চট্টগ্রামঃ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ২০২৩ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও সনদ লেখা, যাচাই, স্বাক্ষর এবং পাঠানোর কাজে সম্মানী নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। বোর্ডের ১০১ কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে এসব কাজ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সম্মানী নিয়েছেন ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শুধু তাই-ই নয়, গেল সাত বছরে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির নম্বরপত্র ও সনদপত্র-সংক্রান্ত কাজে সম্মানীর নামে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বোর্ডের তহবিল থেকে লোপাট করেছেন ছয় কোটি টাকার বেশি।
শিক্ষা বোর্ড কর্তাদের দাবি, আন্তঃবোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই অতিরিক্ত সম্মানী দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর বলছে, এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ লঙ্ঘন এবং আর্থিক অনিয়ম। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করে বোর্ড তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন। সম্মানী ছাড়াও গত তিন অর্থবছরে শিক্ষা বোর্ডের আরও ১১ ধরনের আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। এতে আরও ছয় কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা বোর্ডে যারা কর্মকর্তা হিসেবে আছেন, তাদের অধিকাংশই শিক্ষক। তারা যখন এসব কাজ করেন, তা দুঃখজনক ও লজ্জার। তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।’
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা গেছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড চট্টগ্রামের ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার নম্বর ও সনদপত্র লেখা, যাচাই, স্বাক্ষর ও পাঠানোর কাজে অতিরিক্ত সম্মানী নেওয়া হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৯২৮ টাকা। এ ছাড়া নির্ধারিত হারে আয়কর না কাটা, শেয়ার মানির নামে বিজি প্রেসকে টাকা দেওয়া, আরএফকিউ পদ্ধতিতে বার্ষিক নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত মালপত্র কেনা, সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দেওয়া, ঠিকাদারের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করা, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেওয়া অগ্রিম টাকা সমন্বয় না করা, দীর্ঘমেয়াদি ঋণে নির্ধারিত হারের চেয়ে কম সুদ আদায়, যন্ত্রপাতি ও উত্তরপত্রের কাগজ কেনায় অনিয়ম এবং ব্যাংকের নিয়মিত হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা থাকার পরও এফডিআর করে না রাখায় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
সম্মানীর নামে ৬ কোটি টাকা লোপাট
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মানী ভাতা-সংক্রান্ত আদেশ অনুযায়ী পরীক্ষার নম্বরপত্র বিষয়ক কাজের জন্য নম্বরপত্রপ্রতি এসএসসির জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা ও এইচএসসির জন্য ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসএসসির জন্য নিয়েছেন ২২ টাকা ও এইচএসসির জন্য ৩৭ টাকা । গত সাত বছরে এভাবে দুটি পরীক্ষার নম্বরপত্র-সংক্রান্ত কাজে তারা অতিরিক্ত নিয়েছেন ২ কোটি ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ১১৯ টাকা।
একইভাবে এসএসসি ও এইচএসসির সনদ-সংক্রান্ত কাজের জন্য সনদপ্রতি ৫০ টাকা হারে নির্ধারণ করা হলেও তারা নিয়েছেন ৬৪ টাকা। প্রতি নম্বরপত্রে অতিরিক্ত নিয়েছেন ১৪ টাকা। এভাবে তারা সম্মানীর নামে একই সময়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ১ কোটি ৮৮ লাখ ১৮ হাজার ৮২৮ টাকা। এ ছাড়া জেএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন, পূর্বপ্রস্তুতি, পরিচালনা ও ফল প্রকাশ, নম্বরপত্র, সনদপত্র এবং পুনর্নিরীক্ষণ সংক্রান্ত কাজে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্মানী দেওয়ার বিধান নেই। তবে ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে সম্মানী নিয়েছেন ১ কোটি ৬২ লাখ ৩১ হাজার ৭২ টাকা।
পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রক্রিয়াকরণ এবং প্রকাশ কাজ অনলাইন ও কম্পিউটারে হয়। অষ্টম জাতীয় সংসদের হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চতুর্থ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই কাজের সম্মানী পাবেন কম্পিউটার শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসএসসি পরীক্ষায় ১০৬ জন ও এইচএসসির ১০৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে নিয়েছেন ২৩ লাখ ৯৬ হাজার ৯০৯ টাকা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন বলেন, ‘আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অতিরিক্ত হারে সম্মানী দেওয়া হয়। তবে অডিট অধিদপ্তর আগের সম্মানী হারকে বিবেচনায় নিয়ে অডিট করায় বাকিটা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এগুলো নিষ্পত্তিযোগ্য আপত্তি। জবাব দিলে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।’ তবে প্রতিবেদনে শিক্ষা বোর্ডের জবাবের প্রতি উত্তরে আপত্তি নিষ্পত্তিযোগ্য নয় ও টাকা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘এটি প্রাথমিক পর্যায় থেকে বলা হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ে এটি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।’
১১ অনিয়মে ক্ষতি আরও ৬ কোটি
সম্মানী ছাড়াও তিন অর্থবছরে ১১টি অনিয়মে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা। এর মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্মানী নিলেও সরকার নির্ধারিত ১০ শতাংশ আয়কর দেননি। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির গোপনীয় মুদ্রণ কাজ ও শেয়ার মানির নামে বিজি প্রেসকে ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩৮ টাকা দেওয়া হয়। তবে কোন কাজের বিপরীতে এই টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, এর কোনো বিবরণ বোর্ড কর্তাদের কাছে নেই। কোনো কাজ না করেই এই টাকা বিজি প্রেসকে দেওয়া হয়েছে বলে অডিট অধিদপ্তরের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী, আরএফকিউ (কোটেশনের অনুরোধ) পদ্ধতিতে পণ্য ক্রয়ের বার্ষিক আর্থিক মূল্যসীমা ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৩ লাখ টাকার অতিরিক্ত মালপত্র কেনাকাটা করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড। এ ছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট ও আয়কর আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৪২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। বিভিন্ন কাজে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেওয়া অগ্রিম টাকা সমন্বয় না করায় ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৬ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৯ টাকা। গৃহনির্মাণ, ঘর মেরামত, মোটরসাইকেল ও কম্পিউটার কেনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের কাছ থেকে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে সুদ নেওয়া নিয়মে থাকলেও তা আদায় করেনি শিক্ষা বোর্ড। নির্ধারিত হারের চেয়ে কম সুদ নেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ১৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬৫২ টাকা। ওএমআর মেশিনের যন্ত্রপাতি ও উত্তরপত্রের কাগজ কেনাকাটায় অনিয়মে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নিয়মিত হিসাবে স্থিতি টাকা এফডিআর করে না রাখায় ক্ষতি হয়েছে ৬৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯ টাকা।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের উপপরিচালক (হিসাব ও নিরীক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ এমদাদ হোসাইন বলেন, ‘আগের এসব বিষয় নিয়ে আমার জানা নেই। আমি পরে যোগদান করেছি।’ সমকাল
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.