।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
৭ই অক্টোবর ২০২৫। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে লাখো শিক্ষক সমবেত হয়ে গড়ে তুললেন এক অন্যরকম ইতিহাস। কয়েক দশক ধরে বঞ্চনা, বৈষম্য আর অবহেলার বোঝা কাঁধে নিয়ে যাত্রা করা বেসরকারি শিক্ষক সমাজ এই দিনটিকে মনে রাখবেন দীর্ঘদিন। কারণ এই দিনটি শুধু আরেকটি কর্মসূচির দিন নয়—এটি ছিল শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের এক নতুন সোপান। দীর্ঘ আন্দোলনের পথ পেরিয়ে জাতীয়করণের দাবিতে এই ঐতিহাসিক শিক্ষক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (ভার্চুয়াল মাধ্যমে)।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “শিক্ষকদের দাবির সঙ্গে আমার দল একমত। শিক্ষা হলো রাষ্ট্র গঠনের মূলভিত্তি, আর শিক্ষকরা সেই ভিত্তির স্থপতি। তাই তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আমরা রাজনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” তারেক রহমানের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শিক্ষক সমাজে নতুন এক আশার সঞ্চার হয়েছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত বেসরকারি খাতনির্ভর। প্রাথমিক স্তরে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ৯৭ শতাংশ পরিচালিত হয় বেসরকারি খাতে। এই খাতে কর্মরত রয়েছেন প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী। তাঁরা রাষ্ট্রীয় পাঠ্যক্রম মেনে একই সময়, একই শ্রেণিকক্ষ এবং একই পাঠদান করলেও সরকারি শিক্ষকদের তুলনায় তাঁদের সুযোগ সুবিধা অনেকটাই বৈষম্যমূলক।
দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দাবি করে আসছেন তাঁদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য। দাবি করেছেন—একই কাজের জন্য একই বেতন ও ভাতা।সময়মতো ইনক্রিমেন্ট ও পেনশন ব্যবস্থা।চিকিৎসা ও গৃহভাড়া ভাতা। শিক্ষককে ‘রাষ্ট্রীয় কর্মচারী’ হিসেবে স্বীকৃতি।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও এই শিক্ষক সমাজ এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও অধিকার পাননি।
শিক্ষক সমাজের দীর্ঘ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৭ই অক্টোবরের এই সম্মেলন নিঃসন্দেহে একটি টার্নিং পয়েন্ট। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে লাখো শিক্ষকের উপস্থিতি প্রমাণ করে—এই দাবির পেছনে কেবল আবেগ নয়, বাস্তবতা ও ন্যায্যতা আছে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাঁরা শিক্ষকদের দাবিকে আন্দোলনের দাবিতে রূপান্তরিত করার আশ্বাস দেন। সভায় শিক্ষক নেতারা একে একে তাঁদের দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। একজন শিক্ষক বলেন, “আমরা একই পাঠ্যক্রম পড়াই, একই ক্লাসে দাঁড়াই, কিন্তু আমাদের চোখে থাকে অনিশ্চয়তা, অভাব আর বঞ্চনার ছাপ।”
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যক্ষ সেলিম ভুইঁয়া বলেন,
“আজকের এই ঐতিহাসিক শিক্ষক সম্মেলন কেবল একটি কর্মসূচি নয়—এটি শিক্ষক সমাজের বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক গর্জন। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রেখেছি, কিন্তু আমাদের অধিকার এখনো অধরা। আমরা চাই না আর প্রতিশ্রুতি, আমরা চাই বাস্তব পদক্ষেপ। শিক্ষক জাতীয়করণ এখন আর কোনো দাবি নয়—এটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব ও সময়ের দাবি।”
তিনি আরও বলেন,
“লাখো শিক্ষক আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্দানে সমবেত হয়েছেন একটি মাত্র দাবিকে সামনে নিয়ে—ন্যায্য মর্যাদা ও অধিকার আদায়। যারা দেশ গড়ার কারিগর, তাদের বঞ্চিত রেখে কোনো উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আমরা স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই—এবার জাতীয়করণ চাই, এখনই চাই।”
শিক্ষকদের আর্থিক অনিশ্চয়তা দূর না হলে তারা পুরো মনোযোগ শিক্ষার মানোন্নয়নে দিতে পারবেন না। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকরা নিশ্চিন্ত মনে পাঠদান করবেন।
সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে বিদ্যমান বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদার বৈষম্য একটি বড় সমস্যা। জাতীয়করণ এ বৈষম্য দূর করবে।
শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তাই এই দায়িত্ব শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে না দিয়ে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষককে স্বস্তিতে রাখলে তিনি শিক্ষার্থীর প্রতি যত্নবান হবেন। ফলে শিক্ষার মান বাড়বে, যা জাতির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
সম্মেলনে শিক্ষক নেতারা শুধু দাবি তোলেননি—তাঁরা প্রত্যাশা করেছেন রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিক পদক্ষেপ। তারা বলেছেন, “আমরা ভিক্ষা চাই না, অধিকার চাই।” তাঁদের এই দাবি শুধু শিক্ষকদের জন্য নয়, এটি সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য।
জাতীয়করণ হলে—শিক্ষকরা আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন।চাকরিতে মর্যাদা ও স্থিতিশীলতা আসবে।শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে।শিক্ষার্থীরা আরও মানসম্মত শিক্ষা পাবে।
এদিনের সম্মেলনে রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব শিক্ষক সমাজকে সরাসরি সমর্থন জানিয়ে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে শিক্ষক জাতীয়করণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এটি নিঃসন্দেহে আন্দোলনে নতুন গতি আনবে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়—শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব? ইতিহাস বলে, এ দেশে অনেক প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক মঞ্চে মিলিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। তাই শিক্ষক সমাজ এবার আর প্রতিশ্রুতি নয়, দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চায়।
শিক্ষক জাতীয়করণ শুধু একটি পেশাগত দাবির বিষয় নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ন্যায্যতার প্রশ্ন। সরকার যদি সত্যিই শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়, তাহলে এই দাবিকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ—শিক্ষকের মর্যাদা না থাকলে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারেরই পাঠ্যক্রম বাস্তবায়ন করে।শিক্ষকেরা সরকারের নির্দেশনাই অনুসরণ করে শ্রেণিকক্ষ পরিচালনা করেন।
সুতরাং তাদের ‘বেসরকারি’ বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া বাস্তবতা থেকে দূরে থাকা।
জাতীয়করণের দাবি কোনো বিলাসবহুল চিন্তা নয়—এটি মানবিক ও বাস্তব দাবি। একজন শিক্ষক যখন বেতনের টাকায় সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে হিমশিম খান, তখন তিনি শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিতে পারেন না। একজন শিক্ষক যখন অবসরের পর পেনশন না পেয়ে অসহায় জীবন কাটান, তখন তা রাষ্ট্রের জন্যও লজ্জার।
শিক্ষকরা সমাজ গড়েন, জাতি গড়েন। অথচ এই জাতির নির্মাতা শ্রেণি আজ নিজেই অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করছে।
এই শিক্ষক সম্মেলন শুধু একটি কর্মসূচি নয়—এটি একটি স্পষ্ট বার্তা। সরকারকে শিক্ষক সমাজ জানিয়ে দিয়েছে—
আর দেরি নয়,
আর প্রতিশ্রুতি নয়,
এবার চাই বাস্তবায়ন।
লাখো শিক্ষকের সম্মিলিত কণ্ঠ প্রমাণ করে দিয়েছে—এই দাবিকে আর উপেক্ষা করা যাবে না।
ইতিহাস সাক্ষী, শিক্ষক সমাজের আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি, কেবল সময় লেগেছে। একসময় এমপিওভুক্তির দাবি পূরণ হয়েছে, বেতন স্কেলও কিছুটা উন্নত হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ জাতীয়করণের দাবি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সময় এসেছে এই ইতিহাস বদলে দেওয়ার।
শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়ন মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিনিয়োগ।শিক্ষকদের সম্মান দেওয়া মানে জাতিকে সম্মান দেওয়া।শিক্ষককে মর্যাদা না দিলে কোনো জাতিই এগোতে পারে না।
৭ অক্টোবরের ঐতিহাসিক শিক্ষক সম্মেলন বাংলাদেশের শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। তারেক রহমানসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি যদি কার্যকর হয়, তবে এ দেশ পাবে একটি শক্তিশালী শিক্ষা কাঠামো ও সম্মানিত শিক্ষক সমাজ।
তবে এটিও সত্য—শিক্ষকদের এই দাবিকে বাস্তবায়ন করতে হলে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, চাই বাস্তব পদক্ষেপ, নীতি নির্ধারণে অগ্রাধিকার এবং বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ।
শিক্ষক জাতীয়করণ কোনো দলের নয়, এটি পুরো জাতির দাবি। তাই এখন সময় এসেছে এই দাবি পূরণ করে শিক্ষকদের চোখে স্বপ্ন ফেরানোর।
লেখা: শিক্ষক ও গবেষক।
শিক্ষাবার্তা /এ/০৮/১০/২০২৫
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
