কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম।।
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হয় সারাবছরব্যাপি।কিন্ডারগার্টেনভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইয়ের আধিক্যের কারণে সেখানে পরীক্ষার চাপ আরও বেশি।মোটামুটি পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীরা একপ্রকার পিষ্টই বলা যায়! নানা কোচিংয়েতো পরীক্ষার বিকল্প ভাবাই যায়না। ছাত্রজীবনের সকল সুখকর মুহূর্ত গুলো এই একটি শব্দ শোনার পর বিষাদে ভরে উঠে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পরীক্ষা পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছে প্রাচীন চীনে।চীনে সর্বপ্রথম Standardized Test বা সার্বভৌম পরীক্ষার প্রচলন করা হয়। এই পরীক্ষার ছিল মূলত একটি বাছাই পরীক্ষা। যার মাধ্যমে সরকারি চাকরির জন্য যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করা হত। এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয় ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে।পরবর্তীতে ইংল্যান্ড শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতির সংযোজন করে। এইভাবে আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে দেশে গ্রহনযোগ্যতাও পেতে থাকে। বিশ্বব্যাপী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়।
পরীক্ষার সাথে এখন অনেক কিছু জড়িত। রুটিন, গ্রেড, জিপিএ কিংবা ফলাফল সবকিছুই পরীক্ষার সাথে সম্পর্কিত। তাই এই বিষয়গুলো কে আরো সহজ করতে দিন দিন নতুন নতুন পরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা হচ্ছে। যেমন আগে পরীক্ষা মানেই ছিল বড় বড় করে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেকটা রচনার মত। এর পরে শুরু হল Multiple Choice Question(MCQ) পদ্ধতি। যেখানে শুধু টিক দেওয়া লাগে বা বৃত্ত পূরণ করা লাগে। বিজ্ঞান শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে যেটি সবচেয়ে মজার পরীক্ষা সেটি হল ব্যবহারিক পরীক্ষা বা প্র্যাকটিকেল পরীক্ষা। যেখানে সবকিছু হাতে কলমে করতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এখন পরীক্ষা অনেকক্ষেত্রে কম্পিউটার নির্ভর হয়ে গেছে।
মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। কে কত ভাল করে ক্লাস করেছে, কতটা মনোযোগ সহকারে ক্লাসে শিক্ষকের কথা শুনেছে, কার মেধা কতটুকু এসব আর কি। এসব মূল্যায়নের গ্রহণযোগন্য পদ্ধতি হলো মার্কস প্রদান।
যে যত বেশী নম্বর পায় সে তত ভাল ছাত্র বলে বিবেচিত হয়। নম্বর কম হলে সে খারাপ ছাত্র। পরীক্ষায় ফেল করলে তো কথাই নেই। মানে পরীক্ষা মানেই পাশ আর ফেল। এত এত পাশ ফেলের চাপ সামলাতে না পেরে প্রতি বছরই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বের হবার পর অভিমানে বা লজ্জায় আত্মহত্যার মত বেদনাদায়ক সংবাদ শুনতে হয়।
দেশে এখন যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তা হলো পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা।এই পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতামত প্রদান করা হয়েছে।
অনেক অভিভাবকের কাছেই এখন পিএসসি ও জেএসসি অল্প ব্যবধানে দুটি পাবলিক পরীক্ষা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সেই শিশু শ্রেণী থেকে ভর্তি হয়েই অবুঝ ছেলেমেয়েগুলো অল্প অল্প করে পরীক্ষা বিষয়টা যখন স্বল্প পরিসরে বুঝতে আরম্ভ করে তখনই এদের পাবলিক পরীক্ষার মত বড় আসরে বসতে হয়। তাদের মাথায় ঢুকে যায় ভাল ফলাফলের স্বপ্ন।
অনেক সময় নিজের দক্ষতার সাথে অভিভাবকের চাহিদা না মেলায় সন্তান মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়। কেননা বেশীরভাগ অভিভাবকই চায় সন্তানের খুব ভাল রেজাল্ট।
নিজের স্কুলে পরীক্ষা থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেই তাদের পাবলিক পরীক্ষার বিশাল এক কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে হয়। এর সাথে আছে এ প্লাস পাওয়ার চাপ। আমি জানি অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে ঐ শব্দটাই বেশী আশা করে। এমনিতে নিজ স্কুলের বাইরে,নিজ শিক্ষকদের সাথে না থেকে একটা নতুন পরিবেশে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার চাপ তারপর আবার অভিভাবকদের ভাল ফলাফল করার বাধ্যবাধকতা।অবশ্য দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো থেকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রেখে ক্লাস মূল্যায়নের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে যা আগামী বছর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।ইতিমধ্যে হাইস্কুলগুলোতে বছরে তিনটি পরীক্ষার স্থলে দুটি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।কমানো হয়েছে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যাও।
মেধা হলো নিয়মিত চর্চার বিষয়। কিন্তু পরীক্ষা থেকে যে ভীতির জন্ম নেয় সেই ভীতি কাটতে কাটতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
শিক্ষার্থীর অগ্রগতি মূল্যায়ন করার জন্য অবশ্যই পরীক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু সেটা এত ঘনঘন বা অল্প সময়ের ব্যবধানে না হওয়া উত্তম বলে মনে করি।পরীক্ষা সংখ্যা কমিয়ে বছরে নূন্যতম দুটি যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। তবে এর যদি কোন বিকল্প পদ্ধতি বের করা যায় তাহলেও হয়। অন্তত আমাদের সন্তানদের পরীক্ষা ভীতি থেকে মুক্ত করা জরুরি।ওরা যেন পরীক্ষা দিতে কোন ভয় না পায়। শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রমের একটি অপরিহার্য অংশ হলো পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোভাব অব্যশই ইতিবাচক হতে হবে। ইতিবাচক মনোভাব ছাড়া পরীক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.