নিজস্ব প্রতিবেদক।।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাঁচ হাজার সনদ জালিয়াতির তদন্তে নেমে সিন্ডিকেট সদস্যদের ঘুষ লেনদেনের চমকপ্রদ তথ্য পাচ্ছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সনদ জালিয়াতি ও ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের ২৫ জনের তালিকা করেছে পুলিশ। এই তালিকায় একাধিক সরকারি সংস্থার কর্মকর্তার পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীরাও রয়েছেন। জালিয়াতির ঘটনা চাপা দিতে প্রায় দুই কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
জাল সার্টিফিকেট তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১ এপ্রিল বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে গত শনিবার বোর্ডের চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেহেলা পারভীনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিন লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শেহেলা পারভীনকে গতকাল রবিবার দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ জালিয়াতির বিষয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও গ্রেপ্তারের তালিকায় আছেন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা এখন আতঙ্কে আছেন।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ বাণিজ্যে জড়িত চক্রটির বিষয়ে জানতেন দুর্নীতি দমন কমিশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কম্পিউটার কাউন্সিলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও শিক্ষা বিটের সাংবাদিকরা। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে দুদকে একটি ফাইল হয়। ফাইল যাচাই-বাছাই কমিটিতে যায়। এরপর শামসুজ্জামান দুদকের এক সহকারী পরিচালককে (বর্তমানে তিনি অবসরোত্তর ছুটিতে) এক দফায় ৪০ লাখ এবং আরেক দফায় ২০ লাখ টাকা দেন। ঘটনাটি ধামাপাচা দিতে এক উপ-পরিচালককে ৩০ লাখ টাকা দেন। টাকা পেয়ে চুপসে যায় তদন্ত। মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি গেলে তদন্ত না করে পাঠানো হয় কম্পিউটার কাউন্সিলে। কম্পিউটার কাউন্সিলের তদন্ত কর্মকর্তা মাত্র ৪ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েই চুপসে যায়। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিবেদন করতে গেলেও একাধিক গণমাধ্যমকর্মীকে অর্থের মাধ্যমে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে ঘাটে ঘাটে টাকা দিয়ে পাঁচ হাজার সনদ জালিয়াতির বিষয়ে দীর্ঘদিন ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আমাদের দুদকের কর্মকর্তারা শামসুজ্জামানের নামে ফাইল খোলেন। তারপর সিদ্ধেশ^রীতে তার সঙ্গে বসে একাধিকবার কথাবার্তা বলে সেটাও স্থগিত হয়ে যায়। আর দুদকের সেই দুই কর্মকর্তাও অবসরে চলে যায়। সেখান থেকে তারা কিছু বাংলা টাকাও নেয়, আবার কিছু ডলারও নেয়। মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা আবার যখন এটা তদন্ত শুরু করেন; একপর্যায়ে তারা বলেন, এটা তো কম্পিউটারের বিষয়। কম্পিউটার কাউন্সিল এটা ভালো তদন্ত করতে পারবে। তারা তদন্ত থেকে বের হয়ে যায়। কম্পিউটার কাউন্সিল তদন্তের এক পর্যায়ে চুপ হয়ে যায়। সবাই চুপ হয়ে গেলে সে (শামসুজ্জামান) মনে করেছে, সব কিছুই ম্যানেজ করা যায়।
টাকা পেয়ে সাংবাদিকরা ম্যানেজ হয়েছে উল্লেখ করে হারুন অর রশীদ বলেন, কিছু কিছু সাংবাদিক তথ্য পেয়ে নিউজ করার কথা বলে ম্যানেজ হয়ে যায়। আর নিউজ করে না। আমরা যেদিন তাকে ধরে নিয়ে আসলাম সেদিনও কয়েকজন সাংবাদিক তাকে ফোন দিয়ে বলল, ‘ভাই সামনে ঈদ, কই দেখা করছেন না তো।’ ডিবির ধরে নিয়ে আসার বিষয়টি তারা জানতেন না।
ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাংবাদিকদের টাকা নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করেছেন শামসুজ্জামান। এর মধ্যে মূলধারার তিনটি প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক ও একজন সাংবাদিক নেতাসহ একাধিক ব্যক্তির নাম এসেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে শাসুজ্জামানের কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। সেই সঙ্গে একজন সাংবাদিক নেতা তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে যারাই জড়িত থাক না কেন, আমরা কাউকে ছাড় দেব না। আমরা এখন পর্যন্ত কাউকে ছাড় দেইনি। এই চক্রের সঙ্গে যত বড় রাঘববোয়াল জড়িত থাকুক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। আমাদের তথ্য উপাত্তে যদি চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতা থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে আমরা তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করব। আমরা যে কোনো সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকব।
এদিকে, গতকাল বিকেলে শেহেলা পারভীনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। অন্যদিকে, রিমান্ড বাতিল করে শেহেলা পারভীনের জামিনের আবেদন করেন তার আইনজীবী। শুনানি শেষে আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে দুই দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গতকাল রবিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ঘুষের অভিযোগ প্রসঙ্গে শেহেলা পারভীন ডিবি পুলিশের কাছে দাবি করেছেন মেয়ের বিয়ের খরচের জন্য ধার হিসেবে তিনি কুষ্টিয়ার গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার কলির কাছ থেকে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন। এই টাকার বিষয়ে তার স্বামী কিছুই জানতেন না। পরে তিনি এই টাকা শোধ করে দিতে চেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় কলিকে আগেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে একজন ডিবি কর্মকর্তা জানান, উৎসব পার্বণসহ বিভিন্ন সময়ে শাসুজ্জামান বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা করে দিতেন। বিভিন্ন সংস্থাসহ সাংবাদিকদের দেওয়ার জন্য পোশাক কিনে দিতেন। তবে সনদ জালিয়াতির সঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যানের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে এখন পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কোনোভাবেই তিনি সনদ জালিয়াতিসহ দুর্নীতি ও দায়িত্ব অবহেলার দায় এড়াতে পারেন না।আমাদের সময়
শিক্ষাবার্তা ডট কম/জামান/২২/০৪/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.