আপনার শৈশব কেমন কেটেছে?
আমার জন্ম ১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ, ঢাকায়। মা নওশাবা খাতুন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) অধ্যাপক। বাবা শামসুল হুদা চৌধুরী ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। আমি নানা-নানির কাছে মানুষ। নানা ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বাসায় সব সময় পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা হতো। সব সময় মনে করতাম, জীবনে শিক্ষাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে আমি সবার ছোট। তাই সবার আদর পেতাম। খেলাধুলা করেছি। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়েছি। এরপর আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ম্যাট্রিক এবং হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। ১৯৭০ সালে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিক্যুলার বায়োলজি বিভাগে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর লিভারপুলে চলে যাই পিএইচডি করতে।
লিভারপুলে কেমন ছিলেন?
আমি আমার স্বামী অধ্যাপক সাইয়াদ সালেহীন কাদরীর সঙ্গে চার বছর ছিলাম। দিনগুলো ভালোই কেটেছে। অনেক কিছু শিখেছি। তার মধ্যে একটি—রাতের খাবারটা তাড়াতাড়ি খেতে হবে। এখনো আমার সেই অভ্যাসটি রয়েছে। লিভারপুলে থাকাকালে দেশকে সব সময় মিস করতাম। সেখানে আমার পিএইচডির বিষয় ছিল প্রোটিন ও ইমিউনোলজি, বিশেষ করে প্রোটিনের স্ট্রাকচার এবং কিভাবে পিউরিফাই করা হয়—এসব নিয়ে কাজ করেছি। ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। আমি শিক্ষার্থী থাকাকালে বিখ্যাত অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী আমাদের মাইক্রোবায়োলজি পড়াতেন। বিদেশ থেকে আসার পর দেখি, তিনি মাইক্রোয়োলজি ডিপার্টমেন্ট খুলেছেন। তিনি আমাকে বললেন, ‘এখানেও তুমি পড়াবে।’ আমি ওখানেও পড়াতাম।
ছোটবেলায় কী স্বপ্ন দেখতেন?
ছোটবেলা থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিল কিছু একটা করার। নানা-নানি মানুষ করেছেন। আমাকে মেয়ে বলে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি। এ কারণে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুরু থেকেই গবেষণার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। ১৯৮৬ সালে আইসিডিডিআরবিতে (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ বাংলাদেশ) যোগ দিই পোস্ট ডকের জন্য। তারপর যে ল্যাবে জয়েন করি, কালের পরিক্রমায় সেই ল্যাবের হেড হয়ে থেকে গেলাম।
তখন আইসিডিডিআরবির অবস্থা কেমন ছিল?
তখন এর পরিসর ছোট ছিল। ল্যাব, লোকজনও অনেক কম ছিল। তখনো এখানে উন্নত মানের কাজ হতো, এখনো হচ্ছে। আগে ছোট ছোট ইউনিট ছিল। এখন পাঁচটা ডিভিশন। অনেক কোলাবরেশন। আমরা যে জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করি—যন্ত্রপাতি, রি-এজেন্ট—এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি। আমি আইসিডিডিআরবির কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। যে কাজটি এখানে করতে পারি, এটা এই পরিবেশের কারণেই পারি। গবেষণা করতে হলে শতভাগ মনোযোগ দিতে হয়। সব কিছু প্রস্তুত থাকতে হয়। বিদেশে যাঁরা উন্নত মানের গবেষণা করছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। এর পাশাপাশি আমি এখনো শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। এখনো বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডজাংক্ট প্রফেসর হিসেবে পড়াই। তবে আমার কাছে গবেষণার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
কলেরার ভ্যাকসিন নিয়ে ২৫-২৬ বছর ধরে কাজ করছেন…
আইসিডিডিআরবিতে প্রথম এলাম, এটা তো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরি। আমি এখানে এসেছিলাম কলেরার ওপর রিসার্চ করতে। এত এত রোগী—কী করে আমরা একটা ভালো সমাধান পাই কলেরা প্রতিরোধ করার জন্য? এটা ছিল ভাবনায়। তখন কিন্তু আমাদের একটা ওরাল স্যালাইন তৈরি হয়েছিল। ওরাল স্যালাইন দিয়েই মানুষ সুস্থ হয়ে যায়, এটা তো একটা মিরাকল, তাই না? একটা সময় পর্যন্ত মানুষ মনে করত, কলেরার চিকিৎসায় আর কোনো গবেষণার দরকার নেই; স্যালাইনই যথেষ্ট। আমি যখন কোনো প্রপোজাল লিখতাম কলেরার ওপর, বলত, ‘নো নো, দিস ইজ নট ইমপর্ট্যান্ট।’ কারো এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না। আমি তখন অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম; যেমন—রক্ত আমাশয়। আমাদের কাজ কিন্তু সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। তখন চেষ্টা করতাম, কিভাবে আবার এই লাইনে আসতে পারব, আইসিডিডিআরবিকে কিভাবে ইমপ্রেস করব, ফান্ডিং এজেন্সিকে কিভাবে বোঝাতে পারব। ১৯৯০ সালে কলেরার নতুন একটি জীবাণু ‘ভিবরিও কলেরা ও১৩৯’ বের হলো। কেউ বুঝতেও পারেনি—হঠাৎ করে এটা কী হলো। এটাই আমাকে কলেরার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ১৯৯০-৯১ সালে অনেক কাজ করলাম। গভীরভাবে চিন্তা করলাম। ল্যাব থেকে এই জীবাণুটি নিয়ে আমিই সেটির মনোক্লোনাল রেসপন্স অ্যান্টিবডি তৈরি করলাম। তখন ‘কলেরা ও১৩৯’-এর ভ্যাকসিন ছিল না। কেউ যদি এই জীবাণুতে আক্রান্ত হয়, তার শরীরে কী প্রতিক্রিয়া হবে, কেউ জানত না। তখন আমার কাজের ক্ষেত্রই পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি এটা নিয়ে প্রচুর কাজ করলাম।
এই কাজে বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা?
‘কলেরা ও১৩৯’ আসার আগে একসময় ধরেই নিয়েছিলাম, আইসিডিডিআরবিতে আর বেশিদিন কাজ করব না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব ছিল। সেটি নিয়েও ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কলেরা নিয়ে আবার গবেষণার সুযোগ পেয়ে আমার সেই মনোভাবে পরিবর্তন এলো। ‘বিভালেন্ট কলেরা ভ্যাকসিন ও১৩৯’-এর প্রটোটাইপ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করলাম। একসময় প্রকাশ করলাম গবেষণাপত্র। পরবর্তীকালে মিরপুরের বিভিন্ন বস্তিতে বড় ধরনের স্টাডি করেছি কলেরা ভ্যাকসিন নিয়ে। প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে বিভালেন্ট ০১/ও১৩৯ ভ্যাকসিন নিয়ে অনেক কাজ করেছি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক মিলিয়ন কলেরা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। আইসিডিডিআরবিতে আসা কলেরা রোগীদের দেখলেই বোঝা যেত, তাদের আবাসস্থলের পানি ও স্যানিটেশনব্যবস্থা কেমন। তারা যেখানে থাকে, সেখানে ঘনবসতি। চার-পাঁচজন করে প্রতি রুমে থাকে। ওই অবস্থায় পরিষ্কার থাকাটা কষ্টকর। তাদের খাওয়ার পানিও দূষিত। ওই রকম পরিবেশে থেকে তাদের কলেরা হয়। এক রুমে চারজন বাসিন্দা থাকলে একজনের যদি কলেরা হয়, তাহলে অন্যদেরও হতে পারে। রোগটি এভাবে ছড়াতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভালো জায়গায় রাখা, পরিষ্কার পানি দেওয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব না। আমরা শুধু কলেরা প্রতিরোধের চেষ্টা করতে পারি। ভ্যাকসিন দিয়ে সেটা করা সম্ভব।
এ জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন?
আমরা বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে কলেরা নিয়ন্ত্রণের একটা পরিকল্পনা করেছি। প্রথমে বেছে নিয়েছি ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো। এরপর চট্টগ্রামে, তারপর নারায়ণগঞ্জে যাব। ধীরে ধীরে সারা দেশে কাজ করব।
কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন?
যখন কেউ গবেষণা করে, তখন সবাই সব কিছু বুঝতে পারে না। আমি যদি বলি ভ্যাকসিন দিয়ে, প্রতিষেধক দিয়ে রোগ প্রতিরোধ করব, তখন অন্য কেউ হয়তো বলবে, এসবের কোনো দরকার নেই! প্রথম দিকে এ ধরনের অনেক চ্যালেঞ্জের, অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। ওয়াটার স্যানিটেশন হাইজিন দিয়েও তো আমরা কলেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু ওয়াটার স্যানিটেশন হাইজিন অনেক ব্যয়বহুল। আমাদের মতে, শর্ট টার্ম প্ল্যান হচ্ছে, ভ্যাকসিন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ, জীবাণু ছড়ানোর কারণ—এসব সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে আমাদের অন্য বিজ্ঞানীদের এবং সরকারকে বোঝাতে হয়।
ইটিইসি, রোটা ভাইরাস নিয়েও কাজ করেছেন…
ইটিইসি (এন্টারোটক্সিজেনিক এসচেরিচিয়া কলিঃ) ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে অনেক কাজ করেছি। এখনো করছি। এসংক্রান্ত অনেক ইটিইসি পাবলিকেশনও প্রকাশ করেছি। আমরা যে কাজ করছি এবং যে পর্যায়ে গেছি, কলেরা ভ্যাকসিন ও টাইফয়েড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আনতে পারব বলে বিশ্বাস করি। এখন যে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছি, সেটা অনেক উন্নত মানের—টাইফয়েড কনজুগেড ভ্যাকসিন। আগের ভ্যাকসিনটি বাচ্চাদের ওপর কাজ করত না। এখনকারটা এক ডোজ দিলে দীর্ঘদিন সুরক্ষা পাওয়া যাবে। আমরা এটা নিয়ে কাজ করলেও এখনো বাংলাদেশে ভ্যাকসিনটা তৈরি হয়নি। তবে মিরপুরের ২, ৩ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ব্যাপক স্টাডি করছি।
ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনে ডিরেক্টর হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা?
জনবল ও ফান্ড মিলিয়ে এটিই আইসিডিডিআরবির সবচেয়ে বড় ডিভিশন। ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত আমি এর সিনিয়র ডিরেক্টর ছিলাম। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করি, আবার জীবাণু নিয়েও কাজ করি। আমাদের যে তিনটি প্রগ্রাম আছে, সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করার চিন্তা করছি। আমাদের আটজন বড় বিজ্ঞানী আছেন, তাঁদের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করেছি, টিবির কাজটা কিভাবে সরকারের সঙ্গে এগিয়ে নেব, দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে চিন্তা করব। আমার নিজের বিভাগে আমরা তো ডায়রিয়া, টাইফয়েড ও অন্যান্য ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করি। রেসপিরেটরি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি আমরা। এখন জীবনঘাতী হয়ে যাচ্ছে রেসপিরেটরি ডিজিজ। আমাদের অনেক তরুণ বিজ্ঞানী আছেন। তাঁদের উৎসাহিত করার জন্য ইয়াং সায়েন্টিস্ট ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (ওয়াইএসডিআই) পরিচালনা করেছি। সেটার নেতৃত্বে ছিলাম আমি। আমরা আইসিডিডিআরবির সব ডিভিশনের তুখোড় গবেষকদের নিয়ে আলোচনা করেছি।
ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ (আইদেশি) আপনার ফাউন্ডেশন। এটার কাজ কী?
২০১২ সালে যখন ফ্রেঞ্চ একাডেমিক সায়েন্সের গ্র্যান্ড প্রাইজ পেলাম, সেটির প্রাইজ মানি ছিল পাঁচ লাখ ইউরো। আমি আবার সায়েন্স, হেলথ পছন্দ করি। তখন পুরো টাকাটা বিনিয়োগ করলাম। দেশে এমন একটা কাজ করার ইচ্ছা ছিল আমার, যেটা কেউ করে না। জন্মগত রোগ বা জেনেটিক ডিস-অর্ডার নিয়ে জন্মানো বাচ্চাদের রোগ নির্ণয়ের কাজ। ঠিক করলাম, আমরা এখানে জনবল তৈরি করব, আমাদের যেসব গবেষক বিদেশ থেকে ফেরত আসতে চান, তাঁদের একটা প্ল্যাটফর্ম দেব এবং যাঁরা পিএইচডি করতে চান, তাঁদের সুযোগ দেব। ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভ (আইদেশি) ফাউন্ডেশনটির যাত্রা শুরু ২০১৪ সালে। আমাদের বড় একটা বোর্ড রয়েছে। আইদেশির আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যাঁদের বিশেষ অবদান রয়েছে, তাঁদের অন্যতম হলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান, অপরজন হলেন সদ্যঃপ্রয়াত অধ্যাপক নইম চৌধুরী। আমি তাঁদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। আইদেশি থেকে ১০টি পেপার প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে এমন সব রোগ নিয়ে কাজ করেছি, যেটা বাংলাদেশে এত দ্রুত আর সুন্দরভাবে করা সম্ভব—কেউ ভাবেনি। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে অনেক কাজ করি। এটা আমাদের অন্যতম বড় জেনেটিক ডিস-অর্ডার। অন্যদিকে জন্মের সময় অনেক বাচ্চার মধ্যে জিন ডিফেক্ট থাকে। এ জন্য তারা দুধের একটা অ্যামাইনো এসিডকে ভাঙতে পারে না। এর ফলে দেহে ওটা কালেক্ট হওয়ার পর ব্রেনে যায়। তখন মেন্টাল রিটারডেশন হয়। কিন্তু এটা ডিটেকশনের কোনো ক্ষমতা ছিল না বাংলাদেশে। আমরা সেটা করেছি। এটা কোনো নতুন আবিষ্কার নয়; তবু বাংলাদেশে এটাকে এস্টাবলিশ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দামই তিন-চার কোটি টাকা। আরেকটা হচ্ছে হান্টিংটন ডিজিজ। পরিবার থেকেই রোগটি পায় শিশুরা। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাত-পা নাড়ানো বন্ধ হয় না। বাংলাদেশ থেকে এই রোগ নিয়ে আমরাই প্রথম রিপোর্ট করেছি। একদিন আমাদের একজন পিএইচডি স্টুডেন্ট বলল, তার গ্রামে এ রকম একটা অসুখ আছে। তারপর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এবং আইদেশিতে অনেক জেনেটিক টেস্ট করে আমরা রোগটি শনাক্ত করেছিলাম। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
উপমহাদেশে সম্ভবত আপনিই ফ্রেঞ্চ একাডেমিক সায়েন্সের গ্র্যান্ড প্রাইজ পাওয়া প্রথম নারী…
হ্যাঁ, এই প্রাইজটি খুবই মর্যাদাপূর্ণ। আমি যা যা কাজ করেছি, তার ভিত্তিতেই পেয়েছি এই সম্মান। ওদের ই-মেইল পেয়ে অবশ্য ভেবেছিলাম, এমনি এসেছে! অনেক সময় লটারিতে অনেক টাকা পুরস্কার জেতার কথা বলে না প্রতারকরা, তেমনই হয়তো! কিন্তু পরে আবার মেইল করে নিশ্চিত হলাম। কখনো ভাবিনি এ রকম একটা পুরস্কার পাব। অবশ্য আমি কখনো পুরস্কারের পেছনে ঘুরিনি। এমনিতেই বাংলাদেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। অনেক পুরস্কার পেয়েছি। এর মধ্যে ২০১২ সালে আইসিডিডিআরবির ‘শ্রেষ্ঠ নারী কর্মকর্তা’ হয়েছি। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের গোল্ড মেডেলও পেয়েছি।
২০১৪ সালে জাতিসংঘের টেকনোলজি ব্যাংকের প্যানেল মেম্বার ছিলেন…
সেখানে কাজ করার সুবাদে তখনকার মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গেও কথা বলতে গেছি। নিউ ইয়র্ক, ইস্তাম্বুলেও অনেক মিটিং হয়েছে। আমরা যে টার্ম পেপার তৈরি করেছি, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন এক্সপার্ট লোক ছিলেন। বাংলাদেশের একজন সদস্য আছেন। এদিকে আমি ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গেও জড়িত। বাংলাদেশ আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিস্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমি। আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজির বাংলাদেশ অ্যাম্বাসাডর ছিলাম। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো হয়েছি।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
তিনটি অসুখ বাংলাদেশ থেকে দূর করে যেতে চাই—কলেরা, টাইফয়েড, রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া। পৃথিবীর ৪৭টি দেশে কলেরা আছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশে কলেরা রোগীর হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনব। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। এটা করতে আমাদের শুধু ভ্যাকসিন দিলে হবে না; স্বাস্থ্য, হাইজিন—সব কিছুর দিকেই খেয়াল রাখব। আমরা বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের ডেভেলপমেন্ট করব। অন্যদিকে আমি এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চাই, যেন ছেলে-মেয়েরা বিদেশে না গিয়ে দেশে থেকেই কাজ করতে পারে।
আমাদের গবেষণা বা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার কারণ কী?
একটি মেয়ে কিন্তু পড়াশোনা করে একটি ছেলের মতোই। মেধায়ও অনেক ভালো; কিন্তু একটি জায়গায় এসে সে থেমে যায়। সংসারজীবনে পা রাখার পর তার সামনে একটা বাধা আসে। আবার সে নিজেও এটার জন্য দায়ী। সে ভাবে—কী করে বাচ্চা রেখে পড়াশোনা করব? তখন সে নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করতে পারে না। অন্যদিকে আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য সুযোগও তুলনামূলক কম। একটি মেয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করবে—এটা সবাই অ্যাকসেপ্ট করে না। এসব কারণে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শিক্ষকতা ছাড়া অন্যান্য শাখায় মেয়েদের আগ্রহ কম। তবে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
ব্যক্তিগত জীবন?
বিয়ে করেছি ১৯৭৬ সালে। স্বামী সাইয়াদ সালেহীন কাদরীও বায়োকেমিস্ট্রির মানুষ। আমাদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। এক ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন ব্যাংকার। মেয়ে ডাক্তার। সংসারজীবনে আমার স্বামী ও পুরো পরিবারের যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি। শাশুড়ি, ননদ—তাঁরা পড়াশোনাকে সম্মান করতেন। আমি এখানে সারা দিন কাজ করে বাসায় ফিরতাম। সন্তানরাও সাপোর্টিভ ছিল।
এখন দিনের শুরু হয় কিভাবে?
সকালে উঠে অনেকক্ষণ হাঁটি, নয়তো ইয়োগা করি। তারপর অফিসে আসি। মিটিং থাকলে বাইরে যাই। সারা দিনই অনেক কাজ আর মিটিং করি। গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকি। আমার গ্রুপটা ৫০০ জনের। তাদের পরিচালনা করি।
দীর্ঘ কর্মজীবনে পেছন ফিরে তাকালে কোন অভিজ্ঞতাটা বলতে ইচ্ছা করে?
গবেষণা করে যা কিছু পেয়েছি, ভালো লেগেছে। আমার ডিপার্টমেন্টটিও ভালো কাজ করছে। কলেরা ও টাইফয়েড নিয়ে এখনো কাজ করছি। এই রোগগুলো কেন হলো, আমি সেটা জানতে চাই। সব সময় চাই আরো উন্নত মানের টেকনিক, উন্নত মানের কাজ করতে। প্রতিটি সাফল্যের পেছনে বাধা ছিল। আমি একটি বাধা পেলে আরেকবার চেষ্টা করি। তখনো না পারলে নিজেকে সরিয়ে নিই। বুঝে যাই, এটা আমার কাজ নয়। আমার পাবলিকেশনের সংখ্যা ৩৬০-এর বেশি। ওগুলোর জন্য বেশ ভালো সাড়া পাই।
অবসর কাটে কিভাবে?
গাছ খুব পছন্দ করি। আমার বাড়িতে নানা প্রজাতির অনেক গাছ আছে। সময় পেলেই সেগুলোর পরিচর্যা করি। সন্তানরা বিদেশে থাকে। অবসরে ওদের সঙ্গে কথা বলি। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে সময় কাটাই।
শ্রুতলিখন : জুবায়ের আহম্মেদ
(মহাখালী, ঢাকা; ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯)সুত্র কালের কন্ঠ
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.