ঢাকাঃ অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরির দীর্ঘ দিনের দাবি রয়েছে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর। যে আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে সমান অধিকার থাকবে। তবে সংবিধান সমতার কথা বললেও সমাজে অসমতা থেকে যাচ্ছে। এই অসমতা দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোও পদক্ষেপ নেয়নি। সংবিধান ও আইনে এসব বৈষম্য দূর করতে পরিবর্তন চেয়ে সুপারিশ করতে যাচ্ছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।
সম্পদ-সম্পত্তি, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদে নারীকে সমান অধিকার দেওয়া, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ বন্ধ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার মতো বড় ধরনের সুপারিশ আসছে।নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিটি স্তরের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্য ছিল গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও)। ২০০৮ সালে নিবন্ধন নেওয়ার সময় দলগুলো তা পূরণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল; কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পূরণ করতে পারেনি নিবন্ধিত দলগুলো। এখন ২০৩০ সালের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আরপিও সংশোধন হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশে নারী প্রতিনিধিত্ব ৪০ শতাংশের বেশি বা সমানসংখ্যক রাখার কথা বলা হতে পারে এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে মিল রেখে জাতীয় সংসদে নারীর জন্য ১০০ সংরক্ষিত আসন রেখে তাতে সরাসরি নির্বাচনের সুপারিশ থাকতে পারে বলে জানা গেছে।
নারী সংস্কার কমিশনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে আন্দোলনও করেছেন। তাঁরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন কিছু হলেও পরিবর্তন করে যায়, সে চেষ্টা তাঁদের থাকবে।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধান, আইন ও সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নারীর প্রতি যত ধরনের বৈষম্য রয়েছে, তার নিরসন চাইব আমরা। সে লক্ষ্যেই এ মাসের শেষে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ জমা দেব। কিছু সুপারিশ থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য, কিছু সুপারিশ থাকবে পরবর্তী সময়ে যে সরকার আসবে, সেই সরকারের জন্য। এই কমিশন হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল। তাই নারীর জীবনে যত প্রকার বৈষম্য রয়েছে, তা নিরসনে সুপারিশ করা হবে।’
তবে সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে এই সময়ে খসড়া সুপারিশে ঠিক কী কী রয়েছে, তা তিনি বিস্তারিত জানাতে চাননি।
নারী সংস্কার কমিশন গঠনের আগে গত বছরের ২০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল নারী সংগঠনগুলো। ওই সময় ‘নারীপক্ষ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হক আলোচনায় নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিলেন। ওই সময় নারীপক্ষের সুপারিশের মধ্যে ছিল নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন যেমন-মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫, অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ ও নাগরিকত্ব আইন ১৯৫১ সংস্কার করে নারীর পারিবারিক ও জনজীবনে সম–অধিকার নিশ্চিত করা। নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কাজ না করে নারী অধিকার কমিশন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তথ্য অধিকার কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো কমিশনগুলোর যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তা তারা দলীয় সরকারের সময়ে চাপে পড়ে পালন করতে পারেনি, তা উল্লেখ করে সংগঠনগুলো নারী অধিকার কমিশন করার প্রস্তাব করে।
ওই প্রস্তাবগুলো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশে থাকবে কি না, জানতে চাইলে শিরীন হক বলেন, ‘হয়তো থাকবে।’
জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ১০টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ৬টি কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেসব প্রতিবেদনে নারীর বিষয়গুলো কীভাবে রাখা হয়েছে, সেটিও দেখছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন।
সমতার ক্ষেত্রে আইনে যা বাধা
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে—যেমন ১৯(১), ১৯(৩), ২৮(১) ও ২৮(২)-এ সর্বজনীন নীতির অধীন নারীর সমতা এবং সব ক্ষেত্রে সমান অংশগ্রহণের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে সংবিধান রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনে সমান অংশগ্রহণের কথা বললেও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনকেও স্বীকৃতি দেয়। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত এবং উত্তরাধিকার পারিবারিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
চার দশক আগে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সনদ ‘নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ (সিডও)’ অনুমোদন করলেও ২ ও ১৬.১(গ) ধারার ওপর সংরক্ষণ রেখেছে বাংলাদেশ। সনদের ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
কোনো সরকার এ দুটি ধারার ওপর সংরক্ষণ প্রত্যাহার করেনি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ গ্রহণ করে। ওই নীতিতে সম্পত্তিসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকারের কথা বলা ছিল। তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে ওই নারী নীতি বাতিল করে। জোট সরকার যে নারী নীতি করে তাতে সম্পত্তিতে সমান অধিকার ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আবার আগের মতো সমতা রেখে নারী নীতি করে। তবে পরে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে। এরপর থেকে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পারিবারিক আইনের অসমতার বিষয়গুলোতে কোনো পরিবর্তন আনতে আগ্রহ দেখায়নি।
ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি বৈষম্য রয়েছে—এমন সব আইন ও কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার উদ্যোগকে সমর্থন করে মহিলা পরিষদ। দেশের সব ধর্মের নাগরিকের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন নিশ্চিত করার দীর্ঘ দিনের দাবি রয়েছে মহিলা পরিষদের। এবার নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠকেও সংগঠন সম্পদ-সম্পত্তিতে, বিবাহ বিচ্ছেদে, সন্তানের অভিভাবকত্বে সমান অধিকার চেয়েছে। দত্তক আইন প্রণয়ন করে তাতে নারীর সমান অধিকার চেয়েছে।
ফওজিয়া মোসলেম মনে করেন, নাগরিক হিসেবে নারীর ব্যক্তিগত জীবনে সমান অধিকার থাকা প্রয়োজন। তা না হলে নারী যতই ওপরে উঠুক না কেন, তার মর্যাদা থাকে না। এই মর্যাদা না থাকার কারণে পুরুষ নারীকে অধীন মনে করে এবং নির্যাতনের নানা ঘটনা ঘটে। ব্যক্তিজীবনে নারীর এই অধিকার নিশ্চিত হলে নারীর প্রতি সহিংসতাও কমে আসবে।
ফওজিয়া মোসলেম আরও জানান, নারীর রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদের আসনসংখ্যা ৪০০ করে নারীর জন্য ১৫০ আসন সংরক্ষিত রেখে তাতে সরাসরি নির্বাচন চেয়েছেন তাঁরা।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হক বলেন, তাঁরা বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে ঢাকায় ১৩টি এবং ঢাকার বাইরে ৭টি জেলায় সভা করেছেন।
গত ১৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১০ সদস্যের নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। শিরীন হককে প্রধান করে গঠিত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারীস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আখতার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, নারীপক্ষের পরিচালক কামরুন নাহার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা ফেরদৌসী সুলতানা ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নিশিতা জামান নিহা।
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৫/০২/২০২৫
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.