এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষক কেন অবহেলার পাত্র

ঢাকাঃ শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়; বরং এটি একটি জীবনব্রতের নামও। আমাদের সমাজে বহুল ব্যবহৃত একটি কথা হলো, ‘মা–বাবা সন্তানকে জন্ম দিলেও তাদের “মানুষ” হিসেবে গড়ার কারিগর শিক্ষকেরাই।’ একজন শিক্ষার্থীর মননের দ্বিতীয় জন্ম শিক্ষাগুরুর কাছে। শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা, ব্যক্তিত্বের জাগরণ, মেধার উৎকর্ষ সাধন করে তাদের জীবন আলোকিত করে তোলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। আলোকিত এবং মানবিক সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি ও দক্ষ কারিগর তিনি। একজন শিক্ষকের ছাত্র-ছাত্রীরাই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্বপ্নের বীজ বুনে দেন একজন শিক্ষক। তাই আমাদের সমাজে শিক্ষকদের স্থান অনেক উঁচুতে। শিক্ষক যেখানেই যান, সেখানেই তিনি সম্মানের আসনে অলংকৃত হয়ে থাকেন।

কিন্তু বর্তমান অস্থির সময়ে বাস্তবতা অনেকটা পাল্টে গেছে। আমাদের সমাজে ধরেছে ক্ষমতার পচন। ইদানীং সব ঘটনা ছাপিয়ে একটি বিষয় প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে পাই, দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকেরা কমিটির সদস্যদের হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে, এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতেও নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

এটা কেমন কথা? একজন শিক্ষক, তা তিনি যেকোনো পর্যায়ের হোন, যেকোনো বিষয়ের হোন, তিনি শিক্ষকই। তাঁর শরীরে মানুষ কীভাবে আঘাত করে? আর রাষ্ট্র ও সমাজ সেসব নিয়ে আবার রাজনীতি করে! বিচার না করে কালক্ষেপণ করে! শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করাই ছিল যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার কথা তো তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে আমাদের সমাজ আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

শিক্ষকদেরও মনে রাখতে হবে, আমরা শিক্ষকেরা নিজেদের শিক্ষার্থীদের কাছে যতটা প্রাঞ্জল ও হাসিখুশি মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারব, তাদের কাছ থেকে তার চেয়েও বেশি হাসিখুশি প্রফুল্ল মন আমরা দেখতে পাব। শিক্ষাদানপ্রক্রিয়া সব সময়ই অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। যখন পরীক্ষার আগে অস্থিরতা কাজ করে, তখন চিন্তা ভুলে হাসতে পারার কৌশলটাও শেখাতে হবে তাদের। তাহলে পরিবেশ হালকা হবে, যা শিখন-শেখানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছে কারাগারের মতো মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে কথা বলতে পারে না, আনন্দ করতে পারে না। কঠিন শাসন, পান থেকে চুন খসলে ধমক, তিরস্কার, লজ্জা দেওয়া ও শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়। আবার কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা শোনে না, শিক্ষার্থীরা যা ইচ্ছা তা–ই করে। শিক্ষকদের প্রতি কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করে না। এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে খুব হালকাভাবে দেখে। এ রকম পরিস্থিতি কিন্তু চরম ক্ষতিকর। এ অবস্থা যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজ করে, সেখানে পড়াশোনা হয় না, শিখন-শেখানোর পরিবেশ থাকে না।

আমাদের সংসদে অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা হয়, একজন শিক্ষক হিসেবে আমার অনুরোধ, একটি আইন যাতে পাস করা হয়, কোনো পর্যায়ের কোনো শিক্ষককে কেউ যেন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে না পারেন, কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে না পারেন, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ এসব করার চেষ্টাও করেন, সেটি হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সব কিছুর আগে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সমাজ ও পারিবারিকভাবে শিশুদের নৈতিক এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে। তা না হলে সমাজে যেভাবে পচন ধরেছে, তাতে এ সমাজ টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই পচন দূর করতে হলে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষকতা একটি জীবনদর্শনের পাশাপাশি এটি জীবন নির্বাহের একটি মাধ্যম। শিক্ষককে এই পেশা থেকে উপার্জিত আয় দ্বারা তাঁর নিজের এবং পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে হয়। শিক্ষকের আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টি নিশ্চিত করলে, প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য এমনিতেই বন্ধ হবে। ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের শিক্ষকসমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। একটি দেশের শিক্ষকের মর্যাদা বাড়লে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান যেমন বাড়ে, আবার ঠিক একইভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়লেও তা শিক্ষকের মর্যাদাকে বাড়ায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আগে শিক্ষকের মর্যাদা বাড়াবে, নাকি শিক্ষক আগে গুণগত মানের শিক্ষাদান করবেন, সেটি নিয়ে তর্ক করলে তা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো অমীমাংসিত রয়ে যাবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিকস অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ এবং ভারকি ফাউন্ডেশনের ‘গ্লোবাল টিচার্স স্ট্যাটাস ইনডেক্স-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে গড়ে মাত্র ৩৬ শতাংশ ছাত্র–ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে। অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের সম্মান করে না। এই ভয়াবহ অবস্থা দূরীকরণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক জাগরণের পাশাপাশি শিক্ষকদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। তাঁদের নিজ দায়িত্বের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত পাঠদান, শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণাবলিতে গড়ে তোলা, কর্মক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মনোভাব পোষণ না করা, সততা বজায় রাখাসহ বিভিন্ন ইতিবাচক কার্যক্রম দ্বারা নিজেদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও রেষারেষির অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষকদের পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্য দ্বন্দ্বও তাঁদের প্রতি শিক্ষার্থীদের বীতশ্রদ্ধ করে তোলে।

শিক্ষকদের মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক দিকটি নিশ্চিত করলে এ পেশায় সর্বোচ্চ মেধাবীদের আগ্রহ তৈরি হবে। যারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং নিজ বিষয়ে দক্ষ। প্রতিবছর ৫ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস’ আসে। আড়ম্বরের সঙ্গে তা পালিত হয়। শিক্ষার্থীরা তাদের অতি প্রিয় শিক্ষকদের ফুল, কার্ড, চিঠিসহ বিভিন্ন উপহার দিয়ে ভালোবাসা জানায়। শিক্ষকেরাও স্নেহে সিক্ত করেন শিক্ষার্থীদের। এ আন্তরিকতা আর ভালোবাসা যেন সারা বছরই থাকে।

আমি একজন শিক্ষক। আমাকে শিক্ষক হওয়ার, সৎ হওয়ার, আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন আমার শিক্ষকেরা। আমার শিক্ষকেরা শুধু আমার শিক্ষক নন, আমার জীবনের সবচেয়ে শ্রদ্ধার ও আস্থার মানুষ তাঁরা। আমি আমার শিক্ষকদের যে কী পরিমাণ ভালোবাসি, তা আমি কোনো দিনও পৃথিবীর কোনো ভাষায় লিখে প্রকাশ করতে পারব না৷ আমার মননের শক্তি ও সাহস তাঁরা। আমি আমার শিক্ষকদের থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি ও পাচ্ছি প্রতিনিয়ত, তারও ঋণ শোধ করা অসম্ভব। শিক্ষকেরা যেমন ভালোবাসবেন, তেমনি সঙ্গে শাসন করে আমাকে সঠিক পথে আনার অধিকারও তাঁদের আছে, বিষয়টি আজীবন মনে রেখেছি। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরও মনে রাখা উচিত বলে মনে করি।

শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার যুগলবন্দীতে আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠুক আবার আলোকিত ও মুখর। লাইব্রেরিতে থাকুক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণ। শ্রেণিকক্ষে থাকুক শিক্ষকের নির্ভয় কণ্ঠধ্বনি। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তার্জাতিক সাফল্য অর্জন করুক আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দেশের জন্য বয়ে আনুক গর্ব। এটা আমার স্বপ্ন, আমাদের সকলের স্বপ্ন।

লেখকঃ নুর আহমেদ সিদ্দিকী

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৩/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.