আইউব আলী।।
জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর সুশিক্ষার নাবিক হলেন শিক্ষক সমাজ। শিক্ষক সমাজের উপরই নির্ভর করছে দেশের ভষিষ্যত। অথচ এ শিক্ষক সমাজই আজ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যের পাশাপাশি শাখা শিক্ষক যেন শিক্ষা ক্ষেত্রে আজীবনের অভিশাপ প্রাপ্ত! বিভিন্ন শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে নীতিমালা অনুযায়ী শাখা পদ সৃষ্টি করে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় কিন্তু বরাবরই দেখা গেছে শাখা শিক্ষকদের বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর। কারণ প্রায় সময়ই শাখা শিক্ষকের বেতন দেয়া বন্ধ থাকে।
এমনিভাবে গত ২০১১ সাল থেকে শাখা শিক্ষকের বেতন দেয়া বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে বেতন দেয়ার অনুমতি দেন কর্র্তৃপক্ষ। সে সময় জমে থাকা কয়েক সহ¯্র শাখা শিক্ষকের বেতনের আবেদন জমা পড়ে। অনেকের বেতন হয় আবার অনেকের ফাইল বাতিল হয় নানা কারণে। কারণগুলোর মধ্যে রেজুলেশন সংক্রান্ত জটিলতা, বিজ্ঞাপন জটিলতা, একই বিষয়ের ২/৩ জন শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা অন্যতম। কয়েক বছর ধরে মানবেতর জীবন-যাপন করার পর যখন একটু আশার আলো ফুটে উঠলো তখন অনেকের ভাগ্যে যেন জটিলতার অভিশাপ নেমে আসলো। যে সমস্যার জন্য বেতন দেয়া হচ্ছেনা সেগুলি কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির সমস্যা নয়, সমস্যার জন্য দায়ী নিয়োগ কর্তৃপক্ষ। আর নিয়োগ কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছেন ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধি হিসেবে একজন সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মহোদয়, পরিচালনা কমিটির সভাপতি, প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং একজন কমিটির সদস্য।
নিয়োগের ত্রুটির যাবতীয় দায়ভার এই ৫ জন ব্যক্তির ওপর বর্তায়। কেননা ভুলতো পাঁচ জনই করেছেন, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকতো করেন নি। ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধি নিয়োগ প্রাপ্ত হন জেলা শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের মাধ্যমে বিধায় তিনিও এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়বদ্ধ। কেননা, ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধি মনোনয়নের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধান যাবতীয় কাগজ-পত্র জেলা শিক্ষা অফিসারের নিকট দাখিল করেন। তিনি যদি কাগজ-পত্র সঠিকভাবে দেখেন তাহলে কিন্তু সমস্যা সেখানেই সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠান প্রধানের ত্রুটিগুলি তার মাধ্যমেই সংশোধন হওয়ার কথা কিন্তু শিক্ষা অফিসার মহোদয় পত্রের মাধ্যমে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ডিজি প্রতিনিধির ওপর হস্তান্তর করেন। ডিজি প্রতিনিধি এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মহোদয় স্বীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় আজকে এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এর দায়-ভার কেন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক নিতে যাবেন? এটা অমানবিক।
সৃষ্ট জটিলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি জটিলতা হচ্ছে একই বিষয়ে একাধিক শিক্ষক নিয়োগদান। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালের জনবল কাঠামোর পূর্বে শাখা শিকক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিলোনা ফলে যে কোন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেই তাকে নিবন্ধন সাপেক্ষে শাখা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যেত। ২০১০ সালের পরিপত্রে শাখা শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় “একই বিষয়ে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবেনা” ধারাটি উল্লেখ আছে। স্কুল পর্যায়ে যেহেতু বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের কোন বিধান ছিলোনা সেহেতু বিষয়টি প্রতিষ্ঠান প্রধান হয়তো বুঝতে পারেননি। এমনটাও হতে পারে যে, নীতিমালার শেষের ছোট্ট একটা লাইন হয়তো চোখেই পড়েনি। সর্বোপরি এমনও হতে পারে যে, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করতে গিয়ে নীতিমালা খুটিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি।
যাই হোক এটা অবশ্যই প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব অবহেলার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু জেলা শিক্ষা অফিসার, ডিজি প্রতিনিধি এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারগণতো বিষয়টি ভালভাবে দেখবেন। তারাও দেখলেন না। প্রকৃতপক্ষে নিয়োগ সংক্রান্ত এসব জটিলতার দায়-ভার সবার উপরই পড়ে, কেউ দায়ভার এড়াতে পারেন না।আসলে ভুল ভুলই। কার দ্বারা হলো সেটা ঘেটে আর কোন লাভ নেই। কারণ দোষী ব্যক্তিদের শায়েস্তা করলেও হতভাগা শাখা শিক্ষকের কোন লাভ হবেনা। শাখা শিক্ষকগণ প্রতিষ্ঠানে বসে থাকেন না। নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন এবং স্বীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন। তাদের প্রয়োজন অর্থের। অর্থের জন্য পারিবারিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে, সব সময় বিরাজ করছে হতাশা। এভাবে তাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সঙ্গত কারণেই ভাল ফলাফল পাচ্ছেনা।
২০১৮ সালের জনবল কাঠামোতে অতিরিক্ত নিয়োগকৃত শিক্ষকদের সমন্বয় করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু নিয়োগকৃত শাখা শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগত্যা নবসৃষ্ট পদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে মিল নেই। এক্ষেত্রে সদাশয় কর্তৃপক্ষ যদি শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি শিথিল করে অর্থাৎ নিয়োগকৃত শাখা শিক্ষক যে বিষয়েই স্নাতক ডিগ্রিধারী হোক না কেন নবসৃষ্ট শিক্ষকের পদগুলিতে সমন্বয় করা যাবে মর্মে পরিপত্র জারী করেন তাহলেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এখন এনটিআরসিএ পরিচালনা করছে। এখন আর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, জটিলতাও সৃষ্টি হবেনা।
আমি সদাশয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনীত অনুরোধ করছি-মানবিক কারণে সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত একই বিষয়ের শাখা শিক্ষকদের বেতন প্রদানের পরিপত্র জারী করেন। এতে প্রতিষ্ঠানের কোন ক্ষতি হবেনা। নিয়োগপ্রাপ্ত শাখা শিক্ষকগণ ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন। শুধু একই বিষয়ের শিক্ষকদের নয়, বিভিন্ন রকম জটিলতায় যারা বেতন পাচ্ছেন না তাদের সবার মুখে হাঁসি ফোটাবেন বলে আমি আশাবাদী।
অধ্যক্ষ
চিলাহাটি গার্লস্ স্কুল এন্ড কলেজ
ডোমার, নীলফামারী।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.