নিউজ ডেস্ক।। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা সাফায়াত হোসেন (ছদ্মনাম) গত চার বছরে তিনটি চাকরির ভাইভা দিয়েছেন। দুটিতেই সফল হয়েছেন। কিন্তু গত ২০ দিনে তাঁর বাচ্চা তিনটি স্কুলে চার দফা ভাইভা দেওয়া সত্ত্বেও ভর্তি করাতে পারেননি পছন্দের কোনো স্কুলে। সুনির্দিষ্ট একটি স্কুলে প্লে শ্রেণিতে ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধনে সন্তানের বয়স এক বছর কমিয়েও বিফল হয়েছেন।
এমনকি বয়স কমানোর কারণে অন্য স্কুলে নার্সারি শ্রেণিতে আবেদন পর্যন্ত করতে পারেননি। সন্তানের শিক্ষা নিয়ে এখন চরম দুশ্চিন্তায় আছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বারিধারার ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, ‘সাতটি স্কুলে ফরম পূরণ করেছি। ১৫ দিনে চারটি স্কুলে বাচ্চার অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে।
তিনটিতে হয়নি, একটির রেজাল্ট বাকি। তিনটির অ্যাসেসমেন্ট বাকি। সব মিলে দুশ্চিন্তায় আছি। এ ছাড়া আমার দুটি বাচ্চা একই স্কুলে দিতে হবে।
না হলে আনা-নেওয়ায় বড় সমস্যা হবে। ’ এদিকে স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বাচ্চার বয়স নিয়েও রয়েছে জটিলতা। সরকারিভাবে প্রথম শ্রেণি থেকে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হলেও অনেক স্কুলে ভর্তি শুরু প্লে থেকে, কোথাও আবার নার্সারি থেকে। রুকাইয়া ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার শখ ছিল বাচ্চাটাকে নেভি অ্যাংকরেজ স্কুলে পড়ানোর। কিন্তু সেখানে প্লে শ্রেণিতে ভর্তির জন্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে তিন থেকে চার বছর।
জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের জন্ম তাদের কখনো এ বয়স হবে না। বাচ্চার বাবাকে জন্মনিবন্ধনে বয়স পরিবর্তনের কথা বললে তিনি মিথ্যার সঙ্গে বাচ্চাকে বড় করতে রাজি হননি। তাই এ স্কুলে ফরমই তুলতে পারিনি। অন্যদিকে প্লেতে ভর্তি করাতে না পারলে এখানে আর ভর্তির সুযোগ নেই। অথচ আমার পরিচিত অনেককে দেখেছি এ স্কুলে ভর্তির জন্য বাচ্চার জন্মনিবন্ধনে বয়স কমিয়েছেন। ’ শুধু সাফায়াত হোসেন, আল-আমিন বা রুকাইয়া ইসলাম নন; অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মহানগরীগুলোয় বিশেষ করে ঢাকায় বাচ্চাকে ‘ভালো’ স্কুলে ভর্তি করাতে অভিভাবকদের ঘুম হারাম হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে ভালো মানের স্কুলের সংকট, এলাকাভিত্তিক স্কুলের অসম বিন্যাসের কারণে নির্দিষ্ট কিছু স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। অভিভাবকরা বলছেন, এসব স্কুলে ভর্তির ফরমে উল্লেখ করতে হয় অভিভাবকের মাসিক আয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতা। সবকিছু বিবেচনা করে দেওয়া হয় ভর্তির সুযোগ। সরকারিভাবে স্কুলে ভর্তির ফরম পূরণে ১১০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হলেও এসব স্কুলের ফরম বিক্রি হয় ৩৫০ থেকে ১ হাজার টাকায়। অফিস, ব্যবসা ছেড়ে দুই মাস স্কুলে স্কুলে দৌড়ে ফরম সংগ্রহ, পূরণ করে জমা দেওয়া, শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন পরীক্ষা, অভিভাবকদের ভাইভাসহ নানা প্রক্রিয়ার পর ব্যর্থ হলে শুরু হয় তদবির ও টাকার খেলা। এ প্রতিযোগিতায় যারা টিকতে পারে তারাই সুযোগ পায়। এ ছাড়া বাচ্চা ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলা ভার্সন, ইংলিশ ভার্সন, ইংলিশ মিডিয়াম নাকি মাদরাসায় পড়াবেন তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ছেন অভিভাবকরা। তাঁরা বলছেন, সবার শিক্ষার মান একই হওয়া উচিত। বিভিন্ন কারিকুলাম বাচ্চাদের মধ্যেও মানসিক ব্যবধান তৈরি করছে। অভিভাবকদের মধ্যেও এ নিয়ে এক ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতা চলে, যা অনেক সময় বাচ্চার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, সব স্কুলের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে এ চিত্র বদলাবে না। একসময় দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল জিলা স্কুলগুলো। এখন সেগুলোর করুণ দশা। সরকারি স্কুলগুলোর মান দিনদিন খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া কোনো এলাকার ১০০ বর্গকিলোমিটারে ২০টি ভালো স্কুল গড়ে উঠেছে, কোথাও আছে দুটি, সেগুলোরও মান প্রশ্নবিদ্ধ। এ অসম বিন্যাসের কারণেও সংকট বাড়ছে। মিরপুর থেকে কোনো শিশু পড়তে আসছে খিলক্ষেতে, আবার খিলক্ষেত থেকে যাচ্ছে মিরপুরে। এটা শুধু শিশুটির ওপরই ধকল নয়, রাস্তায়ও যানজট বাড়াচ্ছে। কিছু ভালো স্কুল মধ্যবিত্ত এলাকায় গড়ে উঠলেও শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে আশপাশ এলাকার (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। স্কুলগুলোয় বেতন বেশি, আবার অভিভাবকের আয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতাকেও শিক্ষার্থী ভর্তির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে! ফলে ভালো স্কুলগুলোয় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে শুধু নানাভাবে এগিয়ে থাকা ধনী ঘরের সন্তানরা। এতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী পিছিয়েই থাকছে।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.