এম আর খায়রুল উমাম।।
বাংলা সাহিত্যে রবিঠাকুর, বিদ্রোহী কবি নজরুলের পর যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, তিনি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই তিনজনেরই জন্মদিন দেশে জাতীয়ভাবে পালিত হয়। অন্যদিকে সরকার ইতোমধ্যে রবীন্দ্র ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে।
স্বাভাবিক কারণেই মাইকেল মধুসূদনের জন্মস্থানের মানুষ তাঁর নামেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যাশা করে। কিন্তু এখনও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি পূরণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের সরকারগুলো দুর্দমনীয় গতিতে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়। অভিজাত গোষ্ঠীর পেশাজীবীরা একবার মুখ খুললেই সরকারের এ সংক্রান্ত উদ্যোগ গতি পায়। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এসব পেশাজীবী গোষ্ঠী নিজ নিজ পেশার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এমন সব বিষয়ে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, যা প্রকৃত অর্থে দেশ ও জাতির কল্যাণে কতখানি অবদান রাখতে সক্ষম– সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিস্ময়কর হলো, পেশাজীবীদের দাবির সঙ্গে তাল মেলাতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটাই পরিবর্তন করে ফেলছে। তাই আইন বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির ঘোষণা সাধারণ মানুষ শোনে মাত্র, কিন্তু বুঝতে পারে না, কেন এসব বিশ্ববিদ্যালয় দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রয়োজন হয়ে পড়ল?
দেশে প্রথম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। সেই পথ ধরে একে একে কৃষি, চিকিৎসা, বস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় এসেছে এবং এখনও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাইপলাইনে আছে। কিন্তু জনগণের করের টাকায় পরিচালিত এতটি বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণকে কী দিয়েছে?
দেশের মেধাবী সন্তানরা এসব বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ শেষে হয় নিজেদের অভিজাত শ্রেণিভুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত থাকছে কিংবা বিদেশে লোভনীয় ক্যারিয়ার গড়ছে। অন্যদিকে দেশের প্রকৌশলগত উন্নয়নের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, অতীতের জাতীয় সংসদ ভবন থেকে বর্তমানের পদ্মা সেতু– এ ধরনের সব স্থাপনাই বিদেশিদের হাতে বাস্তবায়িত হয়েছে।
তবে দেশের প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞরা তদারকির কাজটি করে এসব প্রকল্পে সহায়তা করেছেন। এখানে লাখ টাকার প্রশ্ন, নিছক প্রকল্পের তদারকি কি বিশেষজ্ঞদের কাজ? যে কাজ মধ্যম স্তরের কারিগরি জনশক্তির, সেখানে বিশেষজ্ঞদের নিযুক্তির ফলস্বরূপ সার্বিক যে অপচয় ঘটে, তা কতটা যুক্তিসংগত?
স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও জনগণের জন্য কার্যকর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সামর্থ্যবানসহ সাধারণ মানুষও সম্পদ বিক্রি করে ক্রমবর্ধমান হারে চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটছে। আর বিশেষজ্ঞরা দিনরাত এক করে প্রতিদিন শতাধিক রোগীকে সেবা প্রদানের নামে চেম্বার খুলে বসে এক অমানবিক পরিবেশ তৈরি করেছেন।
অথচ চিকিৎসকের পাশাপাশি পর্যাপ্ত নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির দিকে নজর না দিয়ে সরকার বিশেষজ্ঞ তৈরিতে একের পর এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ব্যস্ত। অবস্থাদৃষ্টে একজন সাংবাদিকের উক্তিই মনে আসে বারবার– ‘আমাদের ডাক্তাররা রোগী দেখেন না। রোগীরা ফি প্রদান করে ডাক্তারকে দেখে আসেন।’
মোদ্দা কথা, দেশের মেধাবী সন্তানরা আজ যে বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে দেশ ও জনগণের কল্যাণের চাইতেও গোষ্ঠীস্বার্থে অধিক নিবেদিত– তা সর্বত্র প্রমাণিত।
বিশিষ্টজন বিশ্বাস করেন, বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার ঘাটতির কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাজীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা অপরিহার্য।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ও তো বিষয়ভিত্তিক। ফলে এমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি কতটুকু যৌক্তিক? সংস্কৃতি বলতে যখন মানুষ নিছক গানবাজনা কিংবা নাচকে বোঝে, তখন এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে আভিধানিক অর্থে সংস্কৃতি বলতে বোঝায় কৃষ্টি, কালচার, সংস্কার, শুদ্ধি, অনুশীলনে অর্জিত জ্ঞান-বুদ্ধির উৎকর্ষ।
ড. আহমদ শরীফ বলেছেন, ‘সংস্কৃতিকে যদিও ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা যায় না, কোনো বস্তুর মতো মূর্তিমান দেখা যায় না, তবু মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, ব্যবহারিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই তার সংস্কৃতি নিহিত থাকে।
সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের প্রতি, মানুষের প্রতি মানুষের যে প্রবণতা– মানুষ সচেতনভাবে চেষ্টার দ্বারা যে সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণবুদ্ধি ও শোভন জগৎ সৃষ্টির বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে চায়-তাকেই হয়তো তার সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়। সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশ্রুত জীবন চেতনা। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।’
বলা যায়, সংস্কৃতি এক বোধশক্তি, যা মানবিকতা সৃষ্টি করে। সংস্কৃতিচর্চাহীন মানুষ সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ শুধু নয়, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মতো অমানবিকতাকে লালন করে। আজ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কৃতিমান মানুষের খুব অভাব।
অভাবের এই মিছিলে দেশের বিশেষজ্ঞরা তো আছেনই; তাদের সচেতন-অবচেতন অনুসারীরাও এতে শামিল হচ্ছেন। ফলে পরিবেশ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পরিবেশ থেকে দেশ ও জনগণকে সুস্থতায় ফেরত আনতে সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই।
এ প্রেক্ষাপটেই দেশের একটা অঞ্চলের মানুষ সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের প্রতি মানুষকে জাগ্রত করতে, স্বাধীনতার সুফল পেতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ সৃষ্টির জন্য একটা পীঠস্থানের দাবি করেছেন। সেটাই মাইকেল মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়।
কপোতাক্ষ নদের তীরে একদা নিভৃত গ্রাম সাগরদাঁড়ী আজ মাইকেলের আলোকে আলোকিত; অন্যদিকে উন্নয়নেরও পরশ পেয়েছে। তাই সাগরদাঁড়ীকে গ্রাম বলে অবহেলার সুযোগ নেই। এখানে মাইকেল মধুসূদন সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকার যত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, ততই দেশ ও জাতির কল্যাণ।
আমাদের শিক্ষার্থীরা সুজন হবে, মানবিক হবে; দেশ ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে, সুনাগরিক হবে। সেই লক্ষ্য পূরণে যশোরবাসী একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনরত। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির মিলন ঘটানো এখন কালের দাবি।
এম আর খায়রুল উমাম: প্রাবন্ধিক, সাবেক সভাপতি ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/০৬/০৪/২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.