এইমাত্র পাওয়া

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও এর দায় যাদের

মেজবাহ হোসেন: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চরম আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের দায় নিয়ে আলোচনা পেতে বসা কিছুটা বিলাসিতা বা বাহুল্যই বটে, তবুও আলোচনাটা করতেই হবেÑএটা আমাদের দায়। রাজনীতির বাইরে থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে শিক্ষার এই দৈন্যদশার কার্যকারণ খুঁজে দেখা যাক। শিক্ষা শুধু ২-৪টি কাগুজে সনদ অর্জনযোগ্য কোনো বিষয় নয়; বরং পঠিত বিষয় ভুলে যাওয়ার পরে যতটুকু জ্ঞান মনে ও মস্তিষ্কে গেঁথে থাকে এবং ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে সেটিই হলো শিক্ষা। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে যে কেউ রসগোল্লার সঙ্গে তুলনা করতেই পারেন; রসগোল্লা যেমন সারা রাত রসের হাঁড়িতে ভিজিয়ে রেখে সকালে তুলে নেয়ার পর গোল্লা যতটুকু রস নিজের কোষে কোষে ধারণ করে স্বকীয় চরিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটায় তেমনি বিদ্যার আলয় থেকে বিযুক্ত হওয়ার পর মানুষ যেটুকু জ্ঞান, দর্শন আর ভালো মন্দের বোধ শক্তি নিয়ে জাগতিক কারবারে অংশ নেয়; সেটিই হচ্ছে মূল বা অর্জিত শিক্ষা। রসগোল্লার স্বাদ ও মানের মতো শিক্ষার মানেও ভিন্নতা আছে। কোনো এক অজপাড়া গ্রামের একজন মিষ্টি কারিগর ও রসগোল্লা বানাতে পারে আবার বগুড়ার এশিয়া সুইটস ও রসগোল্লা বানায়, তাহলে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য হলো সুনির্দিষ্ট নিয়ম, পদ্ধতি আর অভিজ্ঞতায়; কেমন দুধ ব্যবহার করা হবে, কেমন আঁচে আর কতক্ষণ তা জ্বাল দেয়া হবে, কী দিয়ে দুধটা ভাঙা হবে, তারপর সিরা তৈরির জন্য চিনি-পানির সঠিক অনুপাত আর অবশেষে দক্ষ কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়া। এসব উপাদানের যেকোনো একটির ব্যত্যয় ঘটলে সেটি আর ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারবে না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি অনুরূপ বিষয় নয়? একজন আদর্শ নাগরিককে কী শেখানো প্রয়োজন, আমরা কী শেখাতে চাই, কীভাবে শেখাতে চাই, শিক্ষকদের কতটুকু উপযুক্ত করে গড়ে তুলব, শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষাঙ্গন প্রাঙ্গণ কেমন হবে, আর একজন শিক্ষার্থী কেমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করবেÑ এসব কিছুই চুলচেরা বিশ্লেষণ, গবেষণা আর যুক্তি তর্কের মাধ্যমে নির্ধারণ করার বিষয় হলেও বাংলাদেশে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। আমরা মনমর্জি শিক্ষক নিয়োগ দেই যেনতেন শিক্ষাগত যোগ্যতা আর বাছাই প্রক্রিয়ায়, শিক্ষার্থীরা যার ইচ্ছা সে বিদ্যালয়ে আসে যার ইচ্ছা সে আসে না। আপনি/ আমি যদি আনাড়ি হাতে রসগোল্লা বানাই সেটা দিয়ে মেহমান সার্ভ করা তো দূরের কথা নিজেরাই খেতে পারব কিনা সন্দেহ আছে; সেখানে শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থাকে আমরা কোনো হোম ওয়ার্ক ছাড়াই আনাড়ি হাতে ও অবহেলা ভরে চালিয়ে নিচ্ছি!

এই ব্যর্থতার সিংহভাগ দায় হচ্ছে রাষ্ট্রের তথা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা সরকারগুলোর। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সরকারগুলোর সবচেয়ে কম মনোযোগের ও গুরুত্বের তালিকায় এই শিক্ষার অবস্থান। একটি রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে সে কেমন নাগরিক চায়, তার নাগরিকদের কোন কোন গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য-আচরণ ও রুচিবোধ কেমন হবে। নৈতিকতা, শিষ্টাচার, বিনয়, শৃঙ্খলা ও দেশপ্রেম প্রভৃতি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শিশুকালেই শেখাতে হয় তাই উন্নত দেশগুলো প্রাথমিক শিক্ষা স্তরেই এই বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে থাকে; এর পাশাপাশি শিশুদের বেসিক গাণিতিক গণনা, মাতৃভাষার বর্ণমালা লিখতে ও পড়তে পাড়া শেখায়। ব্যস, এতটুকুই। তবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান বা বাণিজ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় তাদের সঙ্গত কারণেই প্রাথমিক পর্যায় থেকে ইংরেজিটাও ধীরে ধীরে শিখতে হয়।

এক সময়কার আগ্রাসী, সাম্রাজ্যবাদী ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক হামলায় পর্যুদস্ত জাপান কীভাবে বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম নম্র, ভদ্র, সভ্য ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে? জাপানের স্কুলগুলো হলো আজকের জাপান তৈরির কারিগর। জাপান তার স্কুলের কাছে জানিয়েছে সে কেমন নাগরিক চায়, স্কুলগুলোকে সাজিয়েছে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, উপযুক্ত যোগ্যতার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে, শিক্ষায় সম্ভবপর সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে যার দরুন আজকের জাপান জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, আদব কায়দায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশ্বের কাছে এক আশ্চর্যের নাম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। সেখানকার স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের যে মিডডে মিল দেয়া হয় তার উদ্দেশ্য শুধু খাওয় নয়; বরং এই মিড ডে মিল জাপানের শিশুদের জন্য একটি ট্রেনিং। এই মিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক, কেউ এর পরিবর্তে বাইরের খাবার খেতে পারবে না; সুতরাং এটা খাব না, ওটা নাহলে খাব না এসব বলার সুযোগ নেই। ডায়েটিশিয়ান তাদের খাবার মেন্যু ঠিক করে আর খাবার আগে শিশুদের জানানো হয় কেন তাদের জন্য এই মেন্যু নির্বাচন করা হয়েছে, একজন শিক্ষার্থীকে তার পুরো খাবার বাধ্যতামূলকভাবে শেষ করতে হয় আর এভাবেই তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিমান নিশ্চিত করা হয়। জাপানের স্কুলে কোনো পরিচ্ছনতা কর্মী থাকে না, কোমলমতি শিশুদেরই নিজের স্কুল সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে রাখতে হয় আর এই কাজে শিক্ষক ও অবিভাবকরা তাদের সহযোগিতা করে (অথচ বাংলাদেশে স্কুল পরিষ্কার করা নিয়ে এক বিচারক যে কুৎসিত আচরণ করেছেন!)। এভাবেই জাপান তার প্রজšে§র পর প্রজš§কে ইউনিফর্মড, নৈতিক, দায়িত্ববান, শারীরিকভাবে ফিট, সুশৃঙ্খল আর দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলে। তাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি এতই উন্নত যে ইউরোপ, কানাডা বা জার্মানি থেকে মানুষ পড়তে বা অভিবাসী হতে আমেরিকায় এলেও এখানে আজ পর্যন্ত কোনো জাপানিকে আমার চোখে পড়েনি। এটাই হলো দেশপ্রেম, যদিও ওরা দিনের মধ্যে ছত্রিশ বার চেতনা জপে না।

আমাদের দেশে সর্বশেষ যেই প্রজš§ এখন চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছে তাদের প্রায় সবার প্রাথমিক শিক্ষক ছিল ইন্টার পাস আর হাইস্কুল শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণিতে ডিগ্রি পাস। শিক্ষকতায় অর্জিত জ্ঞানের পাশাপাশি উন্নত দর্শন থাকাটাও সমানভাবে জরুরি। কারণ এই দর্শন একজন শিক্ষককে তার জ্ঞানের যথাযথ ও উত্তম প্রয়োগ ঘটাতে সাহায্য করে। তো এই ইন্টার পাস ও তৃতীয় শ্রেণিতে ডিগ্রি পাস একজন মানুষের জ্ঞান বা জীবন দর্শনের গভীরতা কতটুকু? তাদেরকে কি উপযুক্ত ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দায়িত্ববোধ বা দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয় শিখিয়ে একজন পারফেক্ট জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে এর রাষ্ট্র? যদি সেটা না হয় তবে তাদের কাছ থেকে কতটা উপযুক্ত শিক্ষা আসা করা যায়? (তবে আমরা তাদের কাছে চিরঋণী, কারণ তারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে আমাদের গড়ার চেষ্টা করে গেছেন, তর্কটা হলো রাষ্ট্রের ভ‚মিকা নিয়ে)। এই শিক্ষকদের মনের ও শরীরের পুষ্টি চাহিদা তো মেটানো হয়নি তাহলে তারা কীভাবে নতুন প্রজšে§র শরীর ও মনের চাহিদার কথা ভাবনায় আনতে সক্ষম হবেন?

বাস্তবতা হলো যে উপর্যুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতায় যারা একটি সরকারি দপ্তরের তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির চাকরি জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে তারাই এসেছে এই শিক্ষকতায় কারণ সরকারি দপ্তরের ওই চাকরিতে যে আর্থিক ও সামাজিক প্রাপ্তি তা এই শিক্ষকতার চেয়ে ঢেঁড় বেশি আর বেশি রেখে কেউ কমে কেন আসতে চাইবে। তাহলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল যে আমরা একজন পিয়ন বা কেরানির হাতে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে হুঁকা ফুঁকেছি/ফুঁকছি। যে শিক্ষকের ছাতার হাতল ভাঙা, পোশাকে আলগা হাতের সেলাই, জুতার পট্টির কারণে পায়ে ফোস্কা পড়েছে আর যেই শিক্ষার্থীর জামার বোতাম বা পায়ে স্যান্ডেল নাই এইরকম একটা সিস্টেম যে বিলুপ্ত না হয়ে টিকে আছে সেটাই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হওয়ার দাবি রাখে! কেউ যদি বলে বাংলাদেশের চেহারা যেমন তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারাও তেমন তাহলে তার অ্যালগরিদমে কিঞ্চিৎ ভুল হবে। কারণ গাড়ি ইঞ্জিনকে চালায় না, ইঞ্জিন গাড়িকে চালায়; তাই বিষয়টি দাঁড়াবে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চেহারা যেরকম, দেশের চেহারাও ঠিক সেরকম।

বাংলাদেশের যেকোনো সরকারি অফিস আদালতে সেবা নিতে গেলে দারোয়ান থেকে সর্বোচ্চ কর্তা পর্যন্ত সেবাগ্রহীতার সঙ্গে যে অসৌজন্যমূলক, অভদ্র ও অসম্মানজনক আচরণ করে তা কি কেবলই ঘুষ বা উৎকোচ পাওয়ার জন্য? না, একদমই না; ঘুষ বা উৎকোচ তো হাসি মুখে বা ভদ্রভাবেও চাওয়া সম্ভব। একজন সেবাগ্রহীতাকে সালাম আদাব বিনিময় করা, বসতে বলা, সমস্যার কথা জানতে চেয়ে তার সমাধানের পথ বাতলে দেয়ার মতো সভ্য আচরণ কোনো পুস্তক থেকে পাওয়া যায় না। এগুলো জীবনের দর্শন যা অর্জন করা যেত একজন সুশিক্ষিত, ভদ্র, নম্র, মার্জিত, চিন্তক ও বহু প্রতিভার অধিকারী শিক্ষকের হাত ধরে। যেহেতু সেইপথ আমরা তৈরি করতে পারিনি তাই কর্কশ, রুক্ষ ও অপমানজনক আচরণের মতো এক ক্ষত জেঁকে বসেছে প্রতিটি চেয়ারে কারণ সে পরিবার, বিদ্যালয় আর সমাজ থেকে এভাবেই পেয়ে অভ্যস্ত এবং অবচেতন মনে সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে নিজেও আবির্ভূত হয় প্রতি মুহূর্তে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা অর্জন তো দূরের কথা, যেই শিক্ষা নিজের ভাষায় নিজের মানুষের সঙ্গে একটু সুন্দর ও বিনয়ী আচরণ করতে শেখায় না সেই শিক্ষাকে ব্যর্থ বলা কি ভুল?

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে কি আমরা আদর্শ নাগরিক গড়ার কারখানা হিসেবে গড়ে তুলতে পারি না; যেখানে শিশুদের সুন্দর আচরণ শেখানো হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর ডাস্টবিন ব্যবহার শেখানো হবে, ট্রাফিক আইন মেনে চলার গুরুত্ব বোঝানো হবে, অন্যকে ইনসাফ বা সহযোগিতা করলে নিজেও ইনসাফ আর সহযোগিতা পাওয়া যাবে এই বিশ্বাস তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া কি অসম্ভব কাজ? সবাই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না, বড় সরকারি কর্তা হবে না; কিন্তু গ্রামের একজন ছেলে যখন এই শিক্ষাগুলো তার মধ্যে ধারণ করে কাজের সূত্রে শহরে বা রাজধানীতে যাবে তখন সে নিজের অজান্তেই একজন আদর্শ নাগরিকের মতো আচরণ করবে আর যেদিন এই চাওয়া বাস্তবে পরিণত হবে সেদিন আমাদের শহর বা রাজধানীর চেহারা কেমন হবে তা একটু কল্পনা করে দেখুন তো! টেলিভিশনে শুধু ‘মীনা’ কার্টুন দেখিয়েই যদি পুরো দেশের মানুষকে ওয়াশরুম ব্যবহারের পরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ানো শেখানো যায়; তাহলে তাদের সব ভালো আচার-অভ্যাসও শেখানো সম্ভর, প্রয়োজন শুধু রাষ্ট্রের উদ্যোগ আর সঠিক পরিকল্পনার।

শিক্ষায় বিনিয়োগ যেকোনো রাষ্ট্রের জন্যই নিঃসন্দেহে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর এর বাস্তব উদাহরণ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা ও অবস্থান অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো (যদিও সেটি সন্তোষজনক নয়) ফলে দেশের সব থেকে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়েছে (যেটুকু ব্যতিক্রম তার জন্য রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দায়ী)। মেধাবীদের নিয়োগ দেয়ার ফলে সেখানে সেই মানের শিক্ষা দেয়া সম্ভব হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। সে কারণে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বহু শিক্ষার্থী উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা বা চাকরিতে নিয়োজিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মান দেয়ার দরুন আমরা একজন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, একজন স্যার এএফ রহমান ও একজন সত্যেন বোস পেয়েছি। আমরা যদি প্রাথমিক থেকে অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদেরও সম্মান আর সম্মানি দিতে পারি তাহলে সেখানেও মেধাবীদের পাওয়া যাবে, সেখানেও নক্ষত্রের জš§ হবে।

এবার আসি বাকি কিয়দংশ দায় যাদের বলে আমি মনে করি তাদের কথায়। সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষক তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তারের মতো জায়গায় অবস্থান করেন তাদের। রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসার একটি মিল আছে, ব্যবসায় যেমন লভ্যাংশ অর্জনই শেষ কথা তেমনি রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থেকে যাওয়াই শেষ কথা; তা কায়দা যেটাই হোক। এই কারণে আমলা, পুলিশ, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী সমাজ সবাই রাজনৈতিক দলগুলোর একটি নির্দিষ্ট পরিসরে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেও আমাদের অধ্যাপক সমাজ রাজনীতি আর ক্ষমতার বলয় থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। শিক্ষকরা যেমন নিজেদের সেই আদিকালের মাস্টার চরিত্রে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তেমনি নিজেদের কমফোর্ট জোন ছেড়ে ন্যূনতম ঝুঁকি নিতেও নারাজ। ফলে অপরাপর পেশাজীবী গোষ্ঠীর মতো সরকারগুলোর ওপর শিক্ষক সমাজের কোনো প্রতিনিধিত্ব বা আধিপত্য থাকে না; যেহেতু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার মানে হলো নিজের থেকে কম যোগ্যদের দ্বারা শাসিত হওয়া তাই শিক্ষা ও শিক্ষক অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। (এক্ষেত্রে অবশ্যই ভিসি পদে যাওয়ার জন্য ব্যক্তি বিশেষের পদলেহী আচরণ বা কর্মকাণণ্ডকে আমি শিক্ষক সমাজের রাজনীতি বলে মনে করি না)। ফলে বাংলাদেশের মতো একটি নি¤œ উপার্জনের দেশে পুলিশ ও প্রশাসন ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডায় সেকেন্ড হোম করতে পারলেও রাষ্ট্র পরিচালনা, বাজেট প্রণয়ন বা শিক্ষায় বরাদ্দ নির্ধারণের মতো বিষয়ে শিক্ষকদের চাওয়া বা মতামতের কোনো স্পেস নেই। এমনকি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, শিক্ষাস্তরের যেকোনো পর্যায়ের সিলেবাস প্রণয়ন, পরিমার্জন ও বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের মতো ক্ষেত্রগুলো যেখানে শিক্ষকদের কথায় শেষকথা হওয়ার কথা সেখানেও শিক্ষকদের নামমাত্র উপস্থিতি; মূল ভ‚মিকা পালন করে অন্যরা।

আমাদের শেখানো হয় ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তের ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন’, কিন্তু আফসোস ২-১টি ক্ষেত্র ছাড়া আমরা আমাদের অর্জিত বিদ্যাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারিনি। পৃথিবী যেখানে গণিত আর পদার্থবিদ্যার সমন্বয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটার আবিষ্কার করার পথে, সেখানে আমরা সুদের হিসাব কষা ছাড়া বাস্তব জীবনে গণিতের আর কোনো প্রয়োগ জানি না। অর্থনীতির মানুষ জানে না ইকোনমিকস আর ইকোসিস্টেমের মধ্যে সম্পর্ক কী, ওদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিত রাজ তোষণকেই তার জীবিকা নির্বাহের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। অনুরূপভাবে, আজকের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক শিক্ষার্থীরা যদি আগামীকাল তার নির্ধারিত ফিস না পেয়ে একজন মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দেয়া থেকে বিরত থাকে তবে তখন কি তাকে কসাই আখ্যা দেবেন নাকি তার এই কসাই হয়ে ওঠার পেছনে ২০ হাজার টাকায় সংসার চালানোর নিদারুণ বাস্তবতা, পুলিশের লাঠির বারি ও জলকামান দিয়ে নিগ্রহের যোগসূত্র খুঁজে দেখবেন? রাজধর্ম পালনকারী একজন জুনিয়র কর্মকর্তা পায় কোটি টাকার গাড়ি আর বহুগুণ মেধাবী একজন চিকিৎসক, যার হাতের ওছিলায় মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের জরা-ব্যাধি থেকে মুক্ত করবেন, সুস্বাস্থ্য নিয়ে পৃথিবী উপভোগের সুযোগ করে দেবেন বা নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে নতুন জীবন দান করবেন তার জীবন বা জীবিকার অর্থ মূল্য মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকাৃ এভাবেই গড়ে ওঠে একটি বে-ইনসাফ ও বে-রহম সমাজ।

শিক্ষক, রসায়ন বিভাগ, হাবিপ্রবি

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/১১/২০২৩  

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.