।। এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
সারাজীবন যারা সিকি ভাগ উৎসব বোনাস পাই তারা বেসরকারি শিক্ষক। যারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে তাদের বেসরকারি শিক্ষক বলে। যারা সমাজে অবহেলিত তারাই বেসরকারি শিক্ষক । শুধু সালাম আছে টাকা নাই এর নামই বেসরকারি শিক্ষক।
বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আশায় ঝুলে থাকা মানুষকে বলা হয় বেসরকারি শিক্ষক । মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে ম্লান করে কোনো মতে ডাল-ভাত খেয়ে বেচে আছে সমাজের ছত্রছায়ায় তাদের বলা হয় বেসরকারি শিক্ষক। কত ভাবে সংগায়িত করা যাবে এই সমাজে তার ইয়ত্তা নেই। এবার
ফেসবুকে কোনো এক ভদ্রলোকের দেওয়া একটি স্ট্যাটাস এর দিকে নজর দিই: বাসায় যে ছুটা বুয়া কাজ করে তার মাসিক ইনকাম ১৩,০০০ টাকার মতো; দুই বেলা খাবারসহ। তার স্বামী রিকশা চালিয়ে আয় করেন মাসে প্রায় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। তাদের ১২ বছরের একটা ছেলে টেম্পুতে হেলপারি করে পায় ৬ হাজার টাকা।
ওই পরিবারের মাসিক আয় ৩৯ হাজার টাকা। মা ও ছেলের দুই বেলা খাবার ফ্রি। এরা যে বাসায় থাকে তার ভাড়া ৭ হাজার টাকা। সব খরচ মিটিয়ে প্রতি মাসে সমিতিতে জমা করে ৮ হাজার টাকা। জমার পরেও গত কয়েক বছরে গ্রামের বাড়িতে জায়গা কিনেছে ১০ শতাংশ।
একটি পরিবারের আশা-আকাক্ষার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে যখন পরিবারের একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সাত-আট বছর ধরে কষ্ট করে চার বছরের কোর্স সম্পন্ন করে ছেলেটি ঢুকে চাকরির বাজারে। প্রতিটি আবেদন করতে হয় এক বা দুবেলা খাবারের টাকা ব্যয় করে। ইন্টারভিউ দিতে হয়, এতেও টাকা খরচ হয়।
তারপর ব্যর্থতা তাকে এবং পরিবারটিকে চরম হতাশায় নিক্ষেপ করে। ছেলেটিকে পড়াতে গিয়ে এর মধ্যেই বেশ কিছু সম্পদ চলে গেছে। আয়ও কমেছে। এর মধ্যে পেয়ে গেছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি। এই বেতনে সংসার চলে না। সংকট রয়েই গেল।
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বিক্রেতাদের মেজাজ নিয়ে ফেসবুকের আর একটি পোস্ট দিচ্ছি। ‘ভদ্রলোকের নাম মোরশেদ আলম (৪৫)। তার বাসায় চাল-তেল শেষ। একটি মুরগিও নিতে হবে। তাই ঢাকার নাজিরাবাজারে গেলেন সওদা করতে। দোকানদার পোলট্রি মুরগির দাম চাইল ২৩০ টাকা কেজি।
তিনি বললেন, গত সপ্তাহেও তো ২০০ টাকা ছিল। দাম কমিয়ে রাখুন। দোকানদার বলল, দাম প্রতিদিনই বাড়ে। কমাতে পারব না। আরও দু-একটি দোকান দেখেন, একই দাম।
তখন মোরশেদ বললেন, আচ্ছা, এক কেজির একটি মুরগি দাও। তখন দোকানদার বলল, এক কেজির কোনো মুরগি নেই। সব দেড় কেজির ওপর। মোরশেদ বললেন, ভাই, একটু দেখেন। এক কেজি পাওয়া যায় কিনা। দোকানদার তখন বলে উঠল, একটা মুরগি কেনার মুরোদ নাই, প্যান্ট-শার্ট পরে ভাব দেখাইতে আইছে।’ এই ভাবধরা মানুষগুলোর নাম বেসরকারি শিক্ষক।
স্নাতক-স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ একজন শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর মাধ্যমে প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইবা, পুলিশ ভ্যারিফিকেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক ধাপ পেরিয়ে তারপর হবু শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
শুরুতেই বেতন পান ১২হাজার ৫শ টাকা। এর সাথে ভাতা হিসেবে বাড়িভাড়া ১হাজার এবং চিকিৎসা ভাতা ৫শ টাকা মাত্র। এখানেও বেশ কয়েকটি বৈষম্য রয়েছে। একজন হবু শিক্ষক বিএড ডিগ্রি ছাড়া যোগদান করলে বেতন পান ১২হাজার ৫শ টাকা।
অন্যদিকে একই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়েও শুধুমাত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষি, বিপিএড, তথ্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে যোগদান করলে বিএড ছাড়াই মূল বেতন ধরা হয় ১৬হাজার টাকা। অথচ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শুরুতে বেতন ধরা হয় মাত্র ১২হাজার ৫শ টাকা। এসব বিষয়ের শিক্ষকরা কোন একদিন বিএড সম্পন্ন করলেই তবে ১৬হাজার স্কেলে বেতন প্রাপ্য হবেন।
মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ -শিক্ষা স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- প্রাইভেট, এমপিওভূক্ত এবং সরকারি। সাধারনত প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের টাকায় পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের থেকে টিউশন ফিসহ বিভিন্ন নামে টাকায় আদায় করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ব্যয় নির্বাহ করে।
যদিও এ স্তরে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিবার্হ নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় সরকার কতৃর্ক নির্দেশিত নিয়ম-কানুনে। এ স্তরে নিয়োজিত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সরকার দিয়ে থাকে তবে প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-কর্মচারীগণ বেসরকারি। তিনধরনের শিক্ষাব্যবস্থার তৃতীয়টি হচ্ছে সরকারি।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কথা হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলো সরকার থেকে কিছুই চাচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মে চলে। কিন্ত বেসরকারি বা এমপিওভূক্ত পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে নানান সীমাবদ্ধতা।
এর কয়েকটা উদারহন তুলে ধরছি: সরকারি শিক্ষকরা বাড়ীভাড়া পান মূল বেতনের ৪০%-৪৫%, অন্যদিকে এমপিওভূক্তরা পান মাত্র ১হাজার টাকা; সরকারি শিক্ষকরা বোনাস পান মূল বেতনের পুরো অংশ, অন্যদিকে এমপিওভূক্তরা পান মাত্র ২৫%; সরকারি ব্যবস্থায় বদলির সুবিধা থাকলেও এমপিওভূক্তদের বেলায় সে ধরনের কোনই সুবিধা নেই।
মুখ বুজে শত যন্ত্রণা সহ্য করা জনগোষ্ঠী হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক। সারা জীবনই এদের কপালে থাকে যন্ত্রণা। এরা প্রতিবাদ করতে জানেনা, শেকল ভাঙতে জানে না, গর্ত থেকে লাফিয়ে উঠতে জানে না। লোকলজ্জার ভয়ে এরা কাঁদতেও ভুলে যায়। পরিস্থিতির চাপে এরা একান্তই নিরীহ গৃহপালিত হয়ে ওঠে। । বেসরকারী শিক্ষকদের এই দুঃখ কবে শেষ হবে কেউ কি জানেন!
লেখক- শিক্ষক ও গবেষক।
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.