মোঃ আঃ বাতেন ফারুকী।।
বেসরকারি শিক্ষক – কর্মচারিদের অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য যথাক্রমে মূল বেতনের ৪% ও ২% হারে কর্তন করার নিয়ম ছিল। হঠাৎ করে এ হারকে যথাক্রমে ৬% ও ৪%-এ উন্নিত করা হয়। এবং যথারীতি মে ২০১৯ থেকে অতিরিক্ত ৪% কর্তন শুরু হয়। কবে কখন একটি মিটিং – এ জনা কয়েক শিক্ষক নেতার সম্মতির(!) ঠুনকো দোহাই দিয়ে এমন সেনসিটিভ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রায় পাঁচ লক্ষ স্টেক হোল্ডারদের কথা একটি বারও ভাবা হলো না।
আমরা ধারণা করতে চাই সরকারের শীর্ষ মহল থেকে এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়নি। বরং সরকারকে ভুল বুঝানো হয়েছে। কিছু অতি উৎসাহী লোক আছে যারা নিজেদের আসন বা অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য কিংবা সরকারের প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য সমস্যা সমাধানের নিমিত্ত শর্টকাট উপায় বাতলিয়ে দেন। এ ধরনের লোকেদের সাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা মোটেও নেই। তারা সাধারণ শিক্ষকদের স্পন্দন বুঝতে সক্ষম নন।
শুধু নিজেদের সুনাম – যশ অর্জনের জন্য শিক্ষক সমাজের স্থায়ী ও অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলবেন আর শিক্ষক সমাজ তা মেনে নেবে তা কী করে ভাবলেন। যারা এমন একটি সর্বনাশা কাজ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভুল তথ্য বা ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাদের প্রতি অনুরোধ শিক্ষকদের মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে বিষয়টি পূনর্বিবেচনা করার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে সুপরামর্শ দিন।
যখন বেসরকারি শিক্ষক – কর্মচারি অবসর সুবিধা বোর্ড ও বেসরকারি শিক্ষক – কর্মচারি কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয় তখন নিঃসন্দেহে এর অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। বোর্ড ও ট্রাস্টের কার্যক্রম চালু হওয়ার শুরুর দিকে মাত্র কয়েক মাসের বা কয়েক বছরের চাঁদা জমা দিয়ে অনেক গুণ টাকা নিয়ে একজন শিক্ষক হাসি মুখে বিদায় নিয়েছেন। ইহা তৎকালীন বাস্তবতার নিরিখে সঠিক ছিল। যতই দিন যাচ্ছে ততই এর গুরুত্ব ও অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। একটু ব্যাখ্যা করলেই বিষয়টি পরিস্কার হবে।
ধরা যাক, একজন শিক্ষক ২০০৭ সনের কোনো এক মাসে অবসরে গেলেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা নীতিমালা অনুযায়ী বড়জোর ৪/৫ বছরের চাঁদা(বকেয়াসহ) দিয়েছেন।
যেহেতু ২০০২ সনের ডিসেম্বর মাস থেকে চাঁদা কর্তন শুরু হয়েছে এবং অবসর সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ১৯৮০ সন থেকে চাকুরির সময়কাল গণনা করা হয় সেহেতু তিনি ২০০২ সন পর্যন্ত মোট ২৩ বছরের চাঁদা পরিশোধ করেননি। বিধি অনুযায়ী তিনি মোট প্রাপ্য ৭৫ মাস থেকে চাঁদা না দেয়া ২৩ বছরের জন্য ২৩ মাসের সমপরিমাণ টাকা কম পাবেন।
সেক্ষেত্রে তিনি সর্বশেষ বেতনের মোট ৫২ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা অবসর সুবিধা হিসেবে পাবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে,উনি কত টাকা পেলেন সেটা বিবেচনায় আনা নিষ্প্রয়োজন কারণ টাকার মূল্যমান কোনো কালেই স্থিতিশীল না। এখানে তুলনামূলক হারটাই বিবেচ্য।
আবার ধরা যাক,একজন শিক্ষক ২০০২ সনের ডিসেম্বর মাসে যোগদান করে ২০২৭ সনের ডিসেম্বর মাসে অবসর গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে তাকে পুরো ২৫ বছরের চাঁদা প্রদান করতে হবে। বিনিময়ে বিধি মোতাবেক তিনি ৭৫ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা অবসর সুবিধা হিসেবে পাবেন। এখানেও টাকার অংক বিবেচনায় আনার প্রয়োজন নেই। কারণ যিনি যখন অবসর সুবিধা পাচ্ছেন তিনি তখন তার নির্ধারিত স্কেলে টাকা পাচ্ছেন।
উপরের দুটি উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় দুজনের মিলে কমপক্ষে ৫০ মাসের চাঁদা জমা হওয়ার কথা এবং এর বিপরীতে বোর্ডকে ১৫০ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা অবসর সুবিধা হিসেবে তাদেরকে প্রদানের কথা। অতিরিক্ত অর্থের চাপ যথারীতি সরকারকেই বহন করার কথা এবং করা উচিত। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করার মত, মাত্র ৪/৫ মাসের চাঁদা প্রদান করে একজন ৫২ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা অবসর সুবিধা হিসেবে পেয়েছেন।
অন্যদিকে অপরজন ২৫ মাসের চাঁদা প্রদান করে ৭৫ মাসের বেতনের সমপরিমাণ টাকা অবসর সুবিধা হিসেবে পাবেন। অর্থাৎ একজেরন জমাকৃত চাঁদার মাস এবং প্রাপ্য সুবিধার বেতনের মাস – এ দু’টির অনুপাত ৫ মাস : ৫২ মাস = ১ : ১০.২। আবার অন্যজনের অনুরূপ অনুপাত ২৫ মাস : ৭৫ মাস = ১ : ৩। এখানে বৈষম্য প্রায় ৩৫০%। তবুও শিক্ষক সমাজ মেনে নিয়েছিল তৎকালীন শোচনীয় অবস্থার কথা বিবেচনা করে। কিন্তু এখন রাস্ট্রই বলি কিংবা শিক্ষক সমাজই বলি উভয়ই অনেক পরিপক্ব।
তবে সত্য কথা, সরকারের উপরেও চাপ কম না। ২০০২ সালের পর তিনটি পে-স্কেল কার্যকরি হওয়ার দরুন প্রতিটি পে-স্কেল বাস্তবায়নের শুরুর দিকে যারা অবসরে গিয়েছেন তারা প্রাপ্যতার প্রায় দ্বিগুণ সুবিধা পেয়েছেন। এতসব আইনি সুবিধা প্রদত্তের ফলে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট যথেষ্ট বেকায়দায় পড়েছে ইহা অনস্বীকার্য।
এটাও অনস্বীকার্য যে, এ বেকায়দা উত্তরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাও নিতে হবে সরকারকেই। সরকার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টজনদের পরামর্শ নেবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এক্ষেত্রে পরামর্শটা হওয়া চাই গঠনমূলক, বাস্তবসম্মত এবং সময়োপযোগী। কোনো রোগীর কিডনির সমস্যা হলে তাকে কিডনি দান করে বাঁচানোর প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে রোগীর আপনজন তাও মা-সন্তান,পিতা-সন্তান কিংবা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেই কেবল সম্ভবপর(যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের আইনি সাপোর্টের প্রয়োজন আছে)। তাই বলে অন্য কারও কিডনি নিয়ে রোগী বাঁচানোতো আরেকটি খুনের শামিল।
কাজেই একজনের বিধি মোতাবেক প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আরকজনকে বঞ্চিত করার অধিকার আমাদের কারও নেই। সরকারের উচিত আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ১৯৯০ এর ৯ নং ধারার ৩ নং উপধারায় উক্ত ট্রাস্টের তহবিল গঠনের জন্য পাঁচটি উৎসের কথা বলা আছে। এর মধ্যে প্রথম দুটোই সরকারের ব্যবস্থাপনায় পূরণযোগ্য। সরকার এককালীন তহবিল দেবেন এবং সময় সময় প্রয়োজনমত সীড মানি দিয়ে স্থায়ী তহবিলকে স্ফীত করবেন ও প্রয়োজনমত অনুদান দেবেন। কী পরিমাণ দেওয়া উচিত বা কী পরিমাণ দিয়েছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করলে লেখার কলেবর স্ফীত হয়ে যাবে। সেদিকে না যাওয়া-ই ভালো।
আর তিন নম্বর উৎসের কথায় বলা আছে শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের কথা। অনুরূপ ভাবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা আইন, ২০০২ এ ৯ নং ধারার ১ নং উপধারায় তহবিলের তিনটি উৎসের মধ্যে প্রথমটি সরকার কর্তৃক অনুদান এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষকদের চাঁদা। এবং উভয় ক্ষেত্রেই যথারীতি শিক্ষকগণ চাঁদা দিয়েও আসছেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধে কেবল তখনই,যখন সমস্যায় পড়লেই সহজ সমাধান হিসেবে ছুরি চালানো হয় চাঁদার উপর। এভাবে আমার নিজের দায়িত্বের ব্যর্থতার দায় অন্যের উপর চাপানো ঠিক হবে কি?
সুতরাং মূখ্য দায়িত্বকে এড়িয়ে গৌণ দায়িত্বের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অর্থই হলো কোনো প্রক্রিয়া ঠিকঠাক মতো এগুচ্ছে না। এখানে সবিনয়ে বলতে চাই অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের অতিরিক্ত ৪% কর্তনের উপর যদি একটি ইনফরমাল রেফারেন্ডামের ব্যবস্থাও করা যেত তবে বুঝা যেত এ কর্তন বেসরকারি শিক্ষক সমাজকে কতটা আঘাত দিয়েছে, কি পরিমাণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে তাদের বুকে। সত্যি কথা বলতে, কল্পিত রেফারেন্ডামে প্রায় ১০০% রায় আসতো অতিরিক্ত কর্তন বন্ধ করার পক্ষে।
অতএব সরকারের প্রতি সবিশেষ ও সবিনয় অনুরোধ বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের অতিরিক্ত ৪% চাঁদা কর্তন বাতিল করার আদেশ জারি করে শিক্ষক সমাজের হৃদয় জয় করার সুযোগ গ্রহণ করুন। এবং প্রয়োজনীয় ঘাটতি পূরণের জন্য দায়িত্ব পালনে সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে এমপিও(মান্থলি পে অর্ডার)’র মতো একটি বাজে সিস্টেমকে(এ এম এ মোহিত তত্ত্ব) বাতিল করে জাতীয়করণের ঘোষণা(বাস্তবায়ন বিলম্ব হলেও) দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ গ্রহণ করুন।
লেখক-
প্রধান শিক্ষক
সৈয়দ হাবিবুল হক উচ্চ বিদ্যালয়
বৌলাই,কিশোরগঞ্জ।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.