শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকা: প্রাথমিক স্তরের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য পরিচালিত একটি কর্মসূচি থেকে প্রায় আড়াই লাখ শিশুকে মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এসব শিক্ষার্থীর পুনরায় ঝরে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সারা দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া বা ভর্তি হতে না পারা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচি। সম্প্রতি এসব শিক্ষার্থীর একটি অংশকে মূলধারার শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা বলছেন, দিনমজুর বা দরিদ্র পরিবারের শিশুরা এই কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা করছে। অনেক শিক্ষার্থীর বাবা কিংবা মা অথবা কেউ নেই। আবার অভিভাবক থাকলেও দেখা যায়, তাঁদের পক্ষে সন্তানের পড়াশোনার খরচ, স্কুলব্যাগ, পোশাক, খাতা-কলম-পেনসিলসহ শিক্ষা উপকরণ কিনে দেওয়ার সামর্থ্য নেই। অনেক সময় এসব শিশুকে উপার্জনে সহযোগিতা করতে হয়।
এসব কারণে তাদের মূলধারায় ফেরানোর এই কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে দেশব্যাপী ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের দ্বিতীয়বার শিক্ষার সুযোগ করে দিতে দেশের ৬৩টি জেলায় এই কার্যক্রম চলছে।
এর আওতায় দেশের ২৫ হাজার ৭৪০টি শিখনকেন্দ্রে আট লাখ দুই হাজার ৫৩৬টি শিশু শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
তবে গত বছর ২৩ অক্টোবর ১০ বছর পর্যন্ত বয়সী শিক্ষার্থীদের মূলধারায় আনতে (সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তকরণ) চিঠি দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় দুই লাখ ৪৬ হাজার ৪৯৬ জন শিক্ষার্থীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তাদের উপবৃত্তি।
এই কর্মসূচির আওতায় দেশের চারটি জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও পঞ্চগড় এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে আরডিআরএস বাংলাদেশ।
তাদের এক হাজার ৫১১ কেন্দ্রে পড়াশোনা করছে ৪৪ হাজার ৪৯১ জন শিশু শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে ১৬ হাজার ৭৪৮ জন শিশু শিক্ষার্থী। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৯০৭ জন শিশু শিক্ষার্থীর উপবৃত্তি।
আরডিআরএস বাংলাদেশের প্রকল্পপ্রধান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, এসব শিক্ষার্থীকে মূলধারার শিক্ষায় ফেরাতে বড় তিটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে পরিচালনা; দুর্গম এলাকাগুলোতে নিকটবর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকা এবং অভিভাবকদের বাড়তি শিক্ষা ব্যয় বহনের সুযোগ না থাকা।
তিনি বলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে সিলেট জেলায় পাহাড় ও হাওর বেষ্টিত দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখান থেকে জেলা বা উপজেলা শহরের যোগাযোগব্যবস্থা খুব নাজুক। নেই পর্যাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কোনো কোনো গ্রাম থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব চার-পাঁচ কিলেমিটার। এ ছাড়া শহর এলাকার বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষ প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সচেতন নয় বা সুযোগ নেই। এই জেলার ৬৭১টি উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে সুবিধাবঞ্চিত ২০ হাজার ৫৬৮টি শিশু শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সব প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থীকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব, তাদের তালিকা প্রস্তুত করেছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। তারা তালিকা পাঠানোর পর আমরা তাতে অনুমোদন দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’
সিলেট সদর উপজেলার মাঝপাড়া চা-বাগান উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে সূর্যসিং ছত্রী। তার বাবা অজয় সিং ছত্রী বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রী দুজনই চা-বাগানের শ্রমিক। সামান্য যে মজুরি পাই, এতে সংসার চালানোই দায়। সন্তানকে লেখাপড়া করাব, এটা কখনো ভাবা হয়নি। এখন যেখানে পড়ছে, সেখানে উপবৃত্তির পাশাপাশি স্কুল ড্রেস, বই-খাতা, কলম, ব্যাগসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ বিনা মূল্যে পাচ্ছে।’
একই উপজেলার লালিছড়া গ্রামের চা শ্রমিক দম্পতি মনো ভক্তা ও রণিকা ভক্তা। তাঁদের সন্তান মুক্তা ভক্তা ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন’ শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। মনো ভক্তা বলেন, বাসা থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দুই কিলোমিটার দূরে। দুজনেই কাজ করার কারণে নির্ধারিত সময়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো সম্ভব হয় না। এ কারণে সেখানে সন্তানকে ভর্তিও করতে পারিনি।
অন্য এক শিক্ষার্থী অভি কর্মকারের বাবা দেবদাস কর্মকার বলেন, আশপাশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। যে বিদ্যালয় আছে, সেখানে পাহাড়ি রাস্তা দিয় যাওয়া খুব কঠিন।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দিনমজুর পরিবারের সন্তান ও ভাসমান শিশুদের পড়াশোনার লক্ষ্যে এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শুরু হয়েছিল। যাদের মা-বাবা নেই বা আর্থিক সক্ষমতা নেই, তারাই এখানে পড়ে। অনেক স্থানে এক কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। অথচ আগামী ৩১ ডিসেম্বর এই কর্মসূচি শেষ হতে চলেছে।
তাঁর ভাষ্য, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, দেশে ঝরে পড়া শিশু নেই। এ জন্য এই কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। অথচ রাস্তায় দাঁড়ালে দেখা যায় শিশুরা ভিক্ষা করছে, কলকারখানায় কাজ করছে। তাহলে ঝরে পড়া শিশু নেই বললে তো হবে না। যত দিন দেশে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী থাকবে, তত দিন এই কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সূত্র: কালের কণ্ঠ
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০৮/০৬/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.