Breaking News

বুয়েট: সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও কিছু প্রশ্ন

প্রকৌশলী এইচ এম জাহিদুল ইসলাম স্বপ্নিলঃ দেশের প্রকৌশল শিক্ষার পীঠস্থান বুয়েটের শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রচেষ্টা চলছে। ছদ্মবেশে সেখানে হম্বিতম্বি করছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে নিজেদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন ও ফসল তুলে নিচ্ছে তারা। যার ফল শিবিরের মতো ক্যাম্পাসে রেজ্যুলেশন করে নিষিদ্ধ সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা পাচ্ছে বুয়েট থেকে।

বুয়েটে আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিজবুত তাহরীর ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো মৌলবাদী সংগঠন। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর ছদ্মবেশ নিচ্ছে। প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা মুখ খুললেই তাদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে। তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। সেই সঙ্গে প্রচার চালানো হচ্ছে ‘বুয়েটে শিবির-হিযবুত বলতে কিছু নেই’।

মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত সবখানেই রাজনীতির নিবিড় সংযোগ রয়েছে। ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থী তথা আগামী দিনের কাণ্ডারিদের মধ্যে সেই সংযোগ গড়ে তোলার প্রাথমিক পাঠ দেয়। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেকটি মানুষের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অধিকার আছে। কিন্তু বুয়েটের মতো ক্যাম্পাসে মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কারা এই ঘটনার নেপথ্যে? বুয়েট কি তবে সংবিধানের বাইরে এক বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড?

এ বছরের ৩১ মার্চ বুয়েট ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিল, বুয়েটে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হয়ে যিনিই কথা বলছেন, তাকেই ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে বারবার অত্যাচার করা হচ্ছে৷ এর প্রমাণও মিলেছে একাধিক ঘটনার মাধ্যমে।

বুয়েটে শিবিরের অস্তিত্বের প্রমাণ আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সুনামগঞ্জের হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগে বুয়েটের প্রাক্তন এবং বর্তমান ৩৪ জন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। তাদের নামে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে এখনো আদালতে মামলা চলমান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটের কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন। এই মানববন্ধন করার পর তাদের চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং জবাবদিহি চাওয়া হয়। বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ডেকে জবাবদিহি চাওয়া হয়। এমনকি মানববন্ধনকে একটি অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে তাদের হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বুলিংয়ের শিকার এক শিক্ষার্থী বলেছিলেন, বুয়েটের অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপগুলোতে আমাদের পক্ষে কেউ নিজের কোনো মতামত রাখতে গেলে তাকে বুলিং এবং নানা ধরনের হুমকির শিকার হতে হয়। আমাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক কিংবা পরিচয় থাকায় অনেককেই কটাক্ষের স্বীকার হতে হয়। যে কারোরই পারিবারিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকলে বা পরিচয় থাকলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়; পরিবার নিয়েও অশালীন মন্তব্য করা হয় অনলাইন ও অফলাইনে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের মতো গুটিকয়েক ছেলের বিরুদ্ধে কারা এবং কাদের ইন্ধনে এসব হচ্ছে, তা একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে। মিথ্যাচার করে আমাদের দোষী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী।

বুয়েটে আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড একটি জঘন্য ও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ আবরারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক স্বদিচ্ছায় ঐতিহাসিক দ্রুততার সঙ্গে আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার হয়েছে। বলা যায়, অতিরিক্ত কঠোর ও লোকরঞ্জনবাদী বিচার। একটি হত্যাকাণ্ডে এতজনের মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাবাসের আদেশ পুরো পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল।

কিন্তু আমরা দেখলাম, আবরার ধীরে ধীরে ছিনতাই হয়ে গেছে। আবরারের ফ্যামিলি বিশেষত আবরারের ছোটভাইয়ের ওপর ভর করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী আবরারকে তাদের পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল বানিয়েছে। আবরারের লাশকে ঘিরে যে শক্তিশালী ইমোশন, যে তীব্র শক বাংলাদেশের মানুষের মনে তৈরি হয়েছিল, সেটিকে মৌলবাদীরা চমৎকারভাবে ক্যাপিটালাইজ করেছে। আবরারকে তারা ব্যবহার করছে ‘পলিটিক্যাল শিল্ড’ বা ‘রাজনৈতিক বর্ম’ হিসেবে। কিছু হলেই তারা আবরারের নাম নিচ্ছে, আবরারের ছবি দেখাচ্ছে। আবরারের লাশের ভেতর বসে তারা পরিকল্পনা করছে, কীভাবে বুয়েটে স্বাধীন জঙ্গিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।

অর্থাৎ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে বুয়েট যেভাবে উপকৃত হওয়ার কথার ছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ছাত্রদের কর্মযজ্ঞ যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, তা হয়নি। উল্টো এই সুযোগে, বুয়েট চলে গেছে সাম্প্রদায়িক মাস্তানদের হাতে। বুয়েট হয়ে উঠেছে জামায়াত, শিবির আর হিজবুত তাহরীরের অভয়ারণ্য।

বুয়েটে শিবির ও হিজবুত তাহরীরের প্রকাশ্য বা গোপন অবস্থান সবসময়ই ছিল। মৌলবাদীরা দীপকে কুপিয়ে হত্যা করেছে এই বুয়েট ক্যাম্পাসেই। গণজাগরণমঞ্চের আরেক সংগঠক তন্ময় আহমেদকে কুপিয়ে মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল শিবির ক্যাডাররা। বুয়েটের ছেলেরা মেধাবী বলেই জঙ্গি ও মৌলবাদীরা বুয়েট ছাত্রদের টার্গেটেড রিক্রুট করে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, হিজবুত ও শিবির বুয়েটে তাদের অবস্থান স্ট্রং করেছে আবরার হত্যাকাণ্ডের পরে বিরাজনীতিকরণের নামে।

বুয়েটের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের একটি অংশের ফেসবুক অ্যাক্টিভিটি দেখলেও তা অনুমান করা যায়। এই র‍্যাডিক্যাল ও গোঁড়া মাইন্ডসেট নিয়ে তারা আর্মি, প্রশাসন, পুলিশ এসব ক্যাডারেও যোগ দিচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র ও নাগরিকের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ঝুঁকির ভেতর পড়ছে। এখনই সময় বুয়েটের প্রতি রাষ্ট্রের নিবিড়ভাবে নজর দেওয়ার।

২০১৩ সালের নভেম্বর মাসের দিকে বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের ২২৩, ৩০২, ৩২৪, ৩৩০ ও ৪১০ নম্বর রুম এবং আহসানউল্লাহ হলসহ বিভিন্ন হল থেকে প্রচুর ইসলামি বই ও শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিবরণ সংবলিত বেশ কিছু গোপন নথি পাওয়া যায়।

গোপন কাগজপত্র থেকে জানা যায়, বুয়েটে সেবা নামের একটি সংগঠনের আড়ালে শিবির তাদের কর্মকাণ্ড সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে প্রচার ও প্রসার করত। এ রকম ‘মেধাবীদের খোঁজে’ নামক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন নামে বেনামে সংগঠন দাঁড় করিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের তাদের দলে ভেড়ায়। গোপনে তারা বুয়েট প্রশাসন ও ক্যাম্পাসে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল।

বুয়েটে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে শিবির অনেক অর্থ ব্যয় করছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পেছনে। ২০১০ সালে বুয়েটে শিবির অর্থ ব্যয় করেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার ৩১৪ টাকা এবং ২০১১ সালে খরচ করে ১৩ লাখ ২৩ হাজার ২০০ টাকা। এ ছিল ঘোষিত খরচ। এর বাইরেও ছিল নানা ফান্ড এবং সুযোগ-সুবিধার হাতছানি।

বুয়েট শিবিরের এক নেতার কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক জব্দ করে এ খরচের গোপন তথ্য উদ্ধার করে। ইসলামি ছাত্রশিবির মেধাবীদের মগজ ধোলাই করতে এবং দরিদ্র ছাত্রদের আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে নিজেদের বশে আনতে এ বিপুল অর্থ ব্যয় করছে।

এসব তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বুয়েট ছাত্রলীগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুয়েট শিবির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ৬ জন শিবির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। বুয়েটের এক শিবির নেতাকে ডিবি পুলিশ মালিবাগে মিছিল থেকে আটক করে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এসব শিবির নেতাকর্মীকে ধরা হয়।

এ কথা প্রমাণিত যে বুয়েটে মৌলবাদী গোষ্ঠী মোটামুটি বিনা বাধায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই তৎপরতার বড় প্রমাণ হিসেবে প্রগতিশীলদের ওপর বড় আঘাত আসে ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল। বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলে দীপের মাথায় ও পিঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ওই বছরের ২ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আর এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন মেজবাহ নামের উগ্রবাদী বুয়েটের এক শিক্ষার্থী। যিনি হেফাজতে ইসলামের সমর্থক ছিলেন বলে জানা গেছে।

একইরকম ঘটনা ঘটেছিল বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী ও তৎকালীন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তন্ময় আহমেদের সঙ্গেও। ২০১৩ সালে তিনিও শিবিরের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তার শরীরে এখনো সেই হামলার ১৩০টি সেলাই রয়েছে। এসব হামলার আগে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গুজব ও উসকানিমূলক লেখালেখি শুরু হয়েছিল।

সূত্র মতে, বুয়েটে বর্তমানে শতাধিক শিক্ষার্থী শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। আর তাদের কাছে অন্তত চার হাজার শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য মজুদ আছে। তারা ব্যাপক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্য দিয়ে মূলত বুয়েটকে একটি মৌলবাদের অভয়নগরে পরিণত করতে চাচ্ছে।

সাম্প্রতিককালে বুয়েট শিক্ষার্থীদের নামে শিবির তথা মৌলবাদী গোষ্ঠী দেশের সংস্কৃতি, আচার-উৎসবকে লক্ষ্য করে নানা লেখা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তাদের আক্রমণের শিকার হচ্ছে নারীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বাঙালির ঐতিহ্যকে আক্রমণ করছে তারা। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে জাতীয় দিবসগুলোতে অংশগ্রহণ করে না অধিকাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী, ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নিজেদের শিক্ষাগুরুদের গালি দেওয়া হয়, আক্রমণাত্মক মন্তব্য করা হয়। এটা কি সর্বোচ্চ শিক্ষার নমুনা? এটা কি সর্বোচ্চ মেধার প্রকাশ!

২০১৯ থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ। অথচ ২০২২ সালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠান নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে একদল সাবেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বাধা দেওয়া হয়।

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকার পরেও নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরীর ও যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদী সংগঠন শিবিরের তৎপরতা নিয়ে কথিত সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো কথা নেই। ২০২৩ সালে সুনামগঞ্জের হাওরে আটক, নাশকতার মামলার আসামি ৩৪ শিবিরকর্মীর বিচার বিষয়ে তথাকথিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো কথা নেই। বুয়েটে রাজনীতি বন্ধ, একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক তৎপরতাও স্থবির। শুধু চলছে সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম। শিবির, হিজবুত তাহরির ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর বেশিরভাগ কার্যক্রম মসজিদভিত্তিক হওয়ায় এসব কর্মকাণ্ড তারা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে।

যেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, সেখানে মসজিদভিত্তিক রাজনীতির সুবাদে শিবিরের ঘাঁটি গড়ে ওঠে এবং গলাকাটা, রগকাটার রাজনীতি শুরু হয়। বুয়েটেও এখন সেই আলামত দেখা যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বললেও তাকে ‘আবরারের হত্যাকারী’ বা ‘ছাত্রলীগ’ বলে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেয় করা হচ্ছে। মৌলবাদ বিরোধী মানববন্ধন করায় শিক্ষার্থীদেরকে সারারাত আটকে রেখে জবাবদিহি চাওয়া হয়।

বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের পোস্টারিং করছে কারা? নিষিদ্ধ এ সংগঠনটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় থেকে কর্মী সংগ্রহ ও প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করছে কী করে? ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রকৃতপক্ষে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটছে বুয়েটে।

পরিকল্পিতভাবে বুয়েটকে একটি বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। ৭৫ এর পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওঠেনি। ছিল না বঙ্গবন্ধুর কোনো প্রতিকৃতি বা শ্রদ্ধা জানাবার ব্যবস্থা। সেটাও হয় ২০১৪ সালের পরে। বঙ্গবন্ধু ফলক, দীপের ফলকসহ বুয়েটে নানা কর্মকাণ্ড চালু করে প্রগতিশীলরা। আর সেটিকে থামাতেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মৌলবাদীরা। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিচিহ্নগুলো অবহেলিত, দীপের ফলক হয়েছে সাইকেল স্ট্যান্ড। কখনো তার ফলক ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে সাইকেল!

বুয়েটে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডেও মৌলবাদের ছায়া প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে শুরু থেকেই। রাজনীতি বন্ধের কথা বললেও তারা হিযবুত ও শিবির নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। বুয়েটের বিধিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টির নিরাপত্তার জন্য যে সকল কমিটি রয়েছে তার প্রতিটির দায়িত্বে রয়েছেন রেজিস্ট্রার মহোদয়, যিনি নিজেও একজন শিক্ষক। কিন্তু বুয়েটের নিরাপত্তা না দেওয়ার জন্য কেন ডিএসডব্লিউকে দায়ী করা হয়, কেন শুধু ডিএসডব্লুই, ভিসি বা প্রভিসিকে গালি দেওয়া হয়। রেজিস্ট্রারকে কেন দেওয়া হচ্ছে না গালি বা তাকে তার অপরাধের জন্য কেন দায়ী করে তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন হচ্ছে না?

এই প্রশ্নগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সাবেক এক বুয়েটিয়ান হিসেবে করতে চাই। আমি বলছি না এমন আচরণ রেজিস্ট্রার মহোদয়ের সঙ্গে করা উচিৎ, বরং বলতে চাচ্ছি রেজিস্ট্রারকে যেমন আন্দোলনের তীরে বিদ্ধ করা হচ্ছে না, তেমনটিই হওয়া উচিত ভিসি, প্রোভিসি বা সাবেক ডিএসডব্লিউয়ের সঙ্গে।

সিনিয়র শিক্ষকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা, এমনকি বুয়েটের শিক্ষকদের ‘ভুয়া’ বলে সম্বোধনসহ তাদের তুই-তুকারি করে কথা বলা এবং ফেসবুক পোস্ট করার মাধ্যমে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা কোন অ্যাকাডেমিক সংস্কৃতির চর্চা করতে যাচ্ছেন? সামনে সাধারণ ছাত্রদের রেখে পেছনে দাঁড়িয়ে এমন স্লোগান কারা দিচ্ছেন। নিজের শিক্ষকদের এমন অপমানজনক স্লোগান শোনার পরও সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেনো প্রতিবাদ করছেন না। এই বুয়েটের শিক্ষকরাই তো বুয়েটকে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছেন। তাহলে তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকলে আমার মনে হয় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার চাইতে প্রথম বর্ষে তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নৈতিক শিক্ষার কোর্স প্রদান করার কথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিবেচনা করা উচিত।

একটি কথা বলে শেষ করতে চাই। চলতি বছর ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে বুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী ইফতারের আয়োজন করে এবং বুয়েটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে নিজেদের সাধ্যমতো ইফতার প্যাকেট তৈরি করে পৌঁছে দেয়। এটা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে এই কাজটি হয়নি এবং এই আয়োজনে কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ও ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু এ ঘটনায় কেন এই শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে র‍্যাগিং করা হলো? কেন তাদের রাত জুড়ে জেরা করা হলো। কেন হলের রুমে এবং মাঠে তাদের সকলের সামনে সামাজিকভাবে অপদস্ত করা হলো? এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের র‍্যাগিংয়ের অপরাধে কেন শাস্তির আওতায় আনা হলো না? বাংলাদেশ স্বাধীন হলো যার রক্তে, যেই ব্যক্তি তার পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে হত্যার শিকার হলো এই দেশের মানুষের স্বাধীনতার জন্য, তার জন্মদিনে কিছু ইফতার পরিবেশন করলে কাদের এত সমস্যা হয়।

বেশ স্পষ্টতই যারা এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, তাদের আদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সঙ্গে। আর এ কারণেই বুয়েটের ত্রিসীমানায় তারা এই আদর্শ ধারণ করা কাউকেই স্বস্তিতে থাকতে দিতে চায় না। ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা যেই অবাধ রাজনীতির সুযোগ পেয়েছে বুয়েটে, সেই সুযোগ মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না।

বুয়েট আমার প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে সনি, দীপ বা আবরার ফাহাদের মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে তার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে। সেই সঙ্গে মানুষকে তার রাজনীতির অধিকারও ফেরত দিতে হবে। মানুষ একজন রাজনৈতিক প্রাণী হিসেবে জন্মেছে। রাজনীতি শূণ্যতা কখনো অপরাজনীতিকে প্রতিহত করতে পারেনি। বরং সম্মিলিত রাজনীতি এবং সকলের অংশগ্রহণের রাজনীতি চালু হওয়া আবশ্যক। আমি স্বপ্ন দেখি বুয়েটে একটি শক্তিশালী ছাত্র সংসদ গড়ে উঠুক। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হোক। বাংলাদেশকে তারা হৃদয়ে ধারণ করে সকল মৌলবাদী অপশক্তির বিপক্ষে বজ্রকণ্ঠ ধারণ করুক। সেই সঙ্গে লেজুড়বৃত্তিক অপরাজনীতি নিয়েও তারা সচেতন ও প্রতিবাদী হোক। দেশের সেরা মেধাবীরা রাজনীতি সচেতন না হয়ে রাজনীতি বিমুখ হলে, সেই দেশের ভবিষ্যৎ কখনই আলোকিত হবার নয়।

লেখক- সাবেক শিক্ষার্থী, পুরকৌশল বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২০/০৪/২০২৪


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Check Also

বিসিএস আন্তক্যাডার বৈষম্যের অবসান হবে কবে

তুহিন ওয়াদুদঃ বিসিএস ক্যাডারের পদোন্নতির নৈরাজ্য আজও দূর করা সম্ভব হয়নি। বিসিএসে এক ক্যাডারের সঙ্গে অন্য …