ঢাকাঃ তীব্র শিক্ষক সংকটে ধুকছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) । বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫টি বিভাগের একটিতেও নেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। প্রায় নয় হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাচ্ছেন মাত্র ১৬৫ জন শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমান প্রতি ৫২ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন একজন শিক্ষক। শিক্ষক অপ্রতুলতায় শিক্ষার গুণগতমান ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষক সংকটের এই দুর্দশার জন্য খোদ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কেই দুষছেন। কমিশন বলছে, সঠিক নিয়ম মেনে আবেদন না করাই শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি বিভাগের ৩০ জনের অধিক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিভাগের শিক্ষক ও ক্লাসরুম সংকটের কারণে নিয়মিত ক্লাস ও পাঠদান করাতে পারছেন না শিক্ষকরা। এতে করে ঠিক সময়ে ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষায় বসতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় শিক্ষকদের ব্যস্ততায় ক্লাস ঠিকমতো নিতে না পারায় সিলেবাস শেষ না করেই পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের।
ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ, কোনো কোনো শিক্ষক ব্যস্ততা দেখিয়ে সেমিস্টারে ক্লাস না নিয়েই টপিকস আর সিলেবাস ধরিয়ে দেন। এতে করে পরীক্ষায় ফলাফল আরও খারাপ হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ বলেন, “শিক্ষক সংকটের কারণে আমাদের সপ্তাহে ক্লাস হয় মাত্র এক থেকে দুই দিন। ক্লাস ঠিকমতো না হওয়ার কারণে আমরা এরই মধ্যে প্রায় সাত থেকে আট মাসের জটে রয়েছি। বিভাগে শিক্ষক সংখ্যা বেশি হলে এই সংকটে আমাদের পড়তে হতো না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন শিক্ষক নিয়োগ না হলেও প্রতিবছরই আসছে নতুন নতুন ব্যাচ। এতে শিক্ষক সংকট চরমে উঠেছে। একজন শিক্ষককে একটা সেমিস্টারে গড়ে ৮টিরও অধিক কোর্সের ক্লাস নিতে হয়। এর মধ্যে রিসার্সের শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদেরও আলাদাভাবে সময় দিতে হয়। একজন শিক্ষকের দ্বারা এতগুলো ক্লাস নেওয়া, খাতা মূল্যায়ন করা আবার নিজে বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তারপরও শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করছেন শিক্ষকরা। শিক্ষক সংকট দূর হলে শিক্ষার গুণগতমান আরও বাড়বে বলে আশাবাদী বিভাগগুলো।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাত্র তিন জন শিক্ষক দিয়ে চলছে ছয়টি ব্যাচ। এতে একজন শিক্ষককে গড়ে ৮টি করে কোর্সের ক্লাস নিতে হচ্ছে। একজন শিক্ষকের পক্ষে এতগুলো কোর্সের খাতা মূল্যয়ন করা ও ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব। এতে সেশনজটের ঝুঁকি বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। একই চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি ২৪টি বিভাগের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৬ জন। সবচেয়ে করুণ অবস্থা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের। বিভাগটিতে ১৪৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে মাত্র ৩ জন। গণিত বিভাগে ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর পাঠদান দিচ্ছেন ৭জন শিক্ষক, ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে ৩৫৯ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক রয়েছে ৫ জন। লোকপ্রশাসন ও অর্থনীতি বিভাগে প্রায় ৪২২ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ৭ জন এবং মার্কেটিং বিভাগে ৬ শিক্ষক দিয়েই ৫৫৮ শিক্ষার্থীর পাঠদান চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক ইমরান হোসেন বলেন, সাংবাদিকতা বিভাগটি ২০১৮ সালে চালু হয়েছে। বর্তমান বিভাগটিতে ছয়টি ব্যাচ চলমান। ইউজিসির ওয়ার্ক ক্যালকুলেশন নীতিমালা অনুযায়ী বিভাগটিতে বর্তমান ১০ জনের অধিক শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে বিভাগটিতে। এর মধ্য দুই জন শিক্ষাছুটিতে থাকায় মাত্র তিনজন শিক্ষককে দিয়ে চলছে বিভাগের ছয়টি ব্যাচ। এতে প্রতি সেমিস্টারে একজন শিক্ষককে গড়ে সাত থেকে ৮টি ক্লাস নিতে হচ্ছে। প্রায় এক বছর আগে ওয়ার্ক ক্যালকুলেশন নীতিমালা মেনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষক চেয়ে আবেদন করলেও এখনও শিক্ষক পাইনি আমরা। অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এই সংকট দূর করবেন বলে আশা করছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শিক্ষকের সংখ্যা ২১০ জন। এর মধ্যে ৪৫ জন শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে থাকায় মাত্র ১৬৫ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে ২৫টি বিভাগের পাঠদান। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানোগ্রামভুক্ত পদের সংখ্যা ৪৫৩টি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক ছাড়কৃত পদের সংখ্যা ২২৯টি। তথ্যঅনুযায়ী দেখা যায়, অর্গানোগ্রামভুক্ত অধ্যাপক পদের সংখ্যা ৪৮টি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক রয়েছেন মাত্র ২জন। এর মধ্যে ছুটিতে রয়েছেন ১জন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, শিক্ষক সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে এরই মধ্যে অবগত করে জনবল চাওয়া হয়েছে। আশা করি অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম এই বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করে বলেন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য লোড ক্যালকুলেশন নীতিমালা না মেনে আবেদন করায় এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারা প্রতিবারই একই ভুল করে। একাধিকবার সংশোধন করে দেওয়ার পর নীতিমালা মেনে যে বিভাগগুলো আবেদন করেছে সেগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কেন নেই এমন প্রশ্নে বলেন, আমাদেরও সংকট রয়েছে সরকার এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যা বাজেট দেয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সবদিক বিবেচনায় আমরা কাজ করে থাকি। আস্তে আস্তে এই সংকট নিরসন হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৬/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.