নিজস্ব প্রতিবেক, ঢাকাঃ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আবারো উত্তাপ বাড়ছে। এবার দেশব্যাপী অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করে রাজধানী ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতির ত্রিভুজ চিহ্ন বাতিল করে আগের মতো নম্বরভিত্তিক পরীক্ষা চালুর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরাম। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আগামী ২৪ নভেম্বর ঢাকায় অভিভাকক ও শিক্ষার্থীদের একত্রিত করে সরকারকে সর্বশেষ চূড়ান্ত একটি বার্তা দেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
অন্য দিকে অভিভাবকদের এ ধরনের কর্মসূচিকে বরাবরের মতোই কুচক্রী মহলের উসকানি বলে সতর্ক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি জানিয়েছেন নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ার পর নোট বই এবং কোচিং ব্যবসায় ধস নামবে। ব্যবসায় ধসের এই আশঙ্কায় তারা অভিভাকদের মাঠে নামানোর অপচেষ্টা করছে। তবে শিক্ষকদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হবে না বলেও মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন।
নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে আগামী ২৪ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরাম। সংগঠনটি গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে নতুন শিক্ষাক্রমের বেশ কিছু ত্রুটিও চিহ্নিত করেছেন।
অভিভাবকরা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে ত্রিভুজ চিহ্ন বাতিল করে আগের মতো নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই কারিকুলামটি এ দেশের জন্য অনুপযুক্ত। নতুন এই কারিকুলাম সংস্কার করে অন্তত ৫০-৬০ নম্বরে দুই সাময়িক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন করা হোক। প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল, স্কুল পিরিয়ডে সব প্রজেক্ট সম্পন্ন করা এবং সব ব্যবহারিক ব্যয় স্কুলকে বহন করতে হবে। একই সাথে নতুন কারিকুলাম বাতিল, নম্বরভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা চালু, নবম শ্রেণীতে বিভাগ বিভাজন রাখাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরাম।
ফোরাম নেতারা জানান, আগামী ২৪ নভেম্বর ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অভিভাবক সমাবেশ করা হবে। এ ছাড়া ১৪ নভেম্বর সব স্কুলের সামনে অভিভাবকদের সমাবেশ ও জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি না থাকলে প্রতিটি স্কুলের সামনে অভিভাবকরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। এরপর সরকার নতুন কারিকুলাম বাতিল না করলে আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
অভিভাবকদের মতে নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী নবম শ্রেণীতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভাগ বা বিষয় বেছে নেয়ার সুযোগ আর থাকছে না। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান মিলিয়ে একটি বিজ্ঞান বই এবং উচ্চতর গণিত ও গণিত মিলিয়ে একটি গণিত বই সবার পাঠের জন্য বানানো হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়েও কম বিজ্ঞান ও গণিত শিখবে এবং আমাদের আশঙ্কা তারা উচ্চশিক্ষায় গিয়ে ব্যর্থ হবে।
তারা আরো বলেন, এই কারিকুলামে সাময়িক পরীক্ষার মতো লিখিত পরীক্ষা নেই, রয়েছে প্রতিদিনের শেখার মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়নের নামে রয়েছে দলগত কাজ, প্রজেক্ট বা অ্যাসাইনমেন্ট। এগুলো কিভাবে করতে হবে তার কিছুই শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছেন না, শিক্ষকও বুঝতে পারছেন না। এক-এক সময়ে এক-এক রকম নির্দেশনা আসছে। অপর্যাপ্ত শিক্ষক আর ঘিঞ্জি ক্লাসের মধ্যে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস বা মূল্যায়ন কিছুই সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে অভিভাবকদেরও বাড়তি টাকা ও সময় ব্যয় হচ্ছে।
অভিভাবকরা বলেন, এখন ফলাফল নির্ধারণ হবে শুধু চিহ্ন পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত নির্দেশ করে। এগুলোতে শিক্ষার মানের কী উন্নতি হয় আমরা জানি না, বরং জটিলতা তৈরি করছে। এর ফলে অনেক স্কুলে অনৈতিক চর্চা ও দুর্নীতি বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা হতাশ হচ্ছে এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তারা অভিযোগ করেন এই কারিকুলাম ও পাঠ্যবইয়ে কী আছে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, কী হচ্ছে বা কী ঘটছে। এ কারিকুলামের ফলে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকরাও চরম নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন।
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমাদের মূল দাবি হলো শিক্ষানীতি বিরোধী নতুন কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে; নম্বর ভিত্তিক দু’টি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা (৬০ নম্বর) চালু রাখতে হবে এবং ফ্রান্স টেস্টগুলো ধারাবাহিক মূল্যায়ন (৪০ নম্বর) হিসাবে ধরতে হবে; নবম শ্রেণী থেকেই শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ অথবা বিজ্ঞান বিভাগ রাখতে হবে; ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করে নাম্বার ও গ্রেড-ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে; শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডে সব প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে হবে; শিক্ষার্থীদের দলগত ও প্রজেক্টের কাজে ডিভাইসমুখী হতে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে; প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে নিবন্ধন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালু রাখতে হবে এবং এসএসসি ও এইচএসসি দু’টি পাবলিক পরীক্ষা বহাল রাখতে হবে; সব সময়ে সব শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রী পরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের দাবি প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম সংস্কার বা বাতিলের দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের বেশির ভাগই কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তারা যে দাবিগুলো করছেন, তা একেবারেই যৌক্তিক নয় বলেও মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। মন্ত্রী আরো বলেন, আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ নোট-গাইড স্কুল পর্যায়ে গিয়ে বিক্রি করার সাথে জড়িত এবং দুঃখজনক হলেও সত্য এর সাথে কিছু কিছু শিক্ষকও জড়িত। তাই আন্দোলনকারীদের মূল উদ্দেশ্যই হলো তাদের কোচিং বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা।
মন্ত্রী বলেন, শিক্ষায় এত বড় একটি রূপান্তরের ক্ষেত্রে এক বছর খুব বেশি সময় নয়। এতে অভিভাবকরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হবেন, শিক্ষকরা ক্রমাগত প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। নতুন শিক্ষাক্রমের বইগুলো এখনো পরীক্ষামূলক সংস্করণ চলছে কারণ ক্রমাগত আমরা এর পরিমার্জন পরিচালন করছি; কিন্তু সিস্টেম পরিবর্তন হবে না।
মন্ত্রী আরো বলেন, ২০১৭-১৮ সালের অনেক গবেষণা ও সিদ্ধান্তের পর পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে এই শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। এই শিক্ষাক্রম প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১২/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.