নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ “আপনার এত ক্ষমতা- এসি ল্যান্ডকে হাইকোর্ট” শিরোনামে গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাবার্তা’সহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসি ল্যান্ড থাকা অবস্থাতেই ক্ষমতার দাপট দেখানো এই কর্মকর্তা হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও ক্ষমতার অপব্যহার আর থামেনি। পদ-পদোন্নতি বৃদ্ধির সাথে বেড়েছে ক্ষমতাও। বলছিলাম, ২০১২ সালে স্বৈরাচারী আওয়ামী শাসন আমলে ৩১ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের নারী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায়ের কথা। যিনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার (প্রশিক্ষণরত) কর্মজীবন শুরু করে এখন সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে যতগুলো ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে তার মধ্যে জনতার সেবা করার সরাসরি সুযোগ রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের। অথচ এই কর্মকর্তা যেখানেই দায়িত্বে গেছেন করেছেন ক্ষমতার অপব্যবহার, জনসেবার বদলে বাড়িয়েছেন জনভোগান্তি, করেছেন দুর্নীতি-অনিয়ম। কোটি টাকার অনিয়ম ও৷ সরকারি অর্থ আত্মসাৎ থেকে শুরু করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে থেকে একাধিকবার দেখিয়েছেন ক্ষমতার দাপট।
ক্ষমতার দাপট দেখানোয় তাৎক্ষনিক অবমুক্তি (স্টান্ড রিলিজ) হওয়া, হাইকোর্টের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পাওয়া বিরোধা রানী রায়ের অনিয়ম এখনও থেমে নেই। অনিয়মে অভিযুক্ত এক ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে কাজ করছেন সরাসরি। এক্ষেত্রে এলাকাবাসীর অভিযোগ, মোটা অংকের অর্থ পেয়ে সেই অধ্যক্ষের পক্ষে কাজ করছেন তিনি। জানা গেছে, মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলাধীন হুলিয়ারপাড়া জামেয়া কাদেরিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো: মঈনুল ইসলাম পারভেজের মাসিক বেতন-ভাতা (এমপিও) স্থগিত করে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। নিয়মানুযায়ী, আর্থিক অনিয়মের দায়ে কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত হলে সাময়িক বরখাস্ত করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার কথা গভর্নিং বডি। কিন্তু তা না করে মাদ্রাসাটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিরোদা রানী রায় অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলামকে স্বপদে বহাল রেখেছেন।
মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট গ্রামবাসী গত ৪ মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসাটির সভাপতি বিরোদা রানী রায় বরাবর অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলাম পারভেজকে অপসারণ করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের জন্য লিখিত অভিযোগ জমা দেন। তবে সেই অভিযোগ কর্নপাত না করে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার এমপিও শীটে অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলামকে বহাল রেখে তার স্বাক্ষরেই বেতন বিল ছাড় করান তিনি।
প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ, ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি একটিতেও
সহকারী কমিশনার—ভূমি (এসি ল্যান্ড) থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জে ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে এসি ল্যান্ড কার্যালয়ে মামলার শুনানির সময় সেখানে প্রবেশ করাকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটিতে জড়ান তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিরোদা রানী রায়। এর জের ধরে বিরোদা রানী সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে একজন প্রবীণ আইনজীবী বিনোদ বিহারীর সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে তাকে ৫০০ টাকা জরিমানা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিক্ষোভ করে দিনাজপুর জেলার আইনজীবীরা।
আইনজীবীরা এসিল্যান্ড বিরোদা রানী রায়কে সাময়িক বরাখাস্ত করার দাবি তুললেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত না করে ওই দিনই তাকে দিনাজপুর থেকে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় বদলি করা হয়। প্রবীণ আইনজীবীর সাথে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করা ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অর্থদণ্ড দেওয়ার বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে তলব করে হাইকোর্ট। এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি জানিয়ে হাইকোর্ট থেকে সে যাত্রায় নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যান তিনি।
ইউএনও থাকাকালীন সরকারের দেওয়া ভূমিহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
৬ অক্টোবর ২০২০ খ্রিস্টাব্দে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব গ্রহণ করে ২৯মার্চ ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন বিরোদা রানী রায়। দায়িত্ব থাকাকালীন পীরগঞ্জের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। আর ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণের এই প্রকল্প হাতে পেয়ে কয়েকটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠলেও হয়নি তদন্ত।
জানা গেছে, পীরগঞ্জ উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৯ কোটি ১৫ লক্ষ ১৯ হাজার ৭৫০ টাকা। আর এই প্রকল্পের টাকা তিনি এককভাবে ব্যয় করেন। ঘর নির্মাণ প্রকল্প কমিটিতে ইউএনও বিরোধা সভাপতি, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সদস্য সচিব এবং সহকারী কমিশনার(ভুমি), উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানেক সদস্য করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠিত হয় সেসময়। কমিটির কোন সদস্যকে পাত্তা না দিয়ে ইউএনও এককভাবে নির্মাণ কাজগুলো সম্পন্ন করেন। অথচ ওই কমিটির সদস্য সচিব (পিআইও) কাজের সার্বক্ষণিক তদারকি করার কথা। ইউএনও বিরোধা রানী নিজ বাড়ী এলাকা পঞ্চগড় থেকে লেবার মিস্ত্রী এনে নির্মাণকাজ করান। তৎকালীন ওই এলাকার ২ জন হেড মিস্ত্রীকে সাব ঠিকাদারি দিয়ে কাজগুলো সম্পন্ন করেন তিনি। নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার, প্রাক্কলনে সীমাহীন ফাঁকি, উপকারভোগীদের ও কর্মসৃজন কর্মসুচির শ্রমিকদের দিয়ে মাটি ভরাট করে নেয়া, অবৈধ ইটভাটা মালিকদের থেকে অল্প দামে ইট ক্রয়, করতোয়া নদীর অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের থেকে বিনামূল্যে বালু নেওয়াসহ ক্ষমতার সব ধরনের সুযোগ নিয়ে বরাদ্দের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করে হাতিয়ে নেন তৎকালীন ইউএনও বিরোধা রানী রায়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫ সদস্যের প্রকল্প কমিটির সভাপতি হওয়ায় অন্যান্য সদস্যরা কাজগুলোর মান যাচাইয়েরও সুযোগ দেননি তিনি। সেসময় শুধুমাত্র বিলপত্রে এদের স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায় এককভাবে সবগুলো ঘর নির্মাণ করেছেন। প্রকল্প এলাকায় ইটভাটা হতে বাধ্যতামুলক ১১ হাজার টাকা দামের ইট মাত্র ৭ হাজার টাকায়, করতোয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের কাছে নজরানা হিসেবে ২/৩ ট্রাক করে বালু সরবরাহ নিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়। যে কারণে ভাঁটা মালিকরা ২ নং ইট সরবরাহ দিয়ে গা বাঁচিয়েছেন। বালু উত্তোলনকারীরাও ভিট বালু সরবরাহ দিয়েছেন। ফলে স্বভাবিকভাবেই ঘর নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যাবহার হয়েছে। নিন্ম মানের সামগ্রি ব্যবহার করায় হস্তান্তরের আগেই উপজেলার অধিকাংশ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে ফাটলও ধরে। বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভের ফলে তড়িঘড়ি করে ফাটলগুলো সিমেন্ট বালু দিয়ে বন্ধও করে দেয়া হয়। সব মিলেয়ে এই প্রকল্প থেকে অন্তত ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সিন্ডিকেট ও আওয়ামী পন্থী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করায় তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত করা হয়নি।
এছাড়াও পীরগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের থেকে মাসিক মাসোয়ারা নিতেন তিনি। ফলে তার দায়িত্ব থাকাকালীন এদের বিরুদ্ধে নাম কায়স্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়।
আদিবাসী নেতৃবৃন্দের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় ইউএনও বিরোদার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
রংপুর জেলার পীরগঞ্জের উপজেলা বড়পাহাড়পুর গ্রামের আদিবাসী দিনমজুর নিরঞ্জন কুজুরের উপর হামলা, অপহরণের হুমকিদাতাদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার, আহত পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং নিরাপত্তার দাবিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ পীরগঞ্জ উপজেলা কমিটির উদ্যোগে গত ৩১ আগস্ট ২০২২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিরোদা রানী রায় বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়া হলে তা গ্রহণ করেননি তিনি। স্মারকলিপির বদলে আবেদনপত্র দিতে বলেন তিনি। পরবর্তীতে আবেদনপত্র দিতে বাধ্য হন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। একই দিন দুপুরে ইউএনও’র ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং স্মারকলিপি বদলে আবেদনপত্র গ্রহণ করতে বাধ্য করায় তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।
পদাধিকার বলে চারটি ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি তিনি
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাধীন মেরুয়াখলা মমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, জগন্নাথপুর উপজেলাধীন হবিবপুর কেশবপুর ফাযিল মাদরাসা, সৈয়দপুর সৈয়দিয়া শামছিয়া ফাজিল মাদরাসা ও হুলিয়ারপাড়া জামেয়া কাদেরিয়া সুন্নিয়া ফাজিল মাদ্রাসার গভর্নিং বডির (এডহক কমিটি) সভাপতি এডিসি (রাজস্ব) বিরোদা রানী রায়। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত পদাধিকার বলে এই পদে রয়েছেন তিনি। ধর্মীয়ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোদা রানী রায় ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি হওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে যেমন রয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তেমনি বিরোদা রানী রায় এই দায়িত্ব পালনে রয়েছে অনেকাংশে অনিহা। শুধু মাত্র মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বিলে স্বাক্ষর করা ছাড়া গভর্নিং বডির কোনো মিটিং করেননি তিনি। অথচ মাদ্রাসার উন্নয়ন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান বৃদ্ধি ও দেখভাল করার জন্য কমিটি দেয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। মাদ্রাসাগুলো কিভাবে চলছে তার খোঁজ না নিলেও দুর্নীতিবাজ ও আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত অধ্যক্ষের পক্ষালম্বন কিভাবে করতে হয় তা ঠিকই করছেন অভিযোগ মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর। এ নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘এমপিও স্থগিত হওয়া মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে বহাল রেখেছেন এডিসি বিরোদা রানী রায়‘ শিরোনামে শিক্ষাবার্তা’য় সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের পর এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক। তবে আজ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেননি তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিরোদা রানী রায়ের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া মুঠোফোনে কল করলে তিনি মিটিংয়ে আছেন পরে কথা বলতে বলেন। পরবর্তীতে যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ বিষয়ে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) খান মোঃ রেজা-উন-নবীর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৯/০৪/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.