এম মিরাজ এইচঃ আমাদের দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করার প্রয়োজনীয়তার কথা দীর্ঘদিনের নানামুখী আলোচনার মাধ্যমে উঠে এসেছে বারবার; এক্ষেত্রে একটা যুতসই শিক্ষাক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এজন্য শিক্ষার আধুনিকায়ন ছাড়া উপায় নেই। তাই তো সামগ্রিক অগ্রগতি সাধনের নিমিত্তে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি চলমান শিক্ষাক্রম সংস্কারের এক বড়সড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে একটা যোগ্যতাসম্পন্ন জাতি গঠনের মানসে আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষাক্রমকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে; যেখানে তাত্ত্বিক জ্ঞানের চেয়ে প্রায়োগিক দক্ষতার উপরে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। সেই বিবেচনায় নতুন শিক্ষাক্রমকে সাধুবাদ জানানো সচেতন মহলের কর্তব্য।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটাই চরম সত্য যে, দেশের মূলধারার শিক্ষাক্রমকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হলেও সেই শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য যতটুকু অবকাঠামোগত এবং শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ দক্ষতার উন্নয়ন সর্বাগ্রে জরুরি সে রকম কোনো পরিবর্তন কার্যত হয়নি; যার ফলে সদ্য প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের প্রয়োগ অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পূর্বেই যে বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা বিধান করা অত্যন্ত প্রয়োজন সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো – প্রতি ক্লাসে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের সঠিক অনুপাত বজায় রাখা, যথোপযুক্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রতিটি শিক্ষককে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা, তত্ত্ব এবং তথ্যসমৃদ্ধ মানসম্মত স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস প্রণয়ন করা, যথাযথ মূল্যায়ননির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রাখা এবং আনুষঙ্গিক যাবতীয় সাপোর্ট সরবরাহ করা ইত্যাদি। উল্লিখিত প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক ঘাটতি নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের প্রথম বছর পার হতে চলেছে।
nagad
প্রত্যাশার সাথে বাস্তবের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত না হওয়ায় সম্প্রতি ওই শিক্ষাক্রম বাতিলের জন্য অভিভাবকদের একটা বড় অংশ আন্দোলনে নেমেছেন। যদিও বিগত শিক্ষাক্রমের আওতায় বছরের পর বছর ধরে এ প্লাস, গোল্ডেন এ প্লাস পাবার দৌড়ে শিক্ষার্থীরা এমনকি অভিভাবকগণ পর্যন্ত যখন অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতেন তখন অবশ্য সেটা নিয়ে কাউকে আন্দোলন করতে দেখা যায়নি। বরং কোথায় গেলে যে কোনো মূল্যেই সর্বোচ্চ গ্রেড পাওয়া যায় সেদিকেই তাঁদের ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়েছে। যা হোক, তাই বলে নতুন শিক্ষাক্রমের ত্রুটি নিয়ে তাঁদের যুক্তিগুলোকে একেবারেই অসাড় ভেবে অগ্রাহ্য করার আসলে কোনো উপায় নেই। তবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ওই নতুন শিক্ষাক্রমকে একেবারে বাতিল করার দাবিও কিন্তু একমাত্র সমাধান নয়। বরং সঙ্গত কারণেই সচেতন মহলের প্রস্তাবিত সংস্কারমূলক যৌক্তিক পয়েন্টগুলোকে আমলে নিয়ে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমের যথোপযুক্ত সংশোধন, সংযোজন এবং পরিমার্জন এখন অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা, বাস্তব প্রেক্ষাপটের সঙ্গে প্রায়োগিক বিষয়ের সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমেই কেবল প্রত্যাশিত ফল অর্জন সম্ভব।
প্রসঙ্গত বলা যায়, ২০০১ সালে দীর্ঘদিনের ডিভিশন পদ্ধতি বাতিল করে দেশে প্রথমবারের মতো যখন গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল পরীক্ষামূলক, সেই পদ্ধতিতে বেশকিছু অসংগতি ছিল; চতুর্থ বিষয় পাঠ্য হিসেবে থাকা সত্ত্বেও চূড়ান্ত ফলে সেটার নম্বর যোগ করা হয়নি সেবার। ওই বিষয়গুলোর ব্যাপারে যৌক্তিক সমালোচনা আমলে নিয়ে সেই সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রেডিং সিস্টেম পুনর্বিন্যাস করেছিলেন যা পরবর্তী বছর থেকে দীর্ঘদিন চালু ছিল।
সুতরাং বাস্তবতাকে আমলে নেওয়াই বিজ্ঞতার পরিচায়ক। সদ্য প্রবর্তিত বর্তমান শিক্ষাক্রম কম্পিটেন্সি বেইজ্ড হওয়ায় পড়াশোনা এবং প্রেজেন্টেশনের সাথে শিক্ষার্থীদের আরো বেশি সম্পৃক্ততা তৈরি হবার কথা। সেটা না হয়ে গুটিকয়েক অ্যাসাইনমেন্ট আর গ্রুপ এক্টিভিটিজের দোহাই দিয়ে শিক্ষার্থীরা যখন অনেকটাই টেকনোলজিক্যাল ডিভাইসনির্ভর হয়ে পড়ে তথা কার্যত পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন হবার উপক্রম হয় তখন সেটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চাপমুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীরা আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠবে– এই কথা বলে তাঁদের মূলত দক্ষতা বৃদ্ধির বদলে চরম অদক্ষ এবং অলসতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কিনা- সেটা ভাবতে হবে। পূর্বের শিক্ষাক্রমের পরীক্ষিত ফলপ্রসূ সিলেবাসের উল্লেখযোগ্য পাঠ্য নতুনের সঙ্গে পুনরায় সংযোজন করা দরকার। উল্লেখ করা যেতে পারে, শিক্ষাক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্যের দেশ সিঙ্গাপুরে কম্পিটেন্সি বেইজ্ড সিস্টেম চালু হয়েছে আরও আগেই; সেখানে কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনেক চাপের মধ্য দিয়েই পার করতে হয় শিক্ষাজীবন।
পূর্বের শিক্ষাক্রমেরও সমালোচনা ছিল, নামে সৃজনশীল হলেও মুখস্থনির্ভর প্রবণতা থেকে সিংহভাগ শিক্ষার্থীকে বেরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি সেখানে। সেই হিসেবে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালু করার আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। সুতরাং, নতুন শিক্ষাক্রমের বাতিল চাওয়া মানে আবার সেই পশ্চাদমুখী যাত্রার জন্য উঠেপড়ে লাগা! আবার শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সাথে সম্পৃক্ত গবেষক, যাঁদের মাধ্যমে সেটা আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবায়িত হবে সেসব শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সম্মিলিত প্রয়াসের উপরেই নির্ভর করছে নতুন এই শিক্ষাক্রমের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা। পরিতাপের বিষয় হলো, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নতুন এই Competency Based শিক্ষাক্রমের সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে অধিকাংশ শিক্ষকই যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন; যার ফলে তাঁরা এটাকে উপযোগী এবং ফলপ্রসূ হিসেবে এখনো উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলস্বরূপ, অনেক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মাঝে নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে এবং তীব্র অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। অথচ যেসব দেশ এ জাতীয় শিক্ষাক্রমের সফল প্রয়োগের মাধ্যমে এর সুফল ভোগ করছে সেসব দেশের শিক্ষকদের সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ওই শিক্ষকগণও অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করে থাকেন। নতুন শিক্ষাক্রমে গতানুগতিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির অনুপস্থিতিকে বড় ধরনের ত্রুটি হিসেবে দেখা হচ্ছে। পরীক্ষা না থাকায় পড়ার টেবিলমুখী হওয়ার বদলে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইলেকট্রনিক ডিভাইসনির্ভর হওয়ার প্রবণতা চরম আকার ধারণ করেছে। একই সাথে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটা বেশ ব্যয়বহুলও বটে। এহেন অবস্থাকে অগ্রাহ্য করা কিংবা উপেক্ষা করার আসলে কোনো উপায় নেই। কেননা, নতুন শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের জন্য যে রকম অবকাঠামো দরকার যেমন- প্রতি ক্লাসে নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী রাখা, প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য পর্যাপ্ত সময় বরাদ্দ রেখে তাঁদের উপস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি সেগুলো কিন্তু এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ, সার্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আগ পর্যন্ত কোনো একটা প্রকল্পের সর্বোচ্চ সুফল আশা করা অমূলক। একটা ক্লাসে ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে যদি একজন শিক্ষক থাকেন আর একটা ক্লাসের জন্য সময় যদি বরাদ্দ থাকে মাত্র ৩৫-৪০ মিনিট, তাহলে এত কম সময়ে এত শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতভাবে পূরণ করার ক্ষেত্রে ওই শিক্ষকের কীইবা করার থাকে! সেজন্যই, আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে পূর্বের শিক্ষাক্রমের সাথে নতুনের একটা সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে ভালো কিছু। মনে রাখা দরকার, যাঁরা নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট তাঁরাও কিন্তু অতীতে প্রচলিত শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করেই আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। অতীতের সেই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেও অনেকে দেশে এবং বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সুতরাং পুরাতন শিক্ষাক্রম একেবারেই অগ্রাহ্য করা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত নয়। সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি আগের পরীক্ষা পদ্ধতি পুনর্বহাল করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তাই অনেক বেশি জরুরি।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ মূল্যায়নের ভার শ্রেণি শিক্ষকের ওপর অর্পণ করায় অনেক অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁদের এই নাখোশ হওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণও আছে। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। বর্তমানে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন অনেকাংশে শ্রেণি শিক্ষকনির্ভর হওয়ায় একজন অভিভাবক আক্ষেপের সুরে নিচের ঘটনাটি শেয়ার করলেন কয়েকদিন আগে।
ভদ্রলোক তখন ক্লাস টেনের স্টুডেন্ট। তাদের স্কুলের সিনিয়র ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। ওই স্কুলের নামকরা (!) একজন শিক্ষক ক্লাসে আসলেন (সঙ্গত কারণেই ওই সম্মানিত শিক্ষকের নামটা উল্লেখ করা হলো না এখানে।) প্রথমে সেই শিক্ষককে কিছুটা বিমর্ষ মনে হলো। তা সত্ত্বেও তিনি নিজের সম্পর্কে আত্মপ্রশংসামূলক বেশকিছু কথা বললেন – পাঠদান শুরুর পূর্বে তিনি প্রতিনিয়তই নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ব্যাপারে সাফাই গাইতে ক্লাস টাইমের প্রায় অর্ধেক টাইম শেষ করে দেন। অতঃপর পাঠদান চলে কিছু সময়। এটাই ছিল ওই শিক্ষকের রুটিন ওয়ার্ক। তিনি নিজেকে এতটাই জাহির করতেন যে, তিনিই সেরা শিক্ষক। ক্লাসে পাঠদানের চেয়ে তার কাছে প্রাইভেট ব্যাচে পড়ার প্রতি প্রলুব্ধ করার চেষ্টা বেশি থাকত। যা হোক, সেই অভিভাবক যে ঘটনাটা সেদিন বললেন তা ছিল অনেকটা এ রকম– স্কুলের সুনামের জন্য ঘটনার নায়ক ওই শিক্ষক অনেক চেষ্টা-তদবির করেন। কিন্তু সেই সময়ে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপারে তিনি নাকি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। সেটা হলো– তখন এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে স্কুলের ফার্স্ট বয়কে তিনি একজন শিক্ষক হয়েও পরীক্ষার হলে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন [আরও স্পষ্ট করে বললে– একজন শিক্ষক (!) তাঁর স্কুল যাতে অত্র এলাকায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলে অন্য স্কুলের চেয়ে এগিয়ে থাকে সেই অভিপ্রায়ে পরীক্ষার হলে একজন শিক্ষার্থীর হাতে নকল তুলে দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি; এমনকি পরবর্তীতে সেটা ফলাও করে বলতেও লজ্জাবোধ করেননি! যা হোক, যদিও সেই ফার্স্ট বয় কখনোই ওই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট ব্যাচে পড়েনি। তবুও শুধু স্কুলের সুনামের কথা চিন্তা করে তিনি তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন! অথচ সেই স্টুডেন্ট তাঁর সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে এক ধরনের অপমান নাকি করেছেন তাঁকে। সেই শিক্ষক এটাও বললেন– ওই ছেলে পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। অথচ পরবর্তীতে দেখা গেল– ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বরাবরই ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হওয়া সেই মেধাবী শিক্ষার্থী সেবার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট যখন প্রকাশ হয়েছিল তখন স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছিল।
উপরোক্ত ঘটনার উল্লেখ করে কোনো একজন শিক্ষককে হেয় করার বিন্দুমাত্র উদ্দেশ্য আমার নেই। কারণ, আমি নিজেও একজন শিক্ষক। তাই শিক্ষক সমাজের অংশ হিসেবে এই জাতীয় শিক্ষকদের প্রতি ধিক্কার জানাতে আমি কখনো দ্বিধা করি না। এরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এদের সংখ্যা নেহায়েত কমও নয়। কেন আমি উপরোক্ত ঘটনার উল্লেখ করলাম সেটা একটু সচেতনভাবে চিন্তা করলেই যে-কেউ বুঝতে পারবে। সামষ্টিক মূল্যায়নের নামে শিক্ষকের হাতে যদি ত্রিভুজ, বৃত্ত আর চতুর্ভুজ দেওয়ার ক্ষমতা অর্পণ করা হয় তাহলে ফল কী যে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। ওই শিক্ষকের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারুক আর না পারুক সবাইকে ছুটতে হবে তাঁর প্রাইভেট ব্যাচে পড়ার জন্য। যারা যেতে পারবে না তাদের কপালে দেখা দেবে শনির দশা। সঙ্গত কারণেই এটা নিয়ে অনেক অভিভাবক অনেক বেশি শঙ্কিত। তা ছাড়া মূল্যায়ন চিহ্নভিত্তিক হওয়ায় প্রতিটি শিক্ষার্থীর বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী যথেষ্ট সুবিচার হওয়ার ব্যাপারটা প্রশ্নবিদ্ধ থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
অপরদিকে পূর্বোক্ত শিক্ষাক্রম আসলে কতটা সুফল বয়ে আনতে পেরেছে সেটাও কিন্তু আমরা কমবেশি প্রায় সবাই জানি এবং সেটার অসারতা নিয়ে সমালোচনা করতে আমরা মোটেও পিছপা হইনি। কেননা, কিছু টেক্সট মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরায়ে দেওয়ার ফল তো আমরা জানি। ব্যবহারিক জীবনে কতটুকুইবা কাজে দিত আমাদের সেই অনেকাংশেই মুখস্থনির্ভর পড়াশোনা! ফলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত প্রতিবছর লাখ লাখ বেকার তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। কেননা, সর্বোচ্চ শিক্ষালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি গ্রহণ করার পরেও একটা বড় অংশ জব মার্কেটে তাদের দক্ষতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ, চাকরির বাজার মন্দা হওয়া সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠান এবং কোম্পানি উপযুক্ত কিংবা যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পায় না যথাস্থানে কাজ সমাধা করার জন্য ।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান কম্পিটেন্সি বেজড শিক্ষাব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এখন প্রশ্ন, এটার বাস্তবায়ন নিয়ে। ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রাক্কালে তদানীন্তন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর কবীর চৌধুরীর একটা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম নয়াপল্টনে তার বাসভবনে। তাঁর ভাষ্যমতে, বহুজনের মতামত সংগ্রহের মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল সেই শিক্ষানীতি। ওই শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতায় আমি তাকে নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি অনেক আশার কথা শুনিয়েছিলেন বটে কিন্তু যাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে তাঁদের পুরোপুরি তৈরি করতে না পারার কারণে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকটাই অধরা থেকে গেছে ।
অন্যান্য অনেক কিছু বাস্তবায়নের বেলায় যে চিত্র দেখা যায়, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তার খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- প্রবাদের মতোই নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট ব্যাচে পড়ানো যাবে না কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থীর বেশি পড়ানো যাবে না বলে আইনত যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটা কি আদৌ বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা- সেই তদারকি তো অনুপস্থিত প্রায় শুরু থেকেই। সুতরাং নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অতীতের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তনের প্রাক্কালে তদানীন্তন শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর কবীর চৌধুরী একান্ত সাক্ষাৎকারে শিক্ষানীতির দিক তুলে ধরেছিলেন এম মিরাজ এইচের কাছে ।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিগত শিক্ষাক্রমের আওতায় মাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত এনসিটিবি কর্তৃক ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের জন্য যে গ্রামার বইগুলো প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের হাতে সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে তুলে দেওয়া হতো দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ওই বইগুলোর পাঠদান উপেক্ষিতই থেকেছে। তাহলে এত খরচ করে সরকারের এই বইগুলো দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। তবে বইগুলো যে যথেষ্ট ভালো আমার পর্যালোচনায় সেটা স্পষ্ট। এখন তো আবার নতুন শিক্ষাক্রমে দেখলাম আগের সেই দ্বিতীয়পত্র বইগুলো একেবারে বাদই দেওয়া হয়েছে। অথচ আমার মনে হয়, ওই ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের বইগুলোর উপযোগিতা সামান্যও হ্রাস পায়নি। তাই নতুন শিক্ষাক্রমেও ওই বইগুলো অন্তর্ভুক্ত করে সরবরাহের ব্যবস্থা করা সমীচীন মনে করি। অন্যান্য বিষয়ের বেলায়ও এমন কথা প্রযোজ্য। পাশাপাশি সেগুলোর পাঠদান যথাযথভাবে হচ্ছে কিনা সেটার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কার্যকর তদারকি জরুরি। কেননা, যত ভালো পরিকল্পনাই হোক না কেন, সেটার বাস্তবায়ন যদি নিশ্চিত করা না হয় কিংবা সঠিকভাবে সমন্বয় করা না যায় তাহলে তার সুফল থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পরিশেষে বলতে চাই, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের উত্তরাধিকারী প্রজন্ম নৈতিক গুণাবলি এবং মার্জিত রুচি বোধসম্পন্ন, সুশিক্ষিত, বিবেকবান, নম্র-ভদ্র একেকজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক। মৌলিক জ্ঞান আহরণ এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনপূর্বক পর্যাপ্ত কনফিডেন্স নিয়ে পেশাজীবনে প্রবেশ করুক। সর্বোপরি পরিবার, সমাজ এবং দেশের প্রতি দায়িত্বশীল ও পরোপকারী একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। এতদুদ্দেশ্যে হার্ডলাইন পরিহারপূর্বক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভিন্ন মতের প্রতি গুরুত্ব আরোপ এবং যে কোনো ত্রুটির গঠনমূলক সমালোচনা ইতিবাচকভাবে আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাক– এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৬/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.