অচিন্ত্য রায় চৌধুরীঃ শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি সরকারেরই কিছু এজেন্ডা থাকে। বিগত সরকারেরও ছিল। গুণগত মান যাই হোক, সংখ্যাগত মান বাড়াতে হবে। দেখাতে হবে শিক্ষার্থী কতটা শিখেছে তা নয়, কত বেশি শতাংশ পাস করেছে। এরই ফলস্বরূপ শিক্ষার হার বছর বছর বৃদ্ধি পায়। ১৯৯১ সালে যা ছিল ৩৫.৩২ শতাংশ, ২০২১ সালে এসে তা হয়েছে ৭৬.৩৬ শতাংশ। তবে সমতুল্য দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানে এ হার শতভাগ। শ্রীলঙ্কায় ৯২.৪৩ ও কঙ্গোতে ৮০.৬১ শতাংশ।
যা হোক, গুণগত মান বিচারে বিশ্বায়নের এই যুগে টিকে থাকার জন্য আমরা কতটা যুগোপযোগী। আমরা যে শিক্ষক প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে পাচ্ছি তারা কত শতাংশ সত্যিকারের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানসম্পন্নবা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন? সদর্থক কোনো উত্তর নেই।
শিক্ষার ধরন নিয়েও কোনো সামঞ্জস্য নেই। যেমন কোনো এক সরকার বলল, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এই জ্ঞান থাকলে বেকার থাকবে না। শুরু হলো মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া। অবকাঠামো উন্নয়ন, যন্ত্রপাতি ক্রয়, টেকনিক্যাল শিক্ষা ইত্যাদি মহাকর্মযজ্ঞ। কয়েক বছর পর দেখা গেল শতাংশের হারে মেলানো যাচ্ছে না। কোথায় যন্ত্রপাতি, ফ্যান, চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাব তার কোনো হদিস নেই। আবার কোনো সরকার সিদ্ধান্ত নিল, শুধু কারিগরি শিক্ষা হলেই চলবে না; পাশাপাশি ব্যবসা শিক্ষার দরকার আছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। তার মানে আবার আরেকটা মেগা প্রকল্প হাতে নিতে হবে। কারণ শিক্ষা বলে কথা। মেগা প্রকল্প ছাড়া তো আর চলবে না।
বলা হলো, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাই পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করা দরকার, যাতে পরীক্ষাভীতির কারণে ছাত্রছাত্রীরা ঝরে না পড়ে। কিছু জানল বা শিখল কিনা, তার দরকার নেই। অটো পাস দেওয়া হোক। আবার সিদ্ধান্ত হলো, কারিগরি, ব্যবসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের আইটি বিশেষজ্ঞ হতে হবে। সুতরাং নতুন নতুন প্রকল্প। সব শিক্ষার্থীর হাতে ট্যাব, মোবাইল ফ্রি দেওয়া হবে। ছাত্রছাত্রীদের শাসন করা যাবে না। বাবা সোনা বলে বলে শেখাতে হবে। খুবই সুন্দর। তার জন্যও প্রকল্প। তা হলো, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে স্কুলে আনতে হবে। তাদের দুপুরবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা দরকার। এসব কারা করবে? শিক্ষকরা করবেন। কিন্তু যারা স্কুলে উপস্থিত আছে তাদের পাঠদান কারা কখন করবেন, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
যেহেতু শিক্ষকরা ব্যস্ত, সেহেতু উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা কী করবে? কেন, খেলাধুলা করবে! স্বাস্থ্য সুখের মূল। আবার শুনছি ধর্মীয় শিক্ষা যেটুকু আছে এতে কাজ হবে না। আরও বিস্তারিত জানতে হবে। সামাজিক অবক্ষয়ে যে দেশের মানুষ নিমজ্জিত। এর মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষা বিদ্যমান। সুতরাং প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন। এভাবে শিক্ষা বারবার ঢুকেছে অপারেশন থিয়েটারে।
আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার সুযোগ কত শতাংশ পাচ্ছে? সেই সব ছাত্রছাত্রীর কত জন দেশে থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে? সবাই বিদেশমুখী। একবার বিদেশে পড়তে গেলে তারা আর দেশে ফেরে না। তাহলে দেশ আজ কেমন প্রজন্ম উপহার পাচ্ছে?
অন্যদিকে কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এখন তো কোচিং সেন্টারগুলোই আসল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেটা ইংরেজি, বাংলা উভয় মাধ্যমেই। এখন ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে কোচিংয়ের প্রতি ঝোঁক বেশি। স্কুলের শিক্ষার প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। শিক্ষকরাও তাদের কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশি মনোযোগী। অনেকটা সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখার মতো। তাহলে তো শিক্ষা সেবা নয়, বাণিজ্য।
শিক্ষাকে বাণিজ্য নয়, সেবা মনে না করলে আজকের এই কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্ত, ছাত্রাবস্থায় ক্ষমতার দাপট দেখানো, সহজ পন্থায় বেশি অর্থ উপার্জন, রাতারাতি ধনী হওয়ায় প্রবণতাসহ সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় এসব বাড়তে থাকবে। দেশের বাইরে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকবে।
আসলে প্রয়োজন হলো, দেশে অবকাঠামোসহ যা যা ব্যবস্থা আছে সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা, পাশাপাশি শিক্ষা খাতে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্য হতে না দেওয়া এবং শিক্ষকের উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও সামাজিক মর্যাদার ব্যবস্থা করা। তাহলেই সুশিক্ষা অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।
সর্বোপরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে বারবার অপারেশন থিয়েটারে না পাঠিয়ে, ফরমালিনমুক্ত রেখে তাকে গুণগত পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/১৬/১২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.