আসাদ উল্লাহঃ যে দেশে সন্তানের হাতে পিতা খুন হয়, পিতার হাতে সন্তান খুন হয়- সে দেশে ছাত্র বা ছাত্রীর হাতে শিক্ষক বা শিক্ষিকা নির্যাতিত হবেন, লাঞ্ছিত হবেন, এ আর বিচিত্র কী! এসব ঘটনা আজকের দিনে আর আমাকে তেমন অবাক করে না।
আপনি সুস্থ চিন্তার মানুষ। আপনার পিতা অসুস্থ মানসিক দিক থেকে। সামান্য কারণেই অবাঞ্ছিত আচরণে পরিবারের স্বাভাবিক পরিবেশ অস্বাভাবিক করে তোলেন। আপনি কি পারবেন আপনার পিতার গায়ে হাত তুলতে? তবে হে যদি আপনি অসুস্থ চিন্তার মানুষ হন, কুলাঙ্গার হন তাহলে আপনার পিতাকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। সন্তান কুলাঙ্গার হলে সজ্জন পিতাও নির্যাতিত হয় বা হবে।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের হাতে শিক্ষক নির্যাতিত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। এসব নিয়ে নানান জন নানান কথা বলছেন, কেউ নিন্দা জানাচ্ছেন, কেউ খুশি হয়ে সমর্থন জানাচ্ছেন। যারা নিন্দাবাদ করছেন আর যারা ছাত্রছাত্রীদের এমন কাজ সমর্থন করছেন তারা প্রত্যেকেই মানুষ। পার্থক্য চিন্তার। তা-তো থাকবেই।
শিক্ষকদের একটি ছোট অংশ নিয়ম-অনিয়মের তোয়াক্কা করেন না। তারা বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হন অকপটে। সুতরাং বিচার তাদের হতেই পারে। কে করবে এই বিচার? মেধাহীন ছাত্র বা ছাত্রী? মেধাহীন বললাম এ জন্যই, খোঁজ নিয়ে দেখুন একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী শিক্ষক নির্যাতনের পক্ষে নেই। আমরা বলব না কোনো দুর্নীতিবাজ শিক্ষক বিচারের ঊর্ধ্বে থাকুক। তার বিচার হবে প্রচলিত আইনে। অবশ্যই। নিশ্চয়ই কোনো ছাত্র বা ছাত্রী অপরাধী শিক্ষকের বিচার করার অধীকার রাখে না, যেমনটি রাখে না পিতা অপরাধী হলেও কোনো সন্তান তার বিচার করার অধীকার। শিক্ষক তো পিতা-মাতার মতোই শ্রদ্ধেয়।
যেহেতু কলেজে পড়াই অভিজ্ঞতাও কম-বেশি আছে। বেশ আগের কথা। ডিগ্রি পরীক্ষায় নকল করার দায়ে একটি ছাত্রকে বহিষ্কার করি। পরীক্ষা শেষে বিকেল বেলা কলেজ থেকে ফিরছিলাম। সঙ্গে তিন-চারজন সহকর্মী। কলেজের ফটক অতিক্রম করতেই দু-তিনজন দুর্বৃত্ত পথ রোধ করে দাঁড়াল। হাতে ছোরা। বেশ ভরকে গেলাম। ছোরা হাতে সবার আগে যে ছেলেটি এগিয়ে আসছে দেখলাম সে আর কেউ নয়, পরীক্ষার হলে যাকে আমি বহিষ্কার করেছিলাম। সাহসের দিক থেকে এতটা অগ্রগামী না হলেও এতটা পশ্চাৎগামীও ছিলাম না কোনোদিন। আমি স্থির দাঁড়িয়ে থেকে বললাম- চালাও ছুরি। দেখি কেমন বাপের ছেলে তুমি। আমার সহকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টায় আমাকে আবার ক্যাম্পাসে নিয়ে এল। ছোরা হাতের ছেলেটি অবশ্য তখনো কলেজ ফটকেই ছিল। আমি দুর্বৃত্ত ছাত্রধারা আক্রান্ত হয়েছি। খবরটি দ্রুত কীভাবে ছড়ালো জানি না। দেখতে দেখতেই তিন-চারটি মোটরসাইকেল ক্ষিপ্রগতিতে ঘটনাস্থলে চলে এল। প্রতিটি মোটরসাইকেলে তিনজন করে যাত্রী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোরাধারী ছেলেটিকে ওরা ধরে ফেলল এবং তাকে মারতে মারতে কলেজ মাঠে নিয়ে এল। আগন্তুক ১০-১২ জনকে আমার সহকর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। শেষে আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম। যাকে আমার কাছে তাদের দলনেতা মনে হলো তাকে বেশ উচ্চৈঃস্বরে ধমক দিয়ে বললাম- তোমরা কারা, ওকে এভাবে মারছ কেন? আমার ধমকে তারা যেন সম্বিত ফিরে পেল। কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল- স্যার, আমরা আপনার প্রাক্তন ছাত্র। আপনাকে অসম্মান করতে চেয়েছে এই ছেলে, ওকে আজ মেরে ফেলব। আমরা শুনেই ছুটে এসেছি। ছেলেটিকে তখনো ওরা চোর ধরার মতো ধরে রেখেছে। আমি আবার বেশ উচ্চকিত কণ্ঠেই বললাম- যদি তোমরা আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকো তাহলে এ ছেলেটির গায়ে দ্বিতীয়বার আর হাত তুলবে না। যদি ওকে আরেকবার আঘাত করো আমি খুব কষ্ট পাব। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছেলেটিকে ছেড়ে দিল। বললাম- তোমরা চলে যাও। তোমাদের এই ভালোবাসা আমি সব সময় মনে রাখব। ওরা আমার কথা শুনে চুপচাপ চলে গেল। পাঠক, হয়তো আপনাদের কারও বিশ্বাস হবে না- আগন্তুক ছেলেগুলোর একজনের নামও আমি জানি না। এমনকি তাদের মুখগুলোও মনে করতে পারছিলাম না। আমার সহকর্মীরা জানাল ওরা আমাদের প্রাক্তন ছাত্র এবং আপনার প্রতি ওদের শ্রদ্ধাবোধ কিছুটা বেশিই।
ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে এই ভেবে, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, অন্তত বেশির ভাগ। তবে খারাপ লেগেছে আরও বেশি এই ভেবে, আক্রান্ত ছেলেটিকে আক্রমণকারী ছেলেদের হাত থেকে দ্রুত উদ্ধার করতে পারিনি। মার খাওয়া ছেলেটি তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিল-ঘুষিতে সে মারাত্মক আহত হয়েছে। গায়ের জামাটি আশি শতাংশ ছিঁড়ে গেছে। আমি ছেলেটির হাত ধরে অফিসে নিয়ে এলাম। বললাম- দেখো, তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারলাম না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা তোমাকে অনেক বেশি মেরে ফেলেছে। ছেলেটি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার হাত চেপে ধরল। তার ভেতর জেগে উঠেছে অপরাধবোধ। ক্ষমা চাইছে আমার কাছে। বললাম, অবশ্যই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমরা ভুল করবে আর সেই ভুল শুধরে দেওয়ার জন্যই তো আমরা। ভালোভাবে পড়াশোনা করো। তুমি নষ্ট হলে কেবল তোমার পিতা-মাতা কষ্ট পাবে না, আমরাও অনেক বেশি কষ্ট পাব। তুমি সফল হলেই তো তোমার পিতা-মাতা সফল। আমরা সফল। দেশ সফল। আমি বিশ্বাস করি- একটি ছেলে বা একটি মেয়ে যদি নষ্ট হয় তাহলে সে কেবল পরিবারের অভিশাপ নয়, দেশেরও অভিশাপ। কারণ, ছেলেটি মেয়েটি কেবল পরিবারের সদস্য নয়, দেশেরও সদস্য। ছেলেটি আমার কথা শুনছিল আর মাথা নিচু করে কাঁদছিল। কথা শেষ করে বললাম- বাড়ি যাও। তোমার জামাটি ওরা ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি তোমাকে একটি জামা কিনে দেব। তুমি দু-এক দিনের মধ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করবে। ছেলেটি চলে গেল। তবে জামা নিতে সে আর এল না। এ ঘটনাটি আজও আমার ভেতরে কখনো কখনো বেদনা জাগিয়ে তোলে। কেন জাগিয়ে তোলে জানি না। বলছিলাম শিক্ষকদের একটি ছোট অংশ নিয়ম-অনিয়মের তোয়াক্কা করেন না। কেন করেন না? কারণ আছে বৈকি। রাজনৈতিক নেতাদের অপআশীর্বাদে তারা নিয়োগ লাভ করেন। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায় এ কথা উজ্জ্বল সত্য। লেনদেন তো থাকেই। অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে তারাও রাজনীতিক হয়ে যান। রাজনীতি করেন, নেতাদের চাটুকারিতা করেন। কোন রাজনীতি, কোন নেতা? যে রাজনীতি নষ্ট, যে নেতা পথ ভ্রষ্ট। রাজনীতির লেজুর ধরে বেশ ভেতরে চলে যান। তারা যত ভেতরে যান তত বেশি মধুরসে সিক্ত হন। সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসেন না বা আসতে পারেন না। রাজনীতি নষ্ট হলে সবই নষ্ট হয়, হবে এটিই স্বাভাবিক।
দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকের বিচার অবশ্যই হবে। তারও আগে বিচার হওয়া উচিত যারা তাকে নিয়োগ দেন বা দিয়েছেন। কে করবে তাদের বিচার? এ এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকের বিচার কে করবে? ছাত্রছাত্রী? হতেই পারে না। শিক্ষকদের আর্থিক ভিত সংহত না হলেও তাদের পেশার জায়গাটি সম্মানজনক। সমাজ অন্তত তাই মনে করে। হালে অবশ্য এ সমাজচিন্তা বায়োবীয়। তারপরও সম্মানের জায়গাটি মনে রাখতে হবে। রাখেনও অন্তত যারা বিবেক সচেতন।
সরকারের আইন আছে। সেই আইনেই বিচার হতে পারে। হওয়া উচিতও। তবে কখনোই ছাত্র বা ছাত্রী দ্বারা শিক্ষক আক্রান্ত হোক, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত হোক এটি কাম্য নয়। এমনটি চলতে থাকলে সভ্যতা বিপন্ন হবে। কোনো সভ্য মানুষ অন্তত তা সমর্থন করবে না। অন্তত যাদের সামান্য পারিবারিক শিক্ষা আছে তারাও সমর্থন করবে না। যারা বর্বর মানসিকতার তাদের কথা অবশ্য ভিন্ন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে সব ছাত্রছাত্রী শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে, নির্যাতন করছে, অসম্মান করছে তারা কি মেধাবী? হতেই পারে না। মেধাবীরা আর যাই করুক শিক্ষককে অসম্মান করে না। অসম্মান করে না তাদের পিতা-মাতাকেও। যেসব ছাত্রছাত্রী শিক্ষককে অসম্মান করে বা করছে তারা বখে যাওয়া। এ নিয়ে খুব একটা দুঃখ করার কিছু নেই। বখে যাওয়াদের হাতে তো তাদের পিতা-মাতাও নিরাপদ নয়। এরা সমাজের আবর্জনার মতো। কালের স্রোতে এসব আবর্জনা এক দিন হারিয়ে যায় বা যাবে। সন্দেহ নেই। তবে ওরা হারিয়ে যাক, এটিও কাম্য নয়। প্রত্যেকটি ছাত্রছাত্রী প্রকৃত শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত হোক এমনটিই আমাদের কামনা। তা না হলে দেশ দুর্বৃত্তদেরই থাকবে। মানুষের হবে না। অবশ্য তার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাকে ঢেলে সাজানো, প্রয়োজন শিক্ষার প্রতিটি স্তর সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত রাখা।
লেখক: প্রাবন্ধিক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০২/০৯/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.