শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। প্রতিষ্ঠার আট বছর পেরোলেও সরকারি মেডিকেল কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদা অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। হাসপাতাল ভবনেই চলছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম। এমনকি শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে হাসপাতালের ভেতরেই। হাসপাতালে রোগীদের ওয়ার্ড ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল। আলাদা ও পরিপূর্ণ অবকাঠামো না থাকায় একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার অভিযোগ তুলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে চিকিৎসাশিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টিকে দেখছেন এখান থেকে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হওয়ার পথে বড় অন্তরায় হিসেবে।
কলেজ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে মেডিকেল কলেজটি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ৫০ জন শিক্ষার্থীকে এমবিবিএস ডিগ্রিতে ভর্তির মাধ্যমে শুরু হয় কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমানে এখানে প্রতি শিক্ষাবর্ষে ৭৫ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তিনটি ব্যাচ ডিগ্রি নিয়ে বের হয়েছে। পাঁচটি ব্যাচে অধ্যয়নরত সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী। শিক্ষক আছেন ১৭৮ জন।
কার্যক্রম চালু রাখতে এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে এখন নির্ভর করতে হচ্ছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের ওপরেই। সরজমিনে দেখা যায়, ১৩ তলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন অংশে চলছে কলেজের কার্যক্রম। আবার কলেজে ফরেনসিক বিভাগ থাকলেও কোনো মর্গ নেই। এতে ময়নাতদন্ত বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দ্বিতীয় তলায় স্থাপন করা হয়েছে কলেজের প্রশাসনিক কার্যালয়। এখানে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষের কার্যালয়, কলেজের অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যালয় রয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় বিভিন্ন বিভাগ, শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষকদের কেবিন, পরীক্ষাগার, ক্যান্টিন ও লেকচার থিয়েটার। নিজস্ব ভবন না হওয়ায় লেকচার থিয়েটারের আধুনিকায়ন সম্ভব হয়নি। মূল ভবনের বিভিন্ন তলায় করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা।
হাসপাতাল ভবনের তৃতীয় তলায় ডেঙ্গু ওয়ার্ড ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হোস্টেল। আটটি কক্ষে ইন্টার্ন শিক্ষার্থীরা থাকছেন। পঞ্চম তলায় সাতটি কক্ষে ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করা রয়েছে। এসব কক্ষে অন্তত ৭০ শিক্ষার্থী থাকছেন বলে জানা যায়। আর ১৩ তলায় রয়েছে ছাত্রীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘তৃতীয়, পঞ্চম ও ১৩ তলায় কেবিন ব্লকে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলেজের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের পুরোটাই হাসপাতাল ভবনে চলছে। কলেজের নিজস্ব কিছুই নেই। ৫০০ শয্যার হাসপাতালে কয়েক গুণ বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা হাসপাতাল ভবনে।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকায় তাদের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। একটি মেডিকেল কলেজের অত্যাবশ্যকীয় সাধারণ সুবিধাও এখানে অনুপস্থিত। একমাত্র গ্রন্থাগারটিও হাসপাতাল ভবনের ভেতরে অবস্থিত। সংকট রয়েছে চিকিৎসাশিক্ষার মৌলিক বইয়েরও। স্বতন্ত্রভাবে পরিপূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় যেসব শিক্ষার্থী বাইরে থাকছেন তাদের ব্যয় করতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।
যদিও কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, অবকাঠামো না থাকার পরও হাসপাতাল ভবনেই শিক্ষার সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে সুপরিসর লেকচার গ্যালারি, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, উচ্চগতির ইন্টারনেটসমৃদ্ধ ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, সব বিভাগের জন্য পৃথক পরীক্ষাগার ও টিউটোরিয়াল রুম। সহশিক্ষা কার্যক্রমও রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানে।
হাসপাতাল ভবনে কলেজের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে চলমান রয়েছে উল্লেখ করে উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এহসানুল হক খান জানান, কলেজের নিজস্ব অবকাঠামোর জন্য ৬০০ কোটি টাকার বেশি একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উপস্থাপনের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে কলেজ ভবন, চিকিৎসক ডরমিটরি, নার্সিং ভবন, স্টার্ফ কোয়ার্টার, ছাত্রাবাস, মাঠ, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হোস্টেলসহ বিভিন্ন অবকাঠোম রয়েছে। কলেজ ও হাসপাতালের জন্য জমি রয়েছে ১০ দশমিক ২ একর। একনেকে ওই প্রকল্প অনুমোদন হলে কয়েক বছরের মধ্যে অবকাঠামোসহ যেসব সংকট রয়েছে তা পূরণ হয়ে যাবে।
অধ্যক্ষ ডা. মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ বলতে যে শুধু ভবন তা নয়। অনেক কিছুই প্রয়োজন। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তবে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে না। প্রকল্প অনুমোদন হলে কয়েক বছরের মধ্যে সব সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।’
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. টিটো মিঞা কয়েক বছর আগে ওই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গুরুত্ব দিয়েছি বলেই কলেজের অবকাঠামো নিয়ে ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য বেশকিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। এর আগেও কয়েকবার ডিপিপি প্রস্তুত করা হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের থাকার বন্দোবস্ত নেই, একাডেমিক ভবন নেই। কলেজের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠমো তৈরি করতে পারলে আমরা ঢাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়াতে পারব। শিক্ষার মানও বাড়বে। আগে বিভিন্ন কারণে এ কার্যক্রম মন্থর হয়েছিল। করোনাও একটি বড় কারণ। করোনা ও বর্তমানে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় হাসপাতালটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমি যখন অধ্যক্ষ ছিলাম তখনো ডিপিপি নিয়ে কাজ করা হয়েছিল। কলেজটিতে মর্গ নেই। আধুনিক মর্গ করার জন্য আলাদাভাবে একটি প্রকল্প তৈরি হবে।’
বর্তমানে দেশের চিকিৎসাশিক্ষা মানসম্মত নয় বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি বলেন, ‘মেডিকেল কলেজ তৈরির মূল উদ্দেশ্য চিকিৎসাসেবার মান ভালো করা এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক মানসম্পন্ন চিকিৎসক তৈরি করা। এর জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ কোনো কলেজের নেই। যারাই এ নিয়মের বাইরে যাবে তারাই অন্যায় করবে। এতে বিএমডিসি তাদের ডিরিকগনাইজ করতে পারে। বিএমডিসি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করল কিনা তাও দেখতে হবে। সার্বিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার পরিবেশ ভালো হতে হবে। চিকিৎসাশিক্ষায় রোগী, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হলো মূল বিষয়। শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য ওই কলেজের হাসপাতালে পর্যাপ্ত রোগী রয়েছে তা ইতিবাচক। শিক্ষক সংখ্যাও সন্তোষজনক। তবে দেখতে হবে তাদের মধ্যে কতজন শিক্ষক পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী। শিক্ষা উপকরণের মধ্যে পরীক্ষাগার, গ্রান্থাগার, মর্গ লাগবে। এগুলো মৌলিক বিষয়। শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক লাগবে। লাইব্রেরিতে থাকতে হবে সর্বশেষ সংস্করণের সব বিষয়ের বই। ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য মেডিকেল এডুকেশন ইউনিট থাকতে হবে।’
তার মতে, হাসপাতাল ভবনের মধ্যে কোনোক্রমেই শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা রাখা যাবে না। এতে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার মান সন্তোষজনক নয়। আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। শিক্ষকস্বল্পতা, শিক্ষা উপকরণের ঘাটতি, প্রশিক্ষণের মান ভালো না থাকার কারণে দেশের চিকিৎসাশিক্ষার উন্নতি হচ্ছে না।
এদিকে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২ কার্যকর করে সরকার। আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত) অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে সরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র আইন ও নীতিমালা নেই। তবে বেসরকারির ওই আইন অনুযায়ী সরকারি কলেজগুলোর চলা উচিত। কেননা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের জন্য আইনে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে সরকারি মেডিকেল কলেজ এগিয়ে রয়েছে। সরকার যেসব ক্ষেত্রে বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে শর্ত মানতে বাধ্য করছে সেগুলো সরকারি মেডিকেল কলেজেরও মান্য করা উচিত।
স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ বলছে, বর্তমানে দেশে সরকারি ৩৭টি, বেসরকারি ৭২টি (ছয়টির অনুমোদন বাতিল করে ৬৬টি) ও সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় প্রতি শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির জন্য ৪ হাজার ৩৫০টি ও বেসরকারিতে ৬ হাজার ২০৮টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষকের পদ রয়েছে ৫ হাজার ৬৬৮টি। এর মধ্যে ফাঁকা রয়েছে ২ হাজার ৫৪৪টি। সে অনুযায়ী সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় মোট পদের বিপরীতে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সূত্রঃ বণিক বার্তা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.