।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়ক আজ মোটরবাইকের তাণ্ডবে রক্তাক্ত। প্রতিদিনের সংবাদে চোখ রাখলেই দেখা যায়, কোথাও কলেজপড়ুয়া তরুণ, কোথাও শ্রমজীবী যুবক কিংবা কোনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান ভয়াবহ এক চিত্র তুলে ধরে— চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাত্র আট মাসে বাইক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১,৮৩৯ জন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ২০০ জনেরও বেশি মানুষ এই দুই চাকার বাহনের নিচে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি মৃত্যু এক একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ, এক একটি ভবিষ্যতের নিভে যাওয়া প্রদীপ।
বিআরটিএর তথ্যমতে, গত দেড় দশকে দেশে মোটরবাইক নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। কিন্তু এই বৃদ্ধি ঘটেছে নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ বা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নয়ন ছাড়াই। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদ— সর্বত্র মোটরবাইকের দৌরাত্ম্য। সড়কে একসময় যেখানে সাইকেল বা রিকশা ছিল স্বাভাবিক বাহন, এখন সেখানে ছুটে চলছে শব্দ-বোমার মতো বেপরোয়া মোটরবাইক।
অন্যদিকে, এই বাহনের চালকদের অধিকাংশই অপ্রশিক্ষিত। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, মোটরবাইক চালকদের ৮০ শতাংশের বৈধ লাইসেন্স নেই। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন চালকের মধ্যে ৮ জনই আইনবহির্ভূতভাবে রাস্তায় বাইক চালাচ্ছেন। এরা কেউ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, কেউ আবার অনলাইন ডেলিভারির কর্মী, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে রেসিং প্রতিযোগিতায় মত্ত।
বাইক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এই পরিসংখ্যান শুধু ভয়ঙ্করই নয়, দেশের ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনকও বটে। দেশের সবচেয়ে কর্মক্ষম ও সৃষ্টিশীল বয়সের তরুণরা আজ নিজেরাই নিজের মৃত্যুর পথে দৌড়াচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “রাইডিং” এখন অনেকের কাছে অ্যাডভেঞ্চার বা “স্টাইল আইকন”। এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে হ্যান্ডেল— হেলমেট ছাড়া, তিনজন একসঙ্গে বসে ছবি তুলতে তুলতে ছুটে যাওয়া যেন এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী যথার্থই বলেছেন— “অনেক চালক বাইক চালান রেসিং মুডে, ট্রাফিক আইন মানেন না, হঠাৎ লেন পরিবর্তন বা ওভারটেকিং করেন, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।” এই আচরণ কেবল ব্যক্তিগত বেপরোয়া মানসিকতার প্রকাশ নয়, এটি সামাজিক অবক্ষয়েরও প্রতিফলন। যেখানে নিয়মভঙ্গকে সাহস মনে করা হয়, সেখানে দুর্ঘটনা হবে না— তা কি সম্ভব?
দেশে ট্রাফিক আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। পুলিশের চোখের সামনে কিশোররা হেলমেট ছাড়া, তিনজন মিলে বাইক চালায়, কিন্তু তারা “চিপাচাপা দিয়ে চলে যায়”— এমন মন্তব্য করেছেন বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক। প্রশ্ন হচ্ছে— কেন পুলিশ অসহায়?
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের অনেক সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের মুখে নিরুপায় হতে হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, বাইক আরোহী নিজেই পুলিশ বা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য। ফলে রাস্তায় ‘আইন’ থাকে কাগজে, বাস্তবে থাকে ‘ক্ষমতা’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গবেষণা বলছে— মানসম্মত হেলমেট পরলে বাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি ৫০ শতাংশ এবং আহত হওয়ার ঝুঁকি ৭০ শতাংশ কমে। অথচ বাংলাদেশের রাস্তায় হেলমেটবিহীন চালক দেখা এখনো নিত্যদিনের ঘটনা। অনেকেই হেলমেটকে শুধু পুলিশ চেকপোস্ট পার হওয়ার টুল মনে করেন, নিরাপত্তা নয়।
এখানে প্রয়োজন মনোভাবের পরিবর্তন। হেলমেট পরা কেবল আইন মানা নয়— এটা নিজের জীবন রক্ষার ন্যূনতম দায়িত্ব। সরকার চাইলে মানহীন হেলমেট বিক্রি বন্ধ করতে পারে, হেলমেটবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিতে পারে, কিন্তু এর সঙ্গে চালকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরীর মতে, “বাইক দুর্ঘটনা কমাতে হলে উন্নত দেশগুলোর মতো গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিতে হবে।” এটি নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবমুখী পরামর্শ। শহরে যানজটের কারণে অনেকেই বাইক ব্যবহার শুরু করেন— সময় বাঁচানোর প্রয়োজনে। কিন্তু সেই সময় বাঁচাতে গিয়ে অনেকেই হারাচ্ছেন পুরো জীবন।
যদি ঢাকায় নিরাপদ, আধুনিক, সময়নিষ্ঠ ও সাশ্রয়ী গণপরিবহন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বাইকের উপর নির্ভরতা অনেক কমবে। পাশাপাশি বাইক ব্যবহারের জন্য আলাদা লেন বা নির্ধারিত রাস্তা তৈরি করা যায়, যেমনটা উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায়।
বাইক দুর্ঘটনার আরেকটি কারণ রাস্তার গুণগত মান। শহরের ভিতরে গর্ত, উঁচু-নিচু রাস্তা, হঠাৎ মোড় বা অপরিকল্পিত গতিরোধক— এসবই দুর্ঘটনার বড় কারণ। বাইকের ছোট আকারের কারণে বড় গাড়ির চালকরা অনেক সময় তাদের দেখতে পান না, বিশেষ করে ওভারটেকিং বা মোড়ে। ফলে ছোট একটি ভুলই বড় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়।
এক্ষেত্রে শহর পরিকল্পনা ও রাস্তা নকশায় “সেফটি ইঞ্জিনিয়ারিং” ধারণা জরুরি। বুয়েটের অধ্যাপক সামছুল হক যেমন বলেছেন— “সব জায়গায় বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ করতে হবে, তাহলে বাইক দুর্ঘটনাও কমবে।” অর্থাৎ, রাস্তার নকশা, সাইনবোর্ড, আলোকব্যবস্থা ও মোড়ের বিন্যাস— সবকিছুই হতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে পরিকল্পিত।
বাইক দুর্ঘটনার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো— এখন কিশোররাও এই বাহন চালাচ্ছে। ১৫-১৭ বছর বয়সী কিশোরদের হাতে বাইক তুলে দিচ্ছেন তাদেরই বাবা-মা। হয়তো সন্তানকে আধুনিক বা সাহসী দেখাতে চায় পরিবার, কিন্তু তারা ভুলে যায়— এই “সাহসী” ছেলেটিই হয়তো একদিন আর ফিরে আসবে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের ভাষায়, “মোটরবাইকের বড় অংশ চলে গেছে কিশোরদের হাতে।” এই কথা শুধু দুঃখজনক নয়, সমাজের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। কিশোর অপরাধ, মাদক এবং দুর্ঘটনা— তিনটি বিষয় এখন একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিভাবকদের বুঝতে হবে— বাইক কোনো খেলনা নয়। এটি প্রাণঘাতী একটি যন্ত্র, যা মুহূর্তে জীবন কেড়ে নিতে পারে।
প্রশিক্ষণের ঘাটতি বাইক দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। চালকরা সড়কনিয়ম জানেন না, জানলেও মানেন না। দেশে যদি “রাইডার ট্রেনিং ইনস্টিটিউট” গড়ে তোলা যায়, যেখানে প্রতিটি নতুন বাইক চালকের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমানো সম্ভব।
একই সঙ্গে স্কুল-কলেজে “সড়ক নিরাপত্তা শিক্ষা” চালু করা দরকার। তরুণ প্রজন্মকে ছোটবেলা থেকেই ট্রাফিক আইন, রাস্তার আচরণ ও নিরাপত্তার বিষয়ে শিক্ষা দিলে তা তাদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে আইন ও নীতিমালা কম নয়, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল। একদিকে ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা সীমিত, অন্যদিকে নাগরিকদের আইন অবজ্ঞার মানসিকতা প্রবল। এই বাস্তবতায় কেবল প্রচারণা যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন কঠোর ও ধারাবাহিক পদক্ষেপ।
- মোটরসাইকেল নিবন্ধনের সময় লাইসেন্স যাচাই বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি বা কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে তাদের রাইডারদের প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য।
মোটরবাইক আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা— এটি চাকরি, যোগাযোগ ও সময় বাঁচানোর বড় মাধ্যম। কিন্তু এই বাহন যেন মৃত্যুর দূত না হয়ে ওঠে, সে দায়িত্ব আমাদের সবার। তরুণ চালক, অভিভাবক, প্রশাসন ও সরকার— সবাইকে একসঙ্গে ভাবতে হবে।
রাস্তায় রক্ত নয়, শৃঙ্খলা চাই। প্রতিটি হেলমেট যেন একেকটি প্রাণ বাঁচায়। প্রতিটি রাইড যেন নিরাপদ হয়। মনে রাখতে হবে— গতি নয়, গন্তব্যই জীবনের লক্ষ্য।
লেখা: শিক্ষক ও গবেষক।
শিক্ষাবার্তা /এ/০৬/১০/২০২৫
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.
শিক্ষাবার্তা ডট কম অনলাইন নিউজ পোর্টাল
