আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ ভালো শিক্ষক যাদের পাঠদানে কলেজের পড়াশোনার মান এবং ফলাফল বৃদ্ধি পায় এমন শিক্ষকদের গভর্নিং বডির আবেদনের প্রেক্ষিতে অবসরের পরেও শর্ত স্বাপেক্ষে পাঠদানের অনুমতি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পাঠদানের জন্য এক্সটেনশন করিয়ে এনে পাঠদান না করিয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলীর ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজের সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত ও সাবেক উপাধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথের বিরুদ্ধে।
সাবেক উপাধ্যক্ষ ও সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ ইং তারিখে অবসরে গেলেও তাকে প্রতিষ্ঠানটির পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে পুনরায় সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে (প্রাপ্যতা না থাকা স্বত্বেও) এক বছরের জন্য এক্সটেনশন করিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি। তবে পাঠদানের কথা বলে মেয়াদ শেষে অতিরিক্ত এক বছরের জন্য আনা হলেও তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার টাকা সম্মানী নিচ্ছেন এবং সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক (পাঠদান করানোর জন্য) হিসেবে ১৫ হাজার টাকা।
আরও পড়ুনঃ ৩য় বিভাগে ডিগ্রী পাসেই ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাহমিনা
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরির শর্তাবলি সংশোধিত রেগুলেশনে ২০১৯-এর ধারা- ১৫ (ক) তে বলা আছে, কোন শিক্ষকের বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে সেদিন থেকেই তিনি অবসরে যাবেন। তবে শর্ত থাকে যে বয়স ৬০ বছর অতিক্রম করলেও গভর্নিং বডি তাকে পাঠদানের স্বার্থে এক্সটেনশন করাতে পারবেন। সেটা শুধু পাঠদানের স্বার্থে। কিন্তু পাঠদানের স্বার্থ দেখিয়ে স্বপন কুমার নাথকে এক্সটেনশন করলেও তিনি কোন ধরণের পাঠদান না করিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের রুমের পাশের চেয়ারে বসছেন কোন ধরণের ক্লাস তিনি নিচ্ছেন না। এই স্বপন কুমার নাথই গভর্নিং বডিকে প্রভাবিত করেই ডিগ্রি (পাস) ৩য় বিভাগ ফলাফল থাকা কম যোগয়তা সম্পন্ন তাহমিনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সবচেয়ে যোগ্য দেখিয়ে তাকে দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন।
জানা গেছে, কলেজটির অধ্যক্ষ আসলাম হোসেন ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেলে উপাধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান এবং চলতি মাসের গত ২২ তারিখে অবসরে গেলে তাকে পাঠদানের জন্য সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এক বছর এক্সটেনশন করায় গভর্নিং বডি। প্রতিষ্ঠানটিতে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রি শ্রেণিতে ২৭ জন, একাদশ শ্রেণিতে ১০৫ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ১০৭ জন শিক্ষার্থী এবং দুই জন শিক্ষক রয়েছেন। প্রাপ্যতা অনুযায়ী অন্যান্য বিভাগের দুই জনের বেশি শিক্ষক না থাকলেও (সমাজবিজ্ঞানে দুই জন শিক্ষক বর্তমা বিদ্যমান) সমাজবিজ্ঞানে পাঠদান করানোর কথা বলে স্বপন কুমার নাথকে অবসরের পরেও এক বছর চাকুরীর মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রবিবার (২৬ নভেম্বর) প্রতিষ্ঠানটির এইচএসসির ফলাফল বিপর্যয়ের চিত্র দেখা গেছে। কলেজটি থেকে এবার ৫৮৫ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করলেও পাস করেছে মাত্র ৩১৮ জন। পাসের হার ৫৪.৩৬ শতাংশ। একজন শিক্ষার্থীও জিপিএ-৫ পাননি।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র বলছে, স্বপন কুমার নাথ চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পাওয়ার পর শিক্ষার্থী থেকে শুধু বেতন ফি এবং অর্থ আদায় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা এবং পড়াশোনার দিকে নূন্যতম নজর দেননি। ফলশ্রুতিতে ফলাফলের এই বিপর্যয়।
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি (পাস) শ্রেণির ২য় বর্ষের ফল প্রকাশ করে। আর এই ফলাফলেও বিপর্যয় দেখা গেছে ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজের। ৪৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ১৬ জন। পাসের হার ৩৪.৭ শতাংশ। স্বপন কুমার নাথের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
একাধিক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেক অভিভাবক আছেন যারা খুবই নিন্ম আয়ের। আমরা কলেজের বেতন-ফি ও আনুষঙ্গিক ফি কমানোর জন্য স্বপন কুমার নাথের কাছে গেলে তিনি আমাদের অপমান করে বলেন আমরা কি এতিম খানা খুলে বসছি। এক পয়সা কম তিনি নেননি বরং অভিভাবকদের অপদস্থ করেছেন একাধিকবার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক বলেন, স্বপন কুমার নাথ মূলত এখনও ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে আছে। খাতা কলমে তাহমিনা বেগম ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলেও অধ্যক্ষের চেয়ার পাশেই বসছেন তিনি। স্বপন কুমার নাথ যে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন তা-ই বাস্তবায়ন করছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। ফলে প্রশাসনিক যে ব্যর্থতা তা সহজেই প্রতিষ্ঠানটি থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আর এই কারণে কলেজটির ফলাফলে সহসা পরিবর্তনের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খ্যাতিমান চিকিৎসক ডাঃ ফজলুল আমীন যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৮৮ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে স্বপ্ন আজ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠির সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগের যে ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন ডাঃ ফজলু আমিন তা আজ নিষ্পেষিত হচ্ছে। ক্রমেই ফলাফল নিন্মমূখী। এভাবে চলতে থাকলে খুব বেশি দিন লাগবে না শূন্য পাস করা কলেজের তালিকায় নাম উঠানোর এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটির।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী, শুধুমাত্র পাঠদানের স্বার্থে কোন শিক্ষককে অবসরের পরে এক্সটেনশন করা হয়। কিন্তু সদ্য সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার নাথ আপনার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন পাঠদান না করিয়ে জিজ্ঞেস করলে গত সোমবার কলেজটির সদ্য নিয়োগ পাওয়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তাহমিনা বেগম বলেন, এটা তো আমি বলতে পারব না জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং গভর্নিং বডি বলতে পারবে।
পাঠনাদের স্বার্থে এবং শর্তে চাকুরীর মেয়াদ বৃদ্ধি পাওয়া স্বপন কুমার নাথ শিক্ষাবার্তা’কে এর আগে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিধির আলোকের কারণে সহজেই অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মধ্যে যাকে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তো প্রশাসনিক কাজ বুঝবে না। তাই গভর্নিং বডি আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। এক্সটেনশন পেলেন সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এবং পাঠদানের শর্তে মূল দায়িত্ব রেখে উপদেষ্টার বিষয়টি বিধি সম্মত কি’না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন বিধি সম্মত। সম্মানী নেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, গভর্নিং বডি চাইলে আমাকে ৫ লাখ টাকা করে সম্মানী দিতে পারে এর পর তিনি কথা শেষ না করেই মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
বৃহস্পতিবার তিনি শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমাকে কমিটি দায়িত্ব দিয়েছি আমি নিয়েছি। প্রশাসনিক ব্যর্থতায় ফল বিপর্যয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি ১১ মাস ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলাম। এই অল্প সময়ে তো আমি সব পরিবর্তন করে ফেলতে পারব না। এখানে ১.৫ বা ২ পয়েন্ট পাওয়া এবং খুব গরিব শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়। ফলে চাইলেও রেজাল্ট ভালো করা এত সহজে সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জানতে কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ডাঃ মোঃ আরিফুল আমীনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার মুঠোফোন সচল থাকলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক ফাহিমা সুলতানা শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, গভর্নিং বডির আবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা চাকরীর মেয়াদ বৃদ্ধি করে। সেটা শর্ত থাকে পাঠদানের। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করার কোন সুযোগ নেই। গভর্নিং বডি যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করে তাহলে আমরা কতটুকু করতে পারি বলেন। তবে বিষয়টি আমরা দেখব। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করব।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.