ঢাকাঃ প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকার পরেও অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি রেজিস্ট্রার ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস মো. জাকির হোসেন এবং উপ-রেজিস্ট্রার আবু হানিফাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে এই বরখাস্তের আদেশ জারি হয়।
শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তদন্তের আলোকে ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সাময়িক বরখাস্তের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না এ মর্মে তাদেরকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।
জাকির হোসেন ও আবু হানিফাকে বরখাস্তের চিঠিতে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তদন্তে একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এবং গত ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন বিধি অনুযায়ী তারা প্রয়োজনীয় খরপোশ পাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, জাকির হোসেন ও আবু হানিফার নিয়োগ যে অবৈধ সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সেই আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত জুন মাসেই চিঠি দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সিন্ডিকেটের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকায় গত ৪ নভেম্বর তাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একইসঙ্গে তাদেরকে কেন স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না সে মর্মে কারণ দর্শাতে বলা হয়। এছাড়া সিন্ডিকেট তাদের বিরুদ্ধে একটি ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। যে কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকে।
এদিকে গত সোমবার জাকির হোসেন ও আবু হানিফা সাময়িক বরখাস্তের আদেশ পাওয়ার পর নানাভাবে তা বাতিলের চেষ্টা করেন। বরখাস্তের আদেশ বাতিল না করলে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ারও হুমকী দিয়েছেন ওই দুইজন। এমনকি তারা তাদের রুম ছাড়তেও গড়িমসি করেন। পরে গত মঙ্গলবার তাদের রুমে তালা দিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে তাদের আর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি। তবে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সিন্ডিকেটে জড়িত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জাকির-হানিফা আন্দোলনে নামার জন্য উস্কানি দিচ্ছেন।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়ে জাকির হোসেন ও আবু হানিফা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তারাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের অঘোষিত হর্তাকর্তা হয়ে যান। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই দুই কর্মকর্তা ভিসির চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন কাজই সম্ভব হতো না তাদের অনুমতি ছাড়া। তাদের কাছে না গেলে অনেক কাজই আটকে থাকতো। মাদরাসা পরিদর্শন ও অনুমোদনেও তারা বড় অংকের অর্থ আদায় করতো। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটাসহ নানা কাজেও তারা কমিশন আদায় করতো বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তের ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমরা সেটি অনুসরণ করেছি। এছাড়া একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
দেশের আলেম-ওলামা ও মাদরাসা শিক্ষকদের সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দাবী পুরণ করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি গৌরবময় ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু আলেম সমাজের প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে প্রাক্তন ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আহসান উল্লাহর অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের কারণে। নৈতিকতা শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি তৎকালীন ভিসি ও তার ঘনিষ্ঠ অনুসারিদের অনিয়ম, জালিয়াতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আর এসব অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। গত ১৯ জুন তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসিকে নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
বয়স-অভিজ্ঞতা-যোগ্যতা ছাড়াই জাকির হোসেন সহকারী রেজিস্ট্রার :
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস জাকির হোসেনকে অবৈধভাবে বয়স ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেন আহসান উল্লাহ। যথাযথ নিয়োগপ্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়াই বিধিবহির্ভূতভাবে মো. জাকির হোসেনের ব্যক্তিগত আবেদনের প্রেক্ষিতে ভিসির একক সিদ্ধান্তে মো. জাকির হোসেনকে নিয়োগপত্রে নিয়োগের ধরণ, শর্ত এমনকি বেতন স্কেল কোন কিছুই উল্লেখ না করে অস্থায়ীভিত্তিতে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত চাকরির নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা ্র প্রার্থীকে যে কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হতে হবে এবং শিক্ষা জীবনে সকল পরীক্ষায় কমপক্ষে দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী/সমমান গ্রেড থাকতে হবে ” ও অভিজ্ঞতা “ প্রার্থীকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেকশন অফিসার বা সমপর্যায়ের (জাতীয় বেতন স্কেলের ৯ ম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব পদে কমপক্ষে ৫ (পাঁচ) বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। শর্ত থাকা সত্ত্বেও জাকির হোসেনের একটিতে অর্থাৎ স্নাতকে ৩য় শ্রেণী এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেকশন অফিসার বা সমপর্যায়ের (জাতীয় বেতন ছেলের ৯ম গ্রেড ও তদূর্ধ পদে কমপক্ষে ৫ বছর কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি সহকারী রেজিস্ট্রারের শূন্য পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। অথচ ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৩ এর ধারা-১২ এ উল্লিখিত ভাইস চ্যান্সেলরের ক্ষমতা ও দায়িত্বে অস্থায়ীভিত্তিতে জনবল নিয়োগের ক্ষমতার বিষয়ে উল্লেখ নেই। কিন্তু ভিসি মো. জাকির হোসেনকে অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করেছেন।
প্রাক্তন ভিসির ঘনিষ্ট সহচর উপ-রেজিস্ট্রার আবু হানিফা
বিগত বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ড. আবু হানিফাকে অবসর সুবিধা বোর্ডে মূল্যায়ন কর্মকর্তা হিসেবে সুপারিশে কোন বিজ্ঞপ্তি বা নিয়ম নীতি ছাড়াই অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে যাকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার হিসেবে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অনৈতিকভাবে ভিসি তার একক ক্ষমতাবলে নিয়োগদান করে তার মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, বাড়িভাড়া ও যাবতীয় ক্রয় করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি মো. আবু হানিফাকে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-রেজিস্ট্রার পদে প্রেষণে পদায়ানের আদেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দিনে তিনি ওই পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ ও ১৮ জানুয়ারি ৩য় সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেষণে কর্মরত প্রার্থী হিসেবে আবু হানিফা উপ-রেজিস্ট্রারের স্থায়ী পদে আবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে করেননি। তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বা সমপর্যায়ের পদে ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ১ম শ্রেণির পদে মোট ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত রয়েছে। কিন্তু আবু হানিফার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কাজের কোন অভিজ্ঞতা নেই। সিন্ডিকেটের অনুমোদন না নিয়ে ভিসি উপ-রেজিস্ট্রার পদের তফসিল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের তফসিল নিজেই অনুমোদন করেছেন। যা তিনি আইনত করতে পারেন না। এছাড়া আবু হানিফার ক্ষেত্রে শিথিলের শর্ত প্রযোজ্য হবে না। এ থেকে তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, আবু হানিফার নিয়োগটি যথাযথভাবে হয়নি।
তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ভিসির ক্ষমতা ও দায়িত্বের মধ্যে অস্থায়ীভিত্তিতে বা কোনভাবে জনবল নিয়োগের কোন উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও আহসান উল্লাহ আইনের তোয়াক্কা না করে, সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদন না নিয়ে বেআইনিভাবে একক ক্ষমতাবলে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে মো. জাকির হোসেনের শিক্ষা জীবনে একটিতে ৩য় বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট পদের প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি সহকারী রেজিস্ট্রারের স্থায়ী পদে নিয়োগ প্রদান করেন। যা আইনত অবৈধ। নিয়োগটি শুরু হতেই বাতিল (ভয়েড এড ইনিশিও) বিধায় জাকির হোসনকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
একইভাবে মো. আবু হানিফাকে উপ-রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে, বিধায় তার নিয়োগের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ/কার্যবিবরণীর মূলকপি না থাকা এবং নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের সুপারিশ/কার্যবিবরণীর যে ফটোকপি দেয়া হয়েছে তা টেম্পারিং করা বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়।
তিনি কয়েকদফা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক রেজিস্ট্রার রোশন খানের সাক্ষ্যমতে আহসান উল্লাহ আবু হানিফার নিকট সকল গোপনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল কাগজপত্র সংরক্ষণ করতেন। তাই উক্ত টেম্বারিংয়ের দায় আবু হানিফার ওপরও বর্তায়। এক্ষেত্রে বেআইনীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এরুপ অসৎ একজন ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় হতে অবিলম্বে অপসারণের সুপারিশ করা হয়।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.