মাসুমা রুমা।।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক শিক্ষা বলতে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনকে বুঝে থাকেন। অথচ জীবন বাস্তবতা, নানামুখী অভিজ্ঞতা, দাম্পত্য জীবনের সম্ভাব্য সমস্যা আর সমাধানমূলক শিক্ষাও যে পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে তা অনেকেই মানতে নারাজ। যার নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক!
মানবজীবনের প্রাথমিক শিক্ষাগুলো স্বভাবতই পরিবার থেকে অর্জন করার কথা। কিন্তু বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে শতকরা কতজন মানুষ পরিবার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে থাকেন? সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের চারপাশের মানুষ, পরিবারগুলো খেয়াল করলেই এ প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক শিক্ষা বলতে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনকে বুঝে থাকেন। অথচ জীবন বাস্তবতা, নানামুখী অভিজ্ঞতা, দাম্পত্য জীবনের সম্ভাব্য সমস্যা আর সমাধানমূলক শিক্ষাও যে পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে তা অনেকেই মানতে নারাজ।
যার নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক! অনেকেই হয়তো বলবেন- এগুলোও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যেই পড়ে। আমাদের সমাজে নামাজ আর আরবিতে কোরআন শিক্ষা ছাড়া সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা খুব একটা দেয়া হয় বলে আমার জানা নেই। যথাযথভাবে বাংলা অর্থসহ কোরআন শিক্ষা এবং সহিহ হাদিস চর্চা করানো হলে সেখানে গোঁড়ামি, অসচেতনা, বিশৃঙ্খলতার জায়গা কমে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে সন্তানকে এসব শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি পিতামাতা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও তা অর্জন করতে হবে। অন্যথায় বিশৃঙ্খলতা ও গোঁড়ামির অবসান ঘটবে না। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত লেগেই থাকবে। মূলত জ্ঞানের চর্চা ব্যতীত চিন্তা চেতনা মেধা ও মননের প্রসারতা অসম্ভব এবং সেই জ্ঞান কেবল ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলবে না; প্রতিটি মানুষকে অর্জন করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের পাঠ, নিতে হবে জীবনমুখী শিক্ষা।
বর্তমানে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের প্রচলন আগের তুলনায় কম। বাল্যবিবাহ আর নেই- কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমরা প্রত্যেকেই এমন অসংখ্য বাল্যবিবাহের নীরব সাক্ষী। আপনজনদের অসম্মানের ভয়ে কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদী হতে চেয়েও পারি না। বাল্যবিবাহ যে সমাজের জন্য একটা বিষফোঁড়া এবং অভিশাপও তা বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। সমাজকে এই অভিশাপ মুক্ত করার জন্য শুধু নারীদের সচেতন হলেই চলবে না।
সচেতন হতে হবে সরকার, পিতামাতা, পরিবার এবং পুরুষ সমাজকে। পুরুষ কিংবা নারী উভয়কেই ভাবতে হবে- বিবাহের সঙ্গে কেবল জৈবিক বিষয়টি জড়িত নয়, বরং বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের পুরো জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে নির্ধারণ করে থাকে। কাজেই প্রত্যেকের ভেবে চিন্তে জীবনসঙ্গী নির্ধারণ করা জরুরি। কিছু কিছু ভুল শুধরানোর সুযোগ খুব কম থাকে। আবার কিছু কিছু ভুল সম্পূর্ণ জীবনটাকেই নষ্ট করে দিতে পারে। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।
বিবাহের পর পরই গর্ভধারণকে আমি যৌক্তিক মনে করি না। কেন যৌক্তিক মনে করি না- সেই কারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দুটি ভিন্ন পরিবেশ থেকে উঠে আসা দুটি ভিন্ন মানুষ যখন একসঙ্গে জীবন পাড়ি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তখন তাদের উভয়কেই অনেক কিছু ছাড় দিয়ে চলতে হয়। মুখে বললেই কিংবা চেষ্টা করলেই ছাড় দেয়া যায় না। ছাড় দেয়ার আগে একে অন্যকে ভালোভাবে বুঝতে হয়। কাউকে ভালো ভাবে বুঝতে হলে তার কথা শুনতে হবে, বন্ধুর মতো মিশতে হবে, তার কাছে নিজেকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে যতটা সম্ভব গুরুত্ব দিতে হবে। তারপর তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদা অনুযায়ী ছাড় দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে দেয়ার মতো ব্যাপার ঘটতে পারে।
এই যে পরস্পরকে গ্রহণ করার বিষয়, মেনে নেয়ার বিষয়- এগুলো সময়সাপেক্ষ বিষয়। হুটহাট করে সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন। বৈবাহিক বন্ধনটা যে পবিত্র ও সুন্দর সেটা বুঝে উঠতেও সময়ের প্রয়োজন। অন্যথায় বৈবাহিক সম্পর্ক কেবলই জৈবিকতার বৃত্তে আটকে যাবে, তা মায়া-মমতা ও ভালোবাসাকে প্রকৃত অর্থে ধারণ করতে সক্ষম হবে না।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরির আগেই যদি সন্তান নেয়া হয়, সে সন্তান বিভিন্ন দিক দিয়ে অবহেলার শিকার হতে পারে। আর পিতামাতার মাঝে মনোমালিন্য, দাম্পত্য কলোহ সন্তানের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব পরিবারের সন্তানরা মানসিকভাবে অসুস্থতার শিকার হতে পারে, ভুল বা অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে, মানসিক শান্তির আশায় মাদকাসক্ত হতে পারে, সমাজ বা আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া তারা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে উঠবে, তখন সম্পর্কের প্রতি তাদের ভেতর সব সময় একটা ভয় ও নেতিবাচক ধারণা কাজ করতে পারে, যা তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা প্রদান করতে পারে, মানসিক শান্তি বিনষ্ট করতে পারে, জীবনের প্রতি তিক্ততারও জন্ম দিতে পারে। অনেক সময় তারা আত্মহত্যার মতো জঘন্য ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তও নিতে পারে। পিতা-মাতা সন্তানের জন্য এমন একটি ভরসা, স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা ও আদর্শের জায়গা যার বিকল্প আজও পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি, কোনোদিন হবেও না।সুত্র যায়যায় দিন
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.