একটি অবুঝ শিশু তার মায়ের কোল থেকে প্রথমে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় সেটি হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই অবুঝ শিশুটির হাতে হাত রেখে যারা স্নেহ করে শিক্ষার প্রথম ধাপে পাঠদান করেন তারা হচ্ছেন প্রাথমিক শিক্ষক। আজকে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বড় বড় মন্ত্রী, সচিব, আমলা, ডাক্তার, প্রকৌশলী, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ এমন কোন পেশাজীবী নেই যারা এই প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিলেন না।
অথচ কী দুঃখজনক বিষয় দেখুন প্রাথমিক শিক্ষকদের সেই শিক্ষার্থীরাই আজকে প্রাথমিক শিক্ষক পরিচয় পেলে নাক সিটকায়,অবজ্ঞা করে। দেশের কিছু পেশাজীবীর ভাবখানা এমন যেন তারা কোনকালেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন না। যে জাতি তার শিকড় এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই ভুলে যায়,অবজ্ঞা করে সে জাতি কোনদিন জাপান,সিংগাপুরের মত উন্নত দেশের কাতারে যেতে পারবে কি? উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক,আমলা এমনকি মন্ত্রীর থেকেও বেশী বেতন ও মর্যাদা দেয়া হয়,তাইতো তারা আজ উন্নত। হাইস্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কত নিরিবিলি কারণ সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সবাই উপযুক্ত বয়সের বিধায় কোনরকম গোললমাল, হইচই, দুষ্টামী ও চিৎকার নেই। তাই হাইস্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস পরিচালনা করা তুলনামূলক সহজ। অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থী অবুঝ ও কোমলমতী বিধায় সবসময় তারা দুষ্টামী,হইচই করতে ব্যস্ত। এই কোমলমতী শিশুদের পাঠদান করতে যে কী পরিমাণ কষ্ট ও পরিশ্রম শিকার করতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগী শিক্ষকরাই জানেন।
অথচ কী নির্মম পরিহাস যাদের পাঠদান করতে সবচেয়ে কষ্টকর তাদেকে সকাল ৯টা থেকে ৪:৩০ পর্যন্ত একটানা পাঠদান করতে হয়। অন্যদিকে হাইস্কুলের সময় ১০টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। কলেজে তো কোন সময়সূচীর নিয়মই মানা হয় না। প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে এর চেয়ে বড় নির্মম কৌতুক আর কি হতে পারে?
অথচ উন্নত দেশগুলোতে এমনকি আমাদের দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সময়সূচী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (হাইস্কুল,কলেজ) চেয়ে অনেক কম। তাছাড়া অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় কম ছুটি ভোগ করেও প্রাথমিক শিক্ষকরা ভ্যাকেশনাল কর্মচারী কিন্তু অন্যরা নন-ভ্যাকেশনাল কর্মচারী। এটা কি প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে বৈষম্য নয়?
আবার বেতন ভাতার তুলনা করলে দেখুন সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও সমযোগ্যতার হয়েও প্রাথমিক শিক্ষকরা হাইস্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় সবচেয়ে নিম্নমানের বেতন গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের ন্যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যারা করেন সেই সহকারী শিক্ষকরা এখনো ৩য় শ্রেণির কর্মচারী। পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রশ্ন হচ্ছে একজন শিক্ষকের পদমর্যাদা কীভাবে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হয়?
তাছাড়া সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের পরের গ্রেডে সহকারী শিক্ষকরা বেতন গ্রেড পেলেও বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষকদের ৩ ধাপ নিচে বেতন পাচ্ছেন যা চরম বৈষম্যমূলক। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকদের যেখানে ১০ম গ্রেড দেয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেখানে প্রধান শিক্ষকের পরের গ্রেড অনুসারে স্বাভাবিকভাবে সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দেয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠানো উচিত ছিল। কিন্তু সবচেয় নির্মম পরিহাস হচ্ছে সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের প্রস্তাব না পাঠিয়ে ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব পাঠিয়ে বৈষম্য নিরসন করার নামে আবারো বড় বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে যা সহকারী শিক্ষকদের বিদ্যালয় থেকে রাজপথে নামিয়ে দেয়ার শামিল।
মানুষ গড়ার কারিগর সহকারী শিক্ষকদের দাবী পূরণের জন্য বিদ্যালয় থেকে রাজপথে আন্দোলন করতে হয় এর থেকে বড় অপমান শিক্ষকদের জন্য আর কি হতে পারে? আমরা শিক্ষকরা আশা করি, মন্ত্রণালয়ের শুভবুদ্ধির উদয় হবে ও সহকারী শিক্ষকদের দাবী অনুসারে ১১তম গ্রেড দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে শিক্ষকদের রাজপথে না নামিয়ে বিদ্যালয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে উৎসাহী করাবেন।
লেখক: প্রাথমিক শিক্ষক
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.