এইমাত্র পাওয়া

ছয়জনের রেংমিটচ্য ভাষা বাঁচিয়ে রাখার লড়াই

বান্দরবানঃ ম্রো জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সাধারণত নিজেদের মাতৃভাষা ‘ম্রো’তে কথা বললেও প্রায় সাত দশক আগে বান্দরবানে তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রেংমিটচ্য ভাষী কিছু মানুষ ছিলেন, যাদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ছয় থেকে আটজনে এসে ঠেকেছে।

এই হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ মারা গেলে রেংমিটচ্য ভাষাটিও চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে। এই বাস্তবতার মধ্যেই পাহাড়ের কিছু মানুষ নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছেন, যাতে ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে না যায়।

আড়াই দশকের বেশি সময়ের চেষ্টায় ম্রো ও বাংলাভাষা দিয়ে ভাষাটির নিজস্ব শব্দভাণ্ডার দাঁড় করিয়ে পুস্তক প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। রেংমিটচ্য ভাষাগোষ্ঠীর শিশুদের সেই ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে আলাদা ‘স্কুল কাম হোস্টেল’; যেখানে থেকে শিশুরা প্রতিনিয়ত ভাষাটি রপ্ত করতে পারে।

আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের গবেষক ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিলুপ্তপ্রায় এই ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে সমীক্ষা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, গবেষণা ও নথিবদ্ধ করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে।

বিপ্ন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলছিলেন, “রেংমিটচ্য ভাষার ডকুমেন্টশন করব আমরা। হয়ত রোজার ঈদের পর ওই এলাকায় (বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা) যাব। ডকুমেন্টশন করে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় দেখব। আসলে ভাষা বেঁচে থাকে তো তার ভাষীর মাধ্যমে। সেটাই করতে হবে।”

এসব উদ্যোগের কারণে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ভাষার তালিকায় শীর্ষে থাকা ‘রংমিটচ্য’ আবার জাতিগোষ্ঠীর মুখে মুখে ফিরবে এমন প্রত্যাশাই করেছেন ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষেরা।

পাহাড়ের ভাঁজে ভাষা-বুলি

বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স লফলার পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন ম্রো সম্প্রদায়ের ওপর কাজ করতে। পরে তার কাজের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড থেকে প্রকাশিত হয় ‘এথনোগ্রাফিক নোটস অন ম্রো অ্যান্ড খুমি অব দি চিটাগাং অ্যান্ড আরাকান হিল-ট্র্যাকটস’।

সেখানে লফলার লিখেছিলেন, আলীকদমের তৈন মৌজা এলাকায় রেংমিটচ্য নামে একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের ভাষা আলাদা ও স্বতন্ত্র। তবে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ম্রো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে যায়।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ডার্থমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন জার্মানির লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্সপাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর অ্যানথ্রোপোলজির ফেলোশিপ নিয়ে ১৯৯৯ সাল থেকে বান্দরবানে ভাষা নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। তিনি মূলত কুকি-চিন জাতিভুক্ত ভাষা নিয়ে গবেষণা করছিলেন।

গবেষণার অংশ হিসেবে ২০০৯ সালে অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন বান্দরবানে এসে জানতে পারেন রেংমিটচ্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের কথা। পরে তিনি রেংমিটচ্য ভাষাভাষীদের খুঁজে বের করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে আলীকদম উপজেলার কয়েকটি পাড়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ২২ নারী-পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যারা রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলেন। পরে অধ্যাপক ডেডিড এ পিটারসনের গবেষণার সহযোগী এবং ম্রো ভাষার লেখক ইয়াংঙান ম্রো সন্ধান চালিয়ে রেংমিটচ্য ভাষী আরও ১০ জনকে চিহ্নিত করেন। তখন সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩২ জনে। কিন্তু এদের অধিকাংশই ছিল বয়োবৃদ্ধ।

ফলে আট বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে এসে রেংমিটচ্যভাষী মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ছয়জনে। বাকিরা মারা যান। এই ছয়জন হচ্ছেন- আলীকদম সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ক্রাংসি পাড়ার বাসিন্দা মাংপুং ম্রো (৭৩), কুনরাও ম্রো (৬০), কুনরাও ম্রো (২) (৭৩); নয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ার বাসিন্দা থোয়াই লক ম্রো (৫৯), নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়নের ওয়াইবট পাড়ার বাসিন্দা রেংপুং ম্রো (৬৯) এবং সাংপ্ল পাড়ার বাসিন্দা মাংওয়াই ম্রো (৬৩)। এর মধ্যে কুনরাও ম্রো নামে দুজনই নারী, বাকিরা পুরুষ। অন্যদিকে মাংপুং ম্রোর মেঝ ভাই রেংপুং ম্রো এবং ছোট ভাই হল মাংওয়াই ম্রো।

সম্প্রতি রেংমিটচ্যভাষী আরও দুজনের সন্ধান পাওয়া গেছে উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। একজন হলেন চিপ্পী ম্রো (৫৫) এবং রুংরুং ম্রো (৬০)। তারা দুজনই পুরুষ।

চিপ্পী ও রুংরুংকে খুঁজে বের করেন রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করা সিংরা ম্রো।

তিনি বলেন, আলীকদম সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পায়া ম্রো পাড়ায় ২২টি পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে ১৫টি রেংমিটচ্য পরিবার আছে। তবে কেউ রেংমিটচ্য ভাষা জানে না।

পায়া ম্রো ছিলেন পাড়াপ্রধান কারবারী; মারা গেছেন তিনি। বিয়ে করেছিলেন রেংমিটচ্য ভাষার মেয়েকে। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। বয়স আশির কাছাকাছি। রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারেন। তবে ভালোভাবে পারেন না। অল্প করে রেংমিটচ্য ভাষা জানা এরকম আরও থাকতে পারে।

নতুন করে খুঁজে পাওয়া রেংমিটচ্যভাষী চিপ্পী ম্রো ও রুংরুং ম্রোর ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে সিংরা ম্রোর অভিমত, “শুরুতেই রেংমিটচ্য ভাষায় কেমন আছেন জিজ্ঞাস করলে রুংরুং ম্রো সেই ভাষাতেই আমাকে ভালোভাবে জবাব দেন। তখন তার পাশে ছিলেন চিপ্পী ম্রো। তিনি বলেন, তিনিও রেংমিটচ্য ভাষা জানেন।

“পরে চিপ্পীর সঙ্গে রেংমিটচ্য ভাষায় অনেকক্ষণ গল্প করলাম। তবে রুংরুং ম্রো তার মত করে ভালোভাবে বলতে পারেন না; মোটামুটি পারেন।

চিপ্পী ম্রোর বরাতে সিংরা ম্রো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ডার্থমাউথ কলেজের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এ পিটারসন যখন আলীকদমের কুরুকপাতায় এসেছিলেন তখন নাকি চিপ্পী ম্রোকে খোঁজে বের করেছিলেন। পরে আর যোগাযোগ হয়নি তাদের মধ্যে। অধ্যাপক ডেভিড হয়ত মনে করেছেন, চিপ্পী ম্রো মারা গিয়ে থাকতে পারেন।

‘হিমি রেংমিটচ্য তখক তামাক্ ওয়েট দক’

আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়নের তৈনখালের উজানে ক্রাংসি পাড়ার বাসিন্দা ও রেংমিটচ্য ভাষায় সবচেয়ে পারদর্শী ৭৩ বছর বয়সী মাংপুং ম্রোর ছেলে সিংরা ম্রো (৪৭)। তিনি লেখাপড়া করতে পেরেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ছোট থাকতে তার নানার সঙ্গে থাকার সুবাদে রেংমিটচ্য ভাষা বুঝতে পারেন। কিন্তু নিজের প্রচেষ্টায় কয়েক বছরে রেংমিটচ্য ভাষা রপ্ত করে ফেলেছেন তিনি। এখন বলতে পারেন মোটামুটি। বুঝতেও পারেন আগের তুলনায় ভালো।

রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ শুরুর অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সিংরা ম্রো বলেন, “কয়েক বছর আগে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে কাজ করতে একদল সাংবাদিক পাড়ায় এসেছিলেন। তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় বাবা রেংমিটচ্য ভাষায় একটা বাক্য উচ্চারণ করছিলেন, ‘হিমি রেংমিটচ্য তখক তামাক্ ওয়েট দক’। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে, ‘এই রেংমিটচ্য ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে’।

“আমি যেহেতু রেংমিটচ্য ভাষাটা বুঝতে পারি, কথাটা আমাকে খুব আহত করে। ভাবলাম, এ ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে নিজের মত করে রেংমিটচ্য ভাষার পরিবার কোথায়, কতজন আছে খোঁজ নিই। দেখি, আমার নিজের পাড়ার বাইরে আলীকদমে আমাদের এই তৈনখালের আশপাশে পাড়ায় আরও কিছু পরিবার পাওয়া যাচ্ছে। সময় ও অর্থের অভাবে সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া যায়নি। এগুলো সময়সাপেক্ষ কাজ। খুঁজলে হয়ত আরও পাওয়া যাবে। মাতামুহুরির উজানের দিকে কোথাও গেলে রেংমিটচ্য পরিবার আছে কিনা খবর নিই।”

সিংরা ম্রো তার অনুসন্ধানে খুঁজে পাওয়া রেংমিটচ্য ভাষা পরিবারের একটি তালিকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেন। তার দেওয়া তালিকা অনুসারে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া রেংমিটচ্য পরিবারগুলো হল- সদর উপজেলা সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পায়া পাড়ায় ১৫ পরিবার, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেনথং পাড়ায় পাঁচ পরিবার ও একই ওয়ার্ডের বলই পাড়ায় দুই পরিবার।

কুরুকপাতা ইউনিয়নের কাইংপা পাড়ায় দুই পরিবার, রেংবুক পাড়ায় পাঁচ পরিবার, ওয়াইবট পাড়ায় দুই পরিবার, নয়াপড়া ইউনিয়নের মেনসিং পাড়ায় ছয়-সাত পরিবার, সাক্লাং পাড়ায় এক পরিবার, মংপং পরিবার চার পরিবার, রাঅং কারবারী পাড়ায় পাঁচ পরিবার, দকখই পাড়ায় এক পরিবার, ক্রংলাইন পাড়ায় ছয় পরিবার ও পাতুই পাড়ার দুই পরিবারও এ ভাষা জানে।

এ ছাড়া আগে থেকে ক্রাংসি পাড়ায় সাতটি রেংমিটচ্য পরিবার ছিল। এসব পরিবারের জনসংখ্যা ২০০ জন হতে পারে বলে সিংরা ম্রোর ভাষ্য।

নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া রেংমিটচ্য পরিবারে মধ্যে এ ভাষা বলতে পারে এমন দুজন ম্রো পাওয়া গেছে বলে তার দাবি।

তৈনখালজুড়ে ছিল ভাষা-ভাণ্ডার

ক্রাংসি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, এ পাড়ার বাসিন্দা রেংমিটচ্য ভাষী মাংপুং ম্রো, কুনরাও ম্রো ও কুনারও ম্রো (২) তিনজনের বয়স বাড়লেও শারীরিকভাবে এখনও সুস্থ ও সবল। বেশ কথাবার্তাও বলেন। এখনও জুমচাষ করতে পারেন।

বেড়ে উঠার সময় ও সংসার জীবনে তৈনখালে রেংমিটচ্য ভাষার পরিবার কেমন ছিল জানতে চাইলে তারা জানান, ব্রিটিশ আমলে তৈনখালজুড়ে রেংমিটচ্য ভাষী লোকজনের পাড়া ছিল। তখন পাড়াগুলোও ছিল বড়।

তাদের দেওয়া হিসাবে, সে সময় রেংমিটচ্য ভাষার পরিবার ছিল- বুনছো পাড়ায় ২০ পরিবার, রাণি পাড়ায় ৮০ পরিবার, কুয়ারাও পাড়ায় ৮০ পরিবারের মত, কুইকি পাড়ায় ৫০ পরিবারের মত, হাইওয়ং পাড়ায় ৩০ পরিবার, সারাক তং পাড়ায় ৪০ পরিবার, নিআং পাড়ায় ৩৫ পরিবার ও সাংথং পাড়ায় ৭০ পরিবার।

মাংপুং ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, তার জন্ম বুনছো পাড়ায়। সে সময় পানি সংকট ও কলেরার কারণে পাড়া ছেড়ে চলে যান। বাবা-মা দুজনই রেংমিটচ্য ভাষাগোষ্ঠীর ছিলেন। তারা দুজনই রেংমিটচ্য ছাড়া ম্রো ভাষা বলতে পারতেন না। এ ছাড়া নানা-নানীও রেংমিটচ্য ভাষার পরিবার ছিল। এ কারণে রেংমিটচ্য ভাষা সহজেই ভুলে যাননি।

কুনরাও ম্রো (৬০) জানান, তার মা ছিল রেংমিটচ্য ভাষা পরিবারের লোক। আর বাবা ছিল ম্রো।

কুনরাও ম্রো (২) (৭৩) জানান, তার স্বামী ছিলেন ম্রো। ২৪ বছর আগে তিনি মারা গেছেন। তবে তিনি রেংমিটচ্য ভাষা বলতে পারতেন। স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে কোনো সময় ম্রো ভাষা, কোনো সময় রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলা হত।

এখনও কুনরাও ম্রোর সঙ্গে দেখা হলে একটানা রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলা হয়। ঘরে এখন চারজন নাতি আছে। এক সঙ্গে ঘুমাই। তাদের সঙ্গে সবসময় রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলি।

কুনরাও ম্রো (২) বলেন, “নাতিরা এখন রেংমিটচ্য ভাষায় নিজের নাম এবং বাবা-মার নাম বলতে পারে। গাণিতিক সংখ্যাও গুনতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা কথাগুলো বলতে পারে। নাতিরা আগ্রহ নিয়ে এ ভাষা শিখছে। এটা জেনে আমার ভালো লাগছে।”

ভাষা: কলেরা ও জুম

একসময় আলীকদমের তৈনখালের উজানে যেসব রেংমিটচ্য ভাষার পরিবার ছিল, এখন আর সেভাবে নেই। বর্তমানে যেসব রেংমিটচ্য পরিবার আছে তারাও সে ভাষায় কথা বলতে পারে না। তবে এ ভাষায় কথা বলতে না পারলেও রেংমিটচ্য পরিবার আরও থাকার কথা।

এ ব্যাপারে ক্রাংসি পাড়ার রেংমিটচ্য ভাষার লোকজনের সঙ্গে আলাপে তাদের লোকজন কমে যাওয়ার বেশ কিছু কারণ উঠে আসে।

ক্রাংসি পাড়ার বাসিন্দা সিংরা ম্রো বলেন, “আমাদের রেংমিটচ্য ভাষার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেড় মাস আগে জানতে পেরেছি, এই ভাষা পরিবারের মধ্যেও ছয়টা গোত্র রয়েছে। সেগুলো হল ‘থাংদপ চা’, ‘মতক্ চা’, ‘খংতর’, ‘সুং পং চা’ এবং ‘তাম তো চা’।

“আবার ‘খংতর’ গোত্রের মধ্যে দুইটা ভাগ রয়েছে- ‘খংতর’ ও ‘খংওয়ে’। ‘খংতর’রা হল সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী (পরিবার সংখ্যা বেশি) এবং সবচেয়ে ছোট গোষ্ঠী হল ‘সুং পং চা’ গোষ্ঠী।”

তিনি বলেন, “এখন সমস্যা হল ছয়টা গোত্রের মধ্যে সবার সঙ্গে সবার বিয়ে করার নিয়ম নেই। যেমন ‘থাংদপ চা’ গোষ্ঠীর কোনো ছেলে ‘মতক্ চা’ গোষ্ঠীর কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না। আবার ‘খংতর’ গোষ্ঠীর কোনো ছেলে ‘থাংদপ চা’ গোষ্ঠীর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু ‘থাংদপ চা’ গোষ্ঠীর ছেলে ‘মতক চা’ গোষ্ঠীর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে না।”

সিংরা ম্রো বলেন, এভাবে গোত্রভেদে কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে বিয়ে করতে পারে না। কেউ অমান্য করে বিয়ে করলে তাকে সামাজিক শাস্তি ভোগ করতে হয়। সামাজিক শাস্তিটা হল, সমাজের বাইরে রাখা। তাকে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে হয়। এ কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে ম্রোকে বিয়ে করেছে এবং তাদের মধ্যে মিশে গেছে। যার কারণে এ ভাষার লোকজনের সংখ্যা কমে গেছে।

সিংরা ম্রোর বাবা রেংমিটচ্য ভাষী মাংপুং ম্রো বলেন, তখনকার সময় কলেরা মহামারী লেগে থাকত। ডায়রিয়াও হত। এমন সময় গেছে, এসব রোগের প্রাদুর্ভাবে কোনো কোনো পরিবারের সবাই মারা গেছে। কোনো পরিবারে দেখি প্রতিদিন চার-পাঁচটা লাশ ফেলে দিচ্ছে। এতে কেউ কেউ ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউ ম্রোকে বিয়ে করে তাদের মধ্যে মিশে গেছে।

আবার কেউ কেউ জুমচাষকে কেন্দ্র করে অন্য কোথাও চলে গেছে। সে সময় থেকে যে যার মত করে ছড়িয়ে গেছে। আর বাকি যারা রয়ে গেছে তাদেরও কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। এভাবে করে রেংমিটচ্য ভাষার লোকজন কমে গেছে।

একলা চল রে

রেংমিটচ্য ভাষা রক্ষায় ২০২৩ সালে পাড়ার ২৩ শিশুকে নিয়ে নিজের ঘরে পড়ানোর উদ্যোগ নেন সিংরা ম্রো। পর্যায়ক্রমে আরও বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। খবর পেয়ে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের পক্ষ থেকে পাড়ায় ‘ক্রাংসি পাড়া সেনা মৈত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে বাঁশ-কাঠ ও টিনের বেড়া দিয়ে একটা স্কুল নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

২০২৪ সালে ১০ মার্চ স্কুলটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম মহিউদ্দিন আহমদ। বর্তমানে স্কুলে মোট ৫০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের রেংমিটচ্য ভাষা পড়ান সিংরা ম্রো নিজেই। বাংলা পড়ান পাইত্র ম্রো নামে একজন শিক্ষক। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সম্মানি হিসেবে সিংরা ম্রো পান চার হাজার টাকা। বাংলা শিক্ষক পাইত্র ম্রোকে দেওয়া হয় তিন হাজার টাকা।

নিজের ঘর বাননোর জন্য রাখা বাঁশ-কাঠ স্কুল তৈরির কাজে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সিংরা ম্রো বলেন, স্কুলে সময় দিতে গিয়ে গত বছর ঠিকমত জুমচাষও করতে পারেননি। এক হাড়ি ধানে ৫০ হাড়ি ধান পাওয়া গিয়েছিল। তাও দুই-তিন মাস খাওয়ার পর শেষ।

“এখন বাজার থেকে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। ঠিকমত জুমচাষ করতে না পারার কারণে খাবার ও আর্থিক সংকটে পড়েছি। এ বছর এখনও জঙ্গল কাটা যায়নি। রেংমিটচ্য ভাষা রক্ষার উদ্যোগ নিতে গিয়ে উভয় সংকটে পড়েছি এখন। একদিকে সংসারে রোজগারের বিষয়, অন্যদিকে ভাষা রক্ষার দায়িত্ব।”

সিংরা ম্রো বলছিলেন, “হোস্টেল করা হলে শিশুরা একসঙ্গে থেকে রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলার সুযোগ পাবে। এ ভাষার চর্চা বাড়বে। এ পাড়ার বাইরে যে তিনজন রেংমিটচ্যভাষী আছে; প্রয়োজনে তাদেরকেও এখানে নিয়ে এসে শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু তার জন্য এখনও সরকারি কোনো সংস্থা এগিয়ে আসেনি।”

‘গবেষণা নয়, ভাষা টেকে মানুষে’

বিলুপ্তপ্রায় রেংমিটচ্য ভাষা কীভাবে সংরক্ষণ ও টিকিয়ে রাখা যায় এ নিয়ে আয়ারল্যান্ডের ‘ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিন’-এ পিএইচডি গবেষণা করছেন আফসানা ফেরদৌস আশা। তিনি বাংলাদেশে নর্থ সাউথ ইউনির্ভাসিটিতে ইংরেজি ও আধুনিক ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক।

রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে তার গবেষণার কাজে তত্ত্বাবধান করছেন আয়ারল্যান্ডের স্কুল অব লিঙ্গুইস্টিকস, স্পিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন সায়েন্সের অধ্যাপক ও ট্রিনিটি সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ড. নাথান হিল।

আফসানা ফেরদৌস আশা বলছিলেন, ২০২৪ সালে মে মাসে তৈনখালের ক্রাসংসি পাড়ায় গিয়ে তিনি একটানা সাত দিন থেকে কাজ করেন। তখন মনে হয়, এ ভাষা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আরও গবেষণা করা দরকার।

“প্রথমে জার্মান নৃবিজ্ঞানী লরেন্স লফলার এবং পরে ডেভিড এ পিটারসন সামনে না আনলে এ ভাষা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হত না। রেংমিটচ্য নামে যে একটা ভাষা আছে তারাই মূলত আলোচনায় নিয়ে আসেন। এখন নিবিড়ভাবে গবেষণা করে এটাকে সংরক্ষণ করে কীভাবে রক্ষা করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে।

“এ ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য এখন আমি মূলত রেংমিটচ্য ভাষার ডকুমেন্টশন (তথ্যচিত্র) নিয়ে কাজ করি। রেংমিটচ্য ভাষী হিসেবে যারা বেঁচে আছেন তাদের মৌখিক কথাগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। এসব কাজের জন্য পরবর্তীতে সেখানে গিয়ে একটানা ছয়-সাত মাস থাকতে হবে। পরে এ ভাষার শব্দ নিয়ে টেক্সট বই বের করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মকে এ ভাষা শেখাতে হবে। এভাবে করে যত কাজ হবে তত বেশি এ ভাষা টিকবে। তা না এ ভাষা একসময় হারিয়েই যাবে।”

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিউিটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ইন্সটিটিউট মূলত বিপন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করে। ভাষার গবেষণা করা, নথিবদ্ধ করা, সংরক্ষণ করা- এটাই হচ্ছে প্রধান কাজ। বাংলাদেশে ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে রেংমিটচ্য ও ‘খাড়িয়া’ ভাষা আছে সবচেয়ে বিপদে। কারণ তাদের জনসংখ্যা খুবই কম। বিশেষ করে এই প্রজন্ম তাদের ভাষা ব্যবহার করে না।

“তবে গবেষণা করে আসলে ভাষা টেকানো যায় না। গবেষণা করে যেটা করা যায়, সেটা হল ভাষা সংরক্ষণ করা যায়। ভাষার যাদুঘরে রাখা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য রাখা যায়। ভাষা টিকে থাকে ওই ভাষীর মুখে- এটাই বাস্তবতা।”

অধ্যাপক আসাদুজ্জামান বলেন, “এখন রেংমিটচ্য ভাষা সম্প্রদায়ের যে লোকজন আছে তারা এ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। কারণ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা কারণে। এ ভাষা শিখে তো তাদের লাভ হচ্ছে না। স্কুল-কলেজে পড়তে পারে না। চাকরি পাচ্ছে না। এটাই মূল কারণ। তাদের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম আগে যেরকম ছিল এখন সেটাও নেই।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/২১/০২/২০২৫ 


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.