শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশ থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থী কমছে। গত তিন বছরের তথ্য বলছে, প্রতিবছরই বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল কয়েকটি কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী কমতে পারে। প্রথমত, শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মান না থাকা। আবার বিদেশ থেকে পড়তে আসা সব শিক্ষার্থীর জন্য উপযুক্ত পরিবেশও বড় বিষয়। এ ছাড়া আগে যেসব দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসতেন, সেসব দেশেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার চিত্রটি উঠে এসেছে গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি করা হয়েছে ২০২২ সালের তথ্যের ভিত্তিতে। তখন দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ৫৩টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ১১০টি (১০০টির শিক্ষা কার্যক্রম ছিল)। অবশ্য এখন সংখ্যাটি আরও বেড়েছে। অধিভুক্ত কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ দেশের সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭ জন।
ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ২ হাজার ৩১৭ জন। পরের বছর (২০২১) তা হয় ২ হাজার ২৮১ জন। ২০২২ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৫৭ জনে।
জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, একদিকে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে, আবার দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যাচ্ছেন। কয়েকটি কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী কমতে পারে। এখানে শিক্ষার পরিবেশ ও মানের ঘাটতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে কিন্তু যোগ্য শিক্ষক তৈরি করা যাচ্ছে না। মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। আবার আগে যেসব দেশ থেকে পড়তে আসতেন, সেসব দেশ উচ্চশিক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে। সেসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে। যেমন মালয়েশিয়া, নেপাল, ভুটান।
২৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী
২০২২ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ২৬টিতে ৬৭০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তেন। এর মধ্যে ছাত্র ৫০৪ জন ও ছাত্রী ১৬৬ জন। আগের বছর ২০২১ সালে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল ৬৭৭ জন। ২০২০ সালে ছিলেন ৭৬৭ জন। বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করছেন গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ১৯১ জন। এর পরেই আছে দিনাজপুরে অবস্থিত হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ১১৭ জন। বিদেশি শিক্ষার্থীর দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়—৭২ জন। এ ছাড়া গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৯ জন, রাজধানীতে অবস্থিত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ জন। বাকি যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী আছেন, সেগুলোর একেকটিতে ১৫ জনের নিচে।
একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে আসতেন। এ জন্য ‘স্যার পিজে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হল’ নামে আলাদা একটি আবাসিক হল করা হয়েছিল। বর্তমানে এই হলে যৎসামান্য বিদেশি শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তরুণ শিক্ষকেরা থাকেন।
নাইজেরিয়া থেকে বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন ইবরাহিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্স বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন। থাকছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলে। ইবরাহিমের ভাষ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার চ্যালেঞ্জ ও খরচ বেশি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাঁর জন্য ভালো গন্তব্য ছিল।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১০ বছরে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোনো বছরই এক হাজার ছাড়ায়নি। ১০ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই বছর ৮০৪ জন বিদেশি শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।
৩২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৭ দেশের শিক্ষার্থী
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে দেশে ১০০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাক্রম চালু ছিল। তার মধ্যে ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন ১ হাজার ২৮৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে ২৬০ জন ছাত্রী। আগের বছর ২০২১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী ছিলেন ১ হাজার ৬০৪ জন। এক বছরের ব্যবধানে ৩১৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী কমেছে।
ইউজিসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ৩৭টি দেশের শিক্ষার্থীরা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। দেশগুলো হলো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, দক্ষিণ সুদান, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, মরক্কো, কোরিয়া, নাইজেরিয়া, ইরান, তানজানিয়া, মিয়ানমার, রুয়ান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সিয়েরা লিওন, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, পাপুয়া নিউগিনি, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), জার্মানি, ক্যামেরুন, তুরস্ক, কেনিয়া, ঘানা, উগান্ডা, লাইবেরিয়া ও জিবুতি।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও করণীয় জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্বে) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, তিনি মনে করেন বিদেশি শিক্ষার্থী কমার একটি কারণ হতে পারে তারা যেভাবে আকৃষ্ট হতো, সে রকম মানসম্মত শিক্ষা হয়তো দেওয়া যাচ্ছে না। আবার বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যে পরিবেশ দেওয়া দরকার, সেই পরিবেশটি হয়তো ততটা নেই। এ জন্য উচ্চশিক্ষার পরিবেশ আরও শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে এবং শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষার মানের জন্য শিক্ষকদের মানও বাড়াতে হবে। প্রথম আলো
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১২/০২/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.