মোস্তফা হোসেইন: সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ের ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে তোলপাড় সমাজমাধ্যমে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস শরীফার গল্পকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টিকারী হিসেবে উল্লেখ করে প্রকাশ্যে ওই বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে তার ক্ষোভ ঝেড়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আহ্বান জানিয়েছেন বাজার থেকে বইটি কিনে এ অংশটুকু ছিঁড়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে। তার যুক্তি ছিল শরীফার গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ট্রান্সজেন্ডারের পক্ষে টানার চেষ্টা করা হয়েছে, যা ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ অবৈধ।
ধর্মীয় অনুভূতির প্রসঙ্গ এলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এমনিতেই দ্রুত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি। সমাজমাধ্যমে এর পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল ডিজিটাল লড়াই শুরু হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আহ্বায়ক ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুর রশীদ। সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, এনসিটিবির সদস্য, মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশিদ।
উন্মুক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে যে-কেউ তার মতামত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে যেকোনো বিষয় এত দ্রুত জনে জনে ছড়িয়ে পড়ছে। কিছু ধর্মান্ধ এ বিষয়ে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে অন্যদের উস্কে দিয়েছে। অথচ উত্তেজিত মানুষের কিয়দংশও যে বইটি পড়া দূরের কথা, এক পলক দেখেওনি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাদের বক্তব্য পড়লে দুয়েকটিতে ধর্মীয় অজ্ঞতার লক্ষণ দেখা যায়। অধিকাংশই মনে হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক উৎস বিষয়টিকে ট্রান্সজেন্ডারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এ বিষয়ে ইসলামি বিধান ও ইসলামপূর্বকালে একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার কথাও মনে করিয়ে দেন। অথচ কথিত সমকামিতার কোনো প্রসঙ্গই গল্পে নেই। কিংবা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টিও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শরীফার গল্পে যার উপস্থিতিই নেই, সেই কল্পিত তথ্য তিনি উপস্থাপন করে অনেককে বিভ্রান্ত করেছেন। এমন একটি বিষয়কে তিনি নিজে থেকে উপস্থাপন করেছেন, যা দেশের সামাজিক অবস্থানে ঘৃণার চোখে দেখা হয়। একজন শিক্ষক মিথ্যা বলতে পারেন না এমনটিই খুব সঙ্গত ভাবনা। অন্যদিকে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় ডিজিটাল জগতে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
সমাজমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ার পর তার ব্ক্তব্যের বিপক্ষে যারা যুক্তি দেখাচ্ছেন তাদের পোস্টে বইটির ছবিও সংযোজন করে দিচ্ছেন। মূল গল্পে ট্রান্সজেন্ডারের কোনো প্রসঙ্গই নেই। আছে থার্ড জেন্ডার ও হিজড়াদের প্রসঙ্গ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির অনন্য প্রয়াস হিসেবে গল্পটিকে যেখানে বর্ণনা করা যায়, সেখানে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক এই শিক্ষক কেন ট্রান্সজেন্ডারের সঙ্গে তুলনা করলেন তা বোঝা মুশকিল। এ প্রসঙ্গে একজন ইসলামি চিন্তাবিদের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, শরীফা গল্পে নিজেকে ভিন্ন লিঙ্গের মনে হতে থাকাটা আসলে ট্রান্সজেন্ডারের লক্ষণ বলা যায়। তার মতে, যে কারণে শরীফা হিজড়াদের সমাজে যাওয়ার পরও তাকে ট্রান্সজেন্ডারভুক্ত বলে মনে করা যেতে পারে।
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বুঝতে পারি বারো কারোর মাথায় অনেক উদ্ভট চিন্তাই আসে। বয়ঃসন্ধিক্ষণের এসব চিন্তার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না। মনোদৈহিক পরিবর্তনকালের এ চিন্তাকে ট্রান্সজেন্ডারের লক্ষণ ভেবে এই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি কোন যুক্তিতে বিতর্কের উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয় তা বোঝার বাইরে। গল্পে শরীফা কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার হয়নি, সে গেছে হিজড়াদের কাছে। দেখেছে হিজড়াদের সমাজের গুরুমা কীভাবে তাদের সমাজ পরিচালনা করেন। সর্বশেষ গল্পের শেষাংশে ২০১৩ সালে থার্ড জেন্ডার কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ কিংবা হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। গল্পের বার্তা ওখানেই। হিজড়ারা যে মানুষ এবং তাদের যেন অবহেলা না করা হয়, বরং মানবিক আচরণ করা হয় সে শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে। অথচ বিরুদ্ধবাদীরা তাকে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে আখ্যায়িত করে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছেন। তারা সহায়ক অংশে উল্লিখিত একটি শব্দ ট্রান্সজেন্ডারকে তাদের মন্তব্যে জোর দিয়ে উপস্থাপন করে; যা গল্পে নেই। সহায়ক অংশে বলা হয়েছে, তৃতীয় লিঙ্গ ও ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে পরে আলোচনা হতে পারে। এ একটি শব্দই তাদের মূল তর্কের বিষয়। তারা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়টিকে অবশ্যই পরিত্যাজ্য হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারে। কারণ আমাদের আইন, আমাদের সমাজ তা গ্রহণ করে না। এটি ধর্মীয়ভাবে গ্রহণ করা হয় না।
প্রশ্ন হচ্ছে- খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি চরম অমানবিক বিষয়ের মতো যেসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সমাজে সেগুলো এভাবে তাদের আলোচনায় আসে না। কেউ এমন অপরাধ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সবাইকে শিখতে হয় কেন এগুলো অপরাধ হিসেবে গণ্য। মিথ্যা বলা পাপ, এও কিন্তু আমাদের পড়ে পড়েই শিখতে হয়। এখন কোনো পাপ যদি আলোচনাতেই না আসে তাহলে পাপপুণ্য অনুধাবনের সুযোগ থাকবে কি? সুতরাং সহায়ক অংশের একটি শব্দকে আপত্তিজনক ভাবারও যুক্তি দেখি না। তর্কের খাতিরে যদি বলা হয় এটি আপত্তিজনক, তার পরও কি ওই খণ্ডকালীন সাবেক শিক্ষক এভাবে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে মানুষকে উস্কে দিতে পারেন? একজন শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা শিখছে ভিন্নমত পোষণ করলে বই ছিঁড়ে ফেলতে হয়! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় হওয়ার পর সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকারের দায়িত্ব হিসেবে। একজন গুজব সৃষ্টিকারীর মন্তব্যের কারণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণকে কেউ দুর্বলতা ভাবতে পারে কি না তা-ও ভেবে দেখা উচিত। গুজবে কত জীবন ও সম্পদের সর্বনাশ হয়েছে, সমাজ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এমন অনেক নজির আমাদের আছে। তাই গুজব রটনাকারীদের প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখানো উচিত নয় বলেই মনে করি। গুজব রটনাকারী যে-ই হোন, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রয়াস শুভবোধসম্পন্ন কেউ চালাতে পারেন না।
অনেকে ওই শিক্ষকের কর্মকাণ্ড কোচিংবাণিজ্যের পক্ষের লড়াই হিসেবে মনে করছেন। কিন্তু এই শিক্ষক যখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন তখন বিষয়টি নিয়ে নতুন করে চিন্তার তাগিদ জাগে। সুতরাং একটি বইয়ের পৃষ্ঠা ছেঁড়ার ঘটনা গুরুত্বসহ বিশ্লেষণ ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমাদের সমাজে আঁধার কেন কাটে না এ ঘটনা এরই একটি খণ্ডিত দৃষ্টান্ত।
সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩১/০১/২০২৪
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.