এইমাত্র পাওয়া

এক টাকার মাস্টার

৪৪ বছর আগে দিনে এক টাকা ফি নিয়ে শিক্ষার্থী পড়ানো শুরু করেন লুৎফর রহমান। এখন তাঁর বয়স ৭০। এর মধ্যে কত কিছুর দাম বাড়ল। কিন্তু লুৎফরের প্রাইভেট পড়ানোর ফি আর বাড়েনি। এলাকার লোকজনের কাছে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন ‘এক টাকার মাস্টার’ নামে।

লুৎফরের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাগুড়িয়া গ্রামে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু পাঠদানের উৎসাহ এতটুকু কমেনি। এখন দিনে ৩৫ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি।

লুৎফর রহমান বলেন, এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ গরিব। ছেলেমেয়েদের পড়াতে চান না। প্রাইভেট পড়াতে পারেন না। তাই তিনি নামমাত্র ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এতে তাঁর তেমন লাভ না হলেও গরিব মানুষের ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হচ্ছে। এটাই তাঁর লাভ।

জেলা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাগুড়িয়া। এ গ্রামের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। বাঁধের দুই ধারে নদীভাঙা মানুষের বাস। বেশির ভাগ মানুষের একচালা টিনের ঘর। এখানকারই একটি বাড়ি লুৎফর রহমানের।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, আঙিনায় শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন লুৎফর।

লুৎফর বলেন, প্রতিদিন সকালে পড়ানো শুরু করেন তিনি। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। চার দফায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৩৫ জনকে পড়ান। তিনি একেক ব্যাচকে প্রায় দুই ঘণ্টা করে পড়ান।

কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে লুৎফর রহমানের কাছে প্রাইভেট পড়ে। এখানে পড়তে টাকাপয়সা তেমন লাগে না। এ কারণে বাবা-মায়েরাও পড়তে পাঠান। পড়াশোনা ভালো হচ্ছে।

এ গ্রামের দুর্জয় কুমারের বাবা রুইদাস কুমার পেশায় জেলে। সে স্থানীয় জি ইউ কে স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুর্জয় বলে, অন্য স্যারের কাছে পড়লে মাসে ৫০০ টাকা লাগে। লুৎফর স্যারের কাছে প্রতিদিন এক টাকা লাগে।

একই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী যূথী খাতুনের মা সালমা বেগম বলেন, এই যুগে এক টাকা দিয়ে কিছুই হয় না। ভিক্ষুকও এক টাকা নিতে চায় না। আর লুৎফর স্যার এক টাকায় পড়াচ্ছেন।

লুৎফর রহমানের ৩৫ শিক্ষার্থীর কয়েকটি ব্যাচ পড়ান
একেকটি ব্যাচ পড়ান দুই ঘণ্টা
মধ্যবাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মাহমুদুল ইসলাম। সে জানায়, এক টাকায় স্যার অনেকক্ষণ পড়ান। এ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহিন মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে লুৎফর রহমানকে পড়াতে দেখছি। তাঁর পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীদের উপকার হচ্ছে।’

পরিবার ও এলাকার কয়েকজন জানান, লুৎফর রহমান ১৯৭০ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৪ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস। ১৯৭৫ সালে তিনি বিয়ে করেন। তখন তিনি ২৬ বছরের তরুণ। চাকরি না পেয়ে তিনি টিউশনি শুরু করেন। তখন ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থীকে দিন এক টাকা ফি নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। লুৎফর রহমান বলেন, ‘গরিব ও অবহেলিত এলাকায় জ্ঞানের আলো ছড়াতে পারছি। এটাই আমার লাভ। যত দিন সুস্থ থাকব, তত দিন পাঠদান করে যাব। আমার অনেক ছাত্র ভালো চাকরি পেয়েছেন।’

লুৎফর রহমানের দুই ছেলে, দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু মিয়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। ছোট ছেলে মশিউর রহমান মাদ্রাসায় পড়ছে।

লুৎফরের স্ত্রী লতিফুল বেগম বলেন, তাঁর স্বামী সারা দিন টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাধা দিলে তিনি মন খারাপ করেন। ওটা তাঁর নেশা। বড় ছেলে অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের জোগান দিচ্ছে।

জানতে চাইলে গিদারি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বলেন, বর্তমান বাজারে এক টাকা দিয়ে কিছুই হয় না। এরপরও লুৎফর রহমান এক টাকায় পড়াচ্ছেন। তিনি টাকার চেয়ে জ্ঞানের আলো ছড়ানোটাকে বড় মনে করেন।

সুত্র প্রথম আলো


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.