতায় সব সময় লিপ্ত থাকতেন।
স্যারের প্রতি নিখুঁত ভালোবাসা ছিল প্রতিটা শিক্ষার্থীর মনে। যতটুকু মনে পড়ে যষ্ঠ শ্রেণির পর চিরচেনা শ্রেণিকক্ষে সাক্ষাৎ হয়নি প্রিয় স্যারের সঙ্গে। কয়েক শ শিক্ষার্থীকে কাঁদিয়ে অবসর নিলেন আমাদের থেকে। তবে সেই হৃদয়গাথা ভালোবাসা এখনো স্থির আছে প্রতিটা শিক্ষার্থীর বক্ষস্থলে। এখনো ব্যাচম্যাটদের সঙ্গে দেখা হলে স্যারের প্রসঙ্গটা আসেই। প্রত্যেকেই তার স্মৃতিকথা থেকে স্যারের কথা বলতেই থাকে। এভাবে স্যার চির উদ্যমে জায়গা করে নিয়েছে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মণিকোঠায়।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.