মোঃ হেদায়েত উল্যাহ সবুজ।।
স¤প্রতি পত্র-পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের আরও অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য পিএসসি’র আদলে কমিশন গঠিত হচ্ছে। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকসহ সকল স্তরের শিক্ষক নিয়োগ দিবে এই প্রতিষ্ঠান। এনটিআরসি থেকে আরও শক্তিশালী হবে এই কমিশন। একই সাথে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিতেও আসছে পরিবর্তন।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিষদের একছত্র আধিপত্য খর্ব করার বিষয়েও নতুন নীতিমালা হচ্ছে। শিক্ষকদের অযথা হয়রানী বন্ধ, যখন তখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সাময়িক বরখাস্ত, বেতন বন্ধ, সাময়িক বরখাস্তের ক্ষেত্রে মাউশির অনুমতি দেয়া প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। শুধু পরিচালনা পরিষদের উপর ছেড়ে না দিয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি তদারকি বৃদ্ধি করা হবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা বোর্ডের জন্য নতুন খসড়া আইন প্রস্তুত হয়েছে। একই সাথে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলীর নীতিমালা নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা চলছে। প‚র্বের ধারাবাহিকতায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে এ ক্ষেত্রে দু’একটি বিষয় নিয়ে কিছু লিখার আগ্রহ ছিল।
বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমান সরকারের অনেক উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয়ভাবে মেধাক্রম অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া অবশ্য একটি সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সা¤প্রতিক সময়ের সারা দেশের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এর ঘোষণা মতে শিক্ষক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবী ও প্রত্যাশা অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য মেধাভিত্তিক ও উপযুক্ত শিক্ষক নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারি কর্ম কমিশনের অনুরূপ একটি বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শুনা যাচ্ছে। এটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা রাখবে। ভবিষ্যতে কমিশন হলে লিখিত পরীক্ষার সাথে একাডেমিক ফলাফলের গুরুত্ব দিয়ে মেধাক্রম তৈরির বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে তাতে মেধাক্রম আরও যথার্থ হবে।
এন্টি লেভেলে সকল পদে সরকারীভাবে শিক্ষক নিয়োগের কথা থাকলেও নন-এমপিও পদে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেরা নিয়োগ দিচ্ছে ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগ্য প্রাথী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে যা মোটেও কাম্য নয়। তাই এ বিষয়টিও বাস্তবায়ন গুরুত্বপ‚র্ণ। প‚র্বে শুধু এন্টি লেভেলে শিক্ষক নিয়োগ দিত এনটিআরসি। কিন্তু কমিশন হলে প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ সকল পদে কমিশন নিয়োগ দিবে। এট্ িবেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করবে। কেননা কমিশনের নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী ও যোগ্যদেরই নিয়োগ দিবে বলে শিক্ষক সমাজ আশাবাদী। বর্তমান ব্যবস্থায় স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এনটিআরসি’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হলেও প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহকারি প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে একই ভাবে স্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বিভিন্ন তদবিত, অর্থ আর ক্ষমতার জোরে অনেকক্ষেত্রে অযোগ্যতারাই এই পদগুলো দখল করছে। ফলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।
প্রতিষ্ঠান প্রধানরা দীর্ঘ দিন সহকারী প্রধানের পদ শ‚ন্য রেখে এ পদে নিয়োগের লোভ দেখিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করার ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষকদের ব্যবহার করেন যা প্রতিষ্ঠানের ভ্রাতৃত্বপ‚র্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করে। অনেক ক্ষেত্রে যারা শিক্ষকতার পেশাকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে পছন্দ করে এ পেশায় আসে তারা অযোগ্য বসের কারণে তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা ধরে রাখতে পারে না।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে পরিষদ যেমন শক্তিশালী তেমনি হেড মাস্টার ও অধ্যক্ষরাও অনেক ফাওয়ারফুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তাদের পরিচিত ও তাদের অনুকুলে পরিচালনা পরিষদের সদস্য নির্বাচন করে থাকেন যারা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী বান্ধন না হয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান বান্ধন হয়ে উঠেন যা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নকে বিঘ্নিত করে থাকে। অধ্যক্ষ কিংবা প্রধান শিক্ষকরা তাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের দিয়ে এমনভাবে পরিচালনা পরিষদের সদস্য নির্বাচন করেন যারা কখনো তাদের বিরোধিতা করবে না বরং সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। অনেকর কাছে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার মান উন্নয়নের চাইতে প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন গুরুত্বপ‚র্ণ হয়ে উঠে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত ও নীতিবান কোন সদস্য থাকলেও তিনি নীরব ভ‚মিকা পালনই পছন্দ করেন। সেই সুবিধার কারণে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে উঠেন অসীম ক্ষমতাধর।
তাই তিনি যতই অনিময় করবেন কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। তার কোন অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির খবর কেউ জানবে না। সভাপতির কান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তা মাঠে মারা যাবে। আর যদিও পৌঁছে তাহলে পরিষদের অন্য সদস্যরা তো পক্ষে রয়েছে সব ম্যানেজ হয়ে যাবে।
প্রচলিত ব্যবস্থায় পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের নাম প্রতিষ্ঠান প্রধানরাই প্রস্তাব করেন। ভোটের মাধ্যমে শিক্ষক প্রতিনিধি কিংবা অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনের বিধান থাকলেও তা বাস্তবে হয় না। হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা চল-চাতুরি ও কলা কৌশলে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তাদের পক্ষে নিয়ে আসেন। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রধান সৎ ও নীতিবান তারা হয়তো এ সব নিয়ে মাথা ঘামান না। এ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সঠিক প্রক্রিয়ায় তা হচ্ছে কিনা তা যথাযথ তদারকির ব্যবস্থা করা জরুরী। অন্যান্য ক্যাটাগরির সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রস্তাবের বিষয়টি বাদ দিয়ে নতুন প্রক্রিয়ার স‚চনা করা প্রয়োজন। পরিচালনা পরিষদের সদস্য হতে হলে উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে বলে বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে অশিক্ষিতরাই নাকি শিক্ষকদের উপর বেশি খবরদারী করে। বিষয়টি নিয়ে মতানৈক্য নেই। কিন্তু শুধু শিক্ষিতদের দিয়েই পরিচালনা পরিষদ গঠন করলে উদ্দেশ্য হাসিল হবে বলে মনে হয় না যতক্ষণ না সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিবর্তন করা হবে।
বদলীর ক্ষেত্রে কিভাবে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করা হবে সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে আমার ধারণা। ধরা যাক কেউ একজন ঢাকার একটি ভালো মানের বেসরকারি কলেজে কর্মরত। তিনি সাধারণত বাহিরের কোন কলেজে যেতে চাইবেন না কারণ তিনি সেই কলেজেই নিয়োগ পেয়েছেন। আবার তার কলেজে অন্য কলেজ থেকে কেউ বদলি হয়ে আসলে এমপিও সিনিয়ারিটির কারণে তিনি হয়ত তার সিনিয়র হয়ে যেতে পারেন। অনুপাত প্রথার কারণে তার পরিবর্তে বদলি হয়ে যিনি আসবেন তিনি হয়তো পদন্নোতির যোগ্য হয়ে যাবেন। পদন্নোতির সিরিয়ালে থাকলেও তিনি নিজ কলেজে বঞ্চিত হবেন। চাকুরীর ক্ষেত্রে তিনি পদের চাইতে প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এক্ষেত্রে এনটিআরসিএ নিয়োগপ্রাপ্তদের থেকে এটি চালু করা গেলে হয়তো এ সমস্যা হবে না। আবার সব বেসরকারি কলেজে কলেজ ফান্ড থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সমান নয়। কলেজের সামর্থ্যের উপর তা নির্ভর করে। এসিআর তৈরির ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
জ্ঞানীরা বলে থাকেন একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয় বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষে। যথাযথ শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির শিখরে উঠতে পারে না কেননা শিক্ষাই জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির ম‚ল চালিকা শক্তি। অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় শিক্ষা ক্ষেত্রে যে বাংলাদেশের অর্জন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কারো দ্বিমত থাকার কথা না। শিক্ষার হার যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। একইভাবে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রথাগত ও ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্ততে আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক ধ্যানধারণা গড়ে উঠছে। নারী শিক্ষার অগ্রগতি যে কোন দেশের অর্জনকে ছাড়িয়ে গেছে বহু আগে। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির ম‚ল চালিকা শক্তি যে শিক্ষক সমাজ তা জোর দিয়ে বলা যায়।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যমান অসঙ্গতি ও সমস্যা দ‚র করে চলমান সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের চলমান উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে আরও গতিশীল করতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা দেশের নব্বই ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। এই বিবেচনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ম‚ল চালিকা শক্তি। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের যথাযথ উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বর্তমানে দায়িত্বে আছেন এমন দু,জন ক্লিন ইমেজের ব্যক্তি যারা সৎ, মেধাবী ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ। যৌক্তিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে তাদের আন্তরিক ও সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকতর উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। আগামীর বাংলাদেশ গঠনে ম‚ল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে বলে বিশ্বাস।
লেখকঃ বেসরকারি কলেজ শিক্ষক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.