আল আমিন হোসেন মৃধা, শিক্ষাবার্তা ঢাকাঃ রাজধানীর সায়দাবাদের আর কে চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের প্রশাসনিক অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় এমপিও বাতিল/স্থগিত করার নির্দেশনার এক মাস পার হলেও কোন ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ০৫ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা বিষয়ক শাখা থেকে উপসচিব আবু সাঈদ মোঃ ফজলে এলাহী স্বাক্ষরিত এক চিঠি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)কে নির্দেশ ক্রমে অনুরোধ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্তে ৩০টি প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডিআইএর দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে ৪৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিলে গত ০৫ মার্চ ২০২৩, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের শৃঙ্খলা বিষয়ক শাখা থেকে আর কে চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ ইসতারুল হক মোল্লা এবং উপাধ্যক্ষ রায়হানুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
মাউশি বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জনবল কাঠামো ও এম.পি.ও নীতিমালা-২০২১ এর ১৮.১ (ক) অনুযায়ী এম.পি.ও.ভুক্তির শর্ত ভঙ্গ হওয়ার কারণে এম.পি.ও.স্থগিত/বাতিল করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
এছাড়া একই তারিখে দুইটি পৃথক চিঠিতে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং গভনিং বডির সভাপতির মাধ্যমে আত্মসাতকৃত অর্থ আদায়সহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতীয় বিস্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার কে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিবকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়।
গত ৫, মার্চ ২০২৩ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুনির্ষ্ট নির্দেশনা থাকলেও কেন ঐ দুই শিক্ষকের এমপিও বাতিল এবং পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখার (কলেজ-৩) সহকারি পরিচালক তপন কুমার দাস শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আর কে চৌধুরী কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের বিষয়ের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে কাজ চলমান রয়েছে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখার (কলেজ-২) উপ পরিচালক মোঃ এনামুল হক হাওলাদার শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, ফাইলটা চলমান আছে। কবে নাগাদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে সুপারিশ বাস্তবায়িত হতে পারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, অনেক সময় ডিজি স্যার মিটিং ব্যস্ত থাকেন এই সামন্য একটু লেট হতে পারে। তবে মন্ত্রণালয়ের যে কোন চিঠিই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই এই চিঠিটাও আমরা গুরুত্বসহকারে দেখছি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে জ্যেষ্ঠতা অনুসারে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. রায়হানুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকেন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রায়হানুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ফেরত না দেওয়া, জীববিদ্যা বিভাগের প্রদর্শক শিক্ষক মোস্তাফ সিরা রোজদিকে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে ও নিয়োগবোর্ড গঠন ছাড়াই অবৈধ নিয়োগ দিয়ে এমপিও পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগসহ বিভিন্ন আর্থিক ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এত অনিয়মের পরও ২০০৮ সালে পুনরায় রায়হানুল ইসলামকে উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং একই সময় একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাভার কলেজের তৎকালীন প্রভাষক মো. ইসতারুল হক মোল্লাকে বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত বিধি উপেক্ষা করে অবৈধভাবে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও কতিপয় শিক্ষক নানা প্রশাসনিক অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ বিষয়ে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে এসব অনিয়মের চিত্র ধরা পড়ে। ইসতারুল হক মোল্লার শিক্ষাগত যোগ্যতা ১৫ বছরের বেশি থাকলেও উপাধ্যক্ষ/সহকারী অধ্যাপক/উচ্চ মাধ্যমিক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই অধ্যক্ষ হিসেবে তার নিয়োগ যথাযথ হয়নি বলে তদন্তে প্রমাণ মেলে। নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র তদন্ত কমিটির কাছে সরবরাহ করেনি ইসতারুল হক মোল্লা।উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলামের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে জীববিদ্যা বিভাগের প্রদর্শক শিক্ষক মোস্তাফ সিরা রোজদিকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অবৈধ নিয়োগ প্রমাণিত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সমুদয় অর্থ ফেরত প্রদানের সুপারিশ করা হয়। মোস্তাফ সিরা রোজদিকে অবৈধভাবে প্রদর্শক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিধি লঙ্ঘন করে নিবন্ধনহীন শিক্ষককেও ফুল টাইম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটি বলছে, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার পরও কোনো ব্যক্তিকে শর্তাধীনে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্যানেল তৈরি বা নিয়োগ দেওয়া বিধির পরিপন্থি। ব্যারিস্টার সফিক আহম্মেদ-মাহফুজা খানম বৃত্তির ১ লাখ টাকার এফডিআরে অনিয়ম করা হয়। বই কেনার জন্য অনুদানের ১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে। শিক্ষক কল্যাণ তহবিলের ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করা হয়। তদন্তে আরো জানা গেছে, কলেজের পাঁচটি অনার্স বিভাগে শিক্ষা সফর করা হবে এমন কথা বলে কলেজের তহবিল থেকে টাকা তোলা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে শিক্ষাসফর হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা সফর না করেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন ৪ কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও ২০১৯ সালে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ প্রতি মাসে ৭৬ হাজার টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে জরাজীর্ণ বাস। এ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ আর্থিক দুর্নীতি করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।কলেজের নামে চারটি এফডিআর থাকলেও তিনটি এফডিআর অনিয়মিতভাবে ভাঙানো হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। গভর্নিং বডি সভা, শিক্ষক সভা, কল্যাণ তহবিলের সভা, নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন আপ্যায়নের নামে সাড়ে চার কর্ম বছরে ৮ লাখ টাকার বেশি আপ্যায়ন ব্যয় দেখিয়েছেন অধ্যক্ষ। তদন্ত কমিটি বলছেন এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে পিপিআর, পিপিএ-এর কোনো ধারা মানা হয়নি। এক্ষেত্রে ভুয়া ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হবে—এ কারণে টেন্ডারবিহীন উন্নয়ন কাজের পাশাপশি ফার্নিচার কেনায় অনিয়ম হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ বিষয়ে উপাধ্যক্ষ রায়হানুল ইসলাম জানান, তিনি তদন্ত রিপোর্টের বিষয় শুনেছেন তবে, এখনো কপি পাননি। যেহেতু অধ্যক্ষ দেশের বাইরে আছেন, তাই তার অনুপস্থিতিতে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে নারাজ।
আরও পড়ুনঃ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ৩০ অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে!
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৩/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.