এইমাত্র পাওয়া

সত্যি কী, শিক্ষকতা পেশা মেধাবীদের টানছে না!

আমির আসহাব: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিশাল একটা অংশ বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালে গঠিত হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। ২০১৫ সালে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ (স্বজনপ্রীতিও ঘুষবাণিজ্য) বন্ধ করে, এনটিআরসিএ-কে সেন্ট্রালি নিয়োগ সুপারিশের অনুমতি প্রদান করে মন্ত্রণালয়। তাই সবাইকে নিয়ে মেধা তালিকা করায়, কোনো কোনো ব্যাচ লাভবান হলেও কোনো কোনো ব্যাচের একেবারে বিনা কারণেই সর্বনাশ হয়ে যায়। পদ্ধতির পরিবর্তন হলে মূল্যায়নের সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়।সেগুলো সমন্বয়ের জন্য যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে উত্তীর্ণ এক ঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়ার কাজটা সহজ ও স্বচ্ছ হওয়ার কথা। কিন্তু এনটিআরসিএ’র দায়িত্বহীনতা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিছু কার্যক্রমে সব কিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

এনটিআরসিএ’র ভুল:
১. অন্য দশটি পরীক্ষার মতো শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিবন্ধিত শিক্ষকদের ইউনিক আইডি (রোল) প্রদান না করা ৷
২. কম্বাইন্ড মেরিট তালিকা প্রণয়ন করা হলেও পিক এন্ড চুস পদ্ধতিতে নিয়োগ সুপারিশ করা ।
৩. যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও নতুন প্রার্থী খোঁজা এবং ক্রমানয়ে অপেক্ষমান যোগ্যদের তালিকা দীর্ঘায়িত করা।
৪. কম্বাইন্ড মেরিট তালিকায় ১-১৭টি ব্যাচে উত্তীর্ণদের এড করা হয়।কিন্তু সুপারিশ প্রাপ্ত ইনডেক্সধারীদের তালিকা বর্হিভূত বা পৃথক করা হয়
না ।
৫. নিবন্ধিত সনদ সংখ্যা ৬ লক্ষ অতিক্রম করলেও প্রকৃত চাকরি প্রত্যাশী (৪র্থ গণবিজ্ঞপ্তি অনুসারে স্কুল-কলেজের বিপরীতে ৮১ হাজার ) সরকারি বাজেটের অন্তরায় দেখিয়ে দ্বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। অপরদিকে কৃত্রিম শিক্ষ সংকট তৈরি করে প্রার্থী খোঁজার নামে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সনদপ্রদানকে ব্যবসায় রুপান্তর করেছে।

এনটিআরসিএ’র দুর্নীতি:
১. বিভিন্ন দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার তথ্যমতে এনটিআরসিএ চেয়ারম্যানের ড্রাইভার ও সিস্টেম অ্যানালিস্ট দায়িত্বশীলদের যোগসাজসে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ২ লাখ টাকায় উচ্চমার্কের সনদ প্রদান এবং ৬ লাখ টাকায় নিয়োগ সুপারিশ করে প্রকান্তরে বৈধ সনদধারীদের নিয়োগ বঞ্চিত করে রেখেছে।
২. নিয়োগের উদ্দেশ্যে সব শর্তে উত্তীর্ণদের শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানে সুপারিশের উদ্দেশ্যে (গণবিজ্ঞপ্তিতে) নির্ধারিত ফি-এর বিপরীতে আবেদন গ্রহণ করে এনটিআরসিএ। অথচ প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনকৃত প্রার্থীর আবেদনের বিপরীতে শুন্যপদ পূরণ না করে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞতিতে আবার ঐসব পদে শিক্ষক চাহিদা নেওয়া হয়। একইভাবে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফাঁকাপদে তৃতীয়তে, তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির ফাঁকাপদে চতুর্থ। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিও এর ব্যতিক্রম নয়।
৩. ২০১৬ সালে ১৬০০০ পদের প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে পদ্ধতিগত ভুলের কারণে উপজেলা ভিত্তিক একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হন। নিজ উপজেলার একজন নিয়োগ প্রাপ্ত হলেও বাকী পদগুলো শূন্য থাকে। ২০১৮ সালে প্রায় ৪০ হাজারের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রায় ৩৪ হাজার শিক্ষকের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ইনডেক্সধারী। ২০২০ সালে ৫৪ হাজার ৩০৪ টি পদের বিপরীতে প্রকাশিত হয় তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি। তৃতীয় চক্রে জয়েন করেন (ইনডেক্সধারী ব্যতিত) মাত্র ১২ হাজারের মতো। পদ শূন্য থাকে প্রায় ৪০ হাজারের উপরে। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির পরও দেখা যায়, ৬৮ হাজার শুন্য পদের মধ্যে আবারও ফাঁকা থাকে ৪০ হাজার। বছরের পর বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাহিদা দিয়েও শিক্ষক পাচ্ছে না, অথচ পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির ৯৭ হাজার শূন্যপদের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার
পদ।
৪. বিচার বিভাগের রায়কে ভায়োলেন্স করে ক্ষেত্রবিশেষ ঢাল হিসেবে ব্যবহার (মামলার আপিল বা রিভিউ সচল) করে এবং বিদ্যমান আইনের বাইরে কিছু করার নেই অযুহাতে কালক্ষেপণ করেছে এবং প্রকান্তরে দ্বিতীয়, চতুর্থ এবং পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেবৈধ সনদধারীদের নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রম হতে বঞ্চিত করেছে।

এনটিআরসিএ’র সিষ্টেম-দুর্নীতি:
ভুয়া মুক্তি যোদ্ধার চেয়ে অধিক ক্ষতিকর অবৈধ সনদ ও আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত অবৈধ শিক্ষক দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্রকে কলুষিত করেছেন, অপর দিকে প্রকৃত মেধাবীদের করেছেন বঞ্চিত। ভুক্তভোগী প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন ৫ জুন, ২০২২ ইং থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০০ দিন শাহবাগে সকাল-সন্ধ্যা আন্দোলন করে তৎকালিন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনির সাথে আলোচনার টেবিলে এনটিআরসিএ’র দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরলেও তিনি ভুক্তভোগীদের বিপরীতে অবস্থান নেন। শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মহান জাতীয় সংসদে (৯৭ হাজার শূন্যপদে ১৯ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রেখে) গত ৬ মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন বলে মিথ্যাচার করেন। পিক এন্ড চুস পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় প্রার্থী হাজার হাজার আবেদন করেও নিয়োগ বঞ্চিত। এনটিআরসিএ’র এ কৌশলগতচরম রসিকতার বিরুদ্ধে নিবন্ধিত শিক্ষকদের দীর্ঘ ২০০ দিনের আন্দোলনের ফলে শিক্ষক নিয়োগের অনুসরণীয় প্রদ্ধতির ৭ নং পয়েন্ট (ইনডেক্সধালীদের আবেদনের সুযোগ) স্থগিতের মাধ্যমে এন্ট্রিলেভেলের শিক্ষক দ্বারা সকল পদ পূরণের লক্ষ্যে নিয়োগ আবেদনেরও পরিবর্তন আনে এনটিআরসিএ। একজন প্রার্থী স্কুল-কলেজ এই দুই লেভেলের জন্য দুইটি আবেদন করতে পারবেন এবং প্রত্যেক আবেদনের বিপরীতে চল্লিশটি প্রতিষ্ঠান চয়েস থাকবে। কেউ কলেজ নিবন্ধনের বিপরীতে নির্বাচিত না হলে স্কুল নিবন্ধনের বিপরীতে বিবেচনা করা হবে। এই দুইটি প্রক্রিয়ায়ও যদি নির্বাচিত না হয় তবে, শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে সারা বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে ইচ্ছু হলেও থাকবে “ইয়েস অপশন”।

কিন্তু চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির প্রাথমিক সুপারিশে দেখা গেল, ৬৮ হাজার শুন্য পদে সুপারিশ পেল মাত্র ২৭ হাজার, চূড়ান্ত নিয়োগ পেল আরও কম । আবারও পদ ফাঁকা থাকল ৪০ হাজারের উপরে। ধরা যাক- ‘ক’ নামক ব্যক্তি স্কুল ও কলেজ উভয় নিবন্ধনের বিপরীতে আবেদন করেছে। ‘ক’-এর আবেদনকৃত কলেজ শাখার ৯টি প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল শাখার ১১ টি প্রতিষ্ঠানে পদ ফাঁকা থাকে। ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতেও শিক্ষক চাহিদার আবেদন নেওয়া হচ্ছে ঐ ফাঁকা পদগুলোর জন্য। এক আবেদনের ৪০টি চয়েজ এর মধ্যেই যদি পদ ফাঁকা থাকে তাহলে “ইয়েস অপশন” রাখার যৌক্তিকতা কী?

এছাড়াও একাধিক ব্যক্তির এবং একাধিক ব্যাচের একই বিষয়ের একই রোল রয়েছে। রোল একই হওয়ায় প্রকৃত পক্ষে উচ্চমার্কের ( বৈধ বা অবৈধ সনদে একই) ব্যক্তি বারবার সুপারিশ প্রাপ্ত হন। সুপারিশকৃত ব্যক্তি ইনডেক্সধারী বা অবৈধ সনদধারী হলে চূড়ান্ত সুপারিশ থেকে প্রাথমিক সুপারিশকৃত ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ শূন্যপদগুলো আবেদনকৃতদের মধ্য থেকে পূরণ করা হয় না। এভাবে একই রোলের বাকিরা প্রতিবারই নিয়োগ সুপারিশ বঞ্চিত হয়।
এ রকম গল্প শুধু ‘ক’-এর একার নয়। সবচেয়ে দুঃখজন এটাযে, একই ব্যক্তিকে কেন একই প্রতিষ্ঠানে প্রতি গণবিজ্ঞপ্তিতেই আবেন করতে হবে?

এনটিআরসিএ যে উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল তা যথাযথ ভাবে অনুসরণ না করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দায়িত্ব অবহেলাসহ উদ্দেশ্য প্রণোধিতভাবে যুগোপযোগী শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিকে বিতর্কীত করেছে এবং কেউ কেউ এখনো করে যাচ্ছে। প্রশ্নফাঁস বা অবৈধ সনদের উৎস এবং কৃত্রিম শিক্ষক সংকটে জড়িত অসাধু ব্যক্তির ব্যাপারে কঠোর ও যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার । ইতোমধ্যে নিবন্ধন সনদ অর্জন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় বারবার নিয়োগ বঞ্চিত তাদের নিয়োগের সুব্যবস্থা না করে, নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী খুঁজে তাদের দ্বারা পূর্ববর্তী শূন্য পদগুলো পূরণ করতে পাশের হার বৃদ্ধি করা বা কাটমার্ক কমানো শুধু অমানুবিকই নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতও বটে।

মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশা টানছে না, কথাটি মুখ্য নয় গৌণ। শিক্ষক সংকট দূর করতে এনটিআরসিএ’র হাতে পর্যাপ্ত শিক্ষকও আছে। বছরের পর বছর চাহিদা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক পাচ্ছে না। অপরদিকে নিয়োগ বঞ্চিত বৈষম্যের শিকার ২১৭৬ জন । নিয়োগের জন্য বারবার আন্দোলন করছে। বর্তমানে শূন্যপদ ৭৮ হাজার। জাল সনদে চাকরিরতদের চাকরিচ্যুত এবং প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সঠিক শূন্যপদের চাহিদা নিলে শুন্যপদ প্রায় দেড় লাখের উপরে হবে। বর্তমানে আগামী তিন বছরের শূন্যপদের চাহিদা নেওয়া হচ্ছে। এতে শূন্যপদ দুই লক্ষ ছাড়িয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষকের এমএড-বিএড এবং শিক্ষক নিবন্ধন সনদসহ পিডিএস আইডি থাকা সত্ত্বেও হচ্ছেন বৈষম্যের শিকার। গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চত করণসহ শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে। শিক্ষকদের শতভাগ বেতন-ভাতা প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের উদ্দৌগ্য নিতে হবে। কিন্তু তারও আগে এনটিআরসিএ’র কৌশলে বারবার নিয়োগ বঞ্চিত এক ঝাঁক স্নাতক-স্নাতকোত্তর করা বিষয়ভিত্তিক নিবন্ধিত প্রকৃত চাকরি প্রত্যাশীদের এন্ট্রিলেভেল বয়স বিবেচনা করে অথবা বিতর্কীত রায়গুলো পুনঃবিবেচনা করে বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও স্বেচ্ছাচারিতায় (১ম থেকে ৫ম) গণবিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যের শিকার, নিয়োগ বঞ্চিত নিবন্ধিত শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদান করে বৈষম্য মুক্ত শিক্ষা ও জাতির মেরুদন্ড শিক্ষাব্যবস্থা কলঙ্কমুক্ত করা এখনই হচ্ছে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ।

লেখকঃ সভাপতি, প্যানেল প্রত্যাশী নিবন্ধিত শিক্ষক সংগঠন। নয়াবাজার, ঢাকা-১১০০

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/৩০/১১/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.