এইমাত্র পাওয়া
ফাইল ছবি

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে একটি আন-পপুলার মতামত!

মোহাম্মদ আব্দুল বাতেনঃ  দেশে নতুন কারিকুলাম নিয়ে নানা বিতর্ক হচ্ছে। বিশেষ করে নাম্বার বন্টন, বিজ্ঞান শিক্ষা, একমুখী শিক্ষা। অনেকগুলো যৌক্তিক বিতর্ক, তবে বেশির ভাগই ‘আমাদের সময়ই ভালো ছিলো’ এই মানসিকতাকে শ্রেষ্ঠ ধরে বিতর্ক। এটা মানুষের স্বভাবজাত ধারণা। নিজের অভিজ্ঞতাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত ও ক্যায়োটিক হিসাবে উপস্থাপন। মানুষ নতুনকে রেসিস্ট করে, এটা হিউম্যান নেচার। তাই ‘আগে ভালো ছিলো’ এখন এসব কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে কী হবে এ ধরনের আলপটকা আলাপে আমার আগ্রহ নেই। যদিও অভিভাবকদের কনসার্নকেও মাথায় রাখতে হবে। বাস্তব ও জীবনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বানাতে গিয়ে অভিভাবকদের ওপর বাড়তি খরচের বোঝা আবার ধনী-গরিবের বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে কিনা সেই বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সৃজনশীল ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি, ধনীর বাচ্চারা কীভাবে এডভান্টেজ পেয়েছে। একই অবস্থা যদি আরও প্রকট হয় তাহলে দেশে অরাজকতা আরও বাড়বে।

বিজ্ঞান শিক্ষার পরিমাণ কতো হওয়া উচিতÑ এটা নিয়ে বিতর্ককে স্বাগত জানাই। কিন্তু ভৌত বিষয়কেই শুধু বিজ্ঞান বলে ভাবাটাও ভুল, সেটা মাথায় রাখতে হবে। বিজ্ঞান একটা প্রক্রিয়া। সত্য খোঁজার প্রক্রিয়া। সেটা যেকোনো বিষয়েই বৈজ্ঞানিক হতে পারে। শুধু পদার্থ রসায়ন জীব মানেই বিজ্ঞান এটাই ভ্রান্ত ধারণা। এগুলো বিজ্ঞানের নানা প্রায়োগিক ক্ষেত্র। সমাজেও বৈজ্ঞানিক চিন্তার এপ্লিকেশন আছে। তাই সমাজিক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান। বিজ্ঞান মানে একধরনের চিন্তা কাঠামো। পরমাণু সংখ্যা আর মাইটোকোন্ড্রিয়ার গঠন মুখস্থ করা বিজ্ঞান না। তাই পুরো কারিকুলাম না দেখে আসলে আমার কোনো অবস্থান নেইÑ কত নাম্বারের বিজ্ঞান শিক্ষা থাকা উচিত এবং সেটা কোন ফর্মেটে থাকবে। মানে ভৌত বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান বিষয়ে থাকবে নাকি বিজ্ঞান শিক্ষা সব বিষয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে মানে পদ্ধতিটাই বৈজ্ঞানিক হবেÑ কুসংস্কার নয় বরং সত্য ও প্রমাণিত সত্য খোঁজার প্রক্রিয়াই শেখানো হবে কারিকুলামে।

আমার আনপপুলার ভাবনাটা আসলে ধর্ম শিক্ষা নিয়ে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তো ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা নয়। এটা স্পিরিচুয়াল জার্নি শেখানোর ব্যবস্থাও নয়। এটা মানবসম্পদ ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখার জন্য শিক্ষা। তাহলে বিজ্ঞান শিক্ষা থাকবে কী থাকবে না এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু স্কুলে ১০০ নাম্বারের যে ধর্ম শিক্ষা পড়ানো হয় প্রতি ক্লাসে সেটার প্রয়োজন নিয়ে আলাপ হচ্ছে না কেন? ধর্ম একটা সোশ্যাল ইন্সটিটিউশন। এর মূল অর্থই হচ্ছে নৈতিকতা ও সহিষ্ণুতা এবং ইনক্লুসিভ সোসাইটি গড়া। যদি এটাকে ধর্মশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ধরে নিই তাহলে এই যে আলাদাভাবে ইসলাম শিক্ষা, হিন্দু ধর্ম শিক্ষা, বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা স্কুলে পড়ানো হয় এটার মানে কী? ধর্ম তো জীবন যাপন ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। এটা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব না নাগরিকের ধর্মীয় বিশ্বাস শেইপ করার দায়িত্ব নেবে। এটা পরিবার ও তার নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাপার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার। সেই ক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষা একটা উপায় হতে পারে। কিন্তু সেটা তো আন্তঃধর্মীয় হতে হবে। মানে এখন যে আমরা যারা ইসলামী শিক্ষা পড়ি তারা হিন্দু ধর্মের শিক্ষা জানি না। যারা হিন্দু ধর্ম পড়ি তারা ইসলামী শিক্ষা জানি না। তাই এক ধর্মের নৈতিক শিক্ষাকে আরেক ধর্মের নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই পরস্পর শ্রদ্ধাবোধ ও সহবস্থানের শিক্ষা দেওয়াই তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বিদ্যালয়ের সঙ্গে মাদ্রাসা কিংবা টোল শিক্ষার পার্থক্য তো এখানেই হবে। আমাদের বিদ্যালয়ে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা নামে যে বই থাকবে সেখানে প্রধান প্রধান ধর্ম পুরুষদের জীবনী ও কর্মের বিশ্লেষণ থাকবে। আলাদা করে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ নয়। একটা বইতে সকল ধর্মের ভালো ও নৈতিক শিক্ষা থাকবে। সবাই সবার ধর্ম সম্পর্কে জানবে। শিক্ষার উদ্দেশ্য সমন্বয় ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা তৈরি করা, বিভাজন ও ঘৃণা তৈরি করা নয়। আমাদের সময় স্কুলে আমি কোনোদিন জানিনি আমার সহপাঠী হিন্দু ছেলেটার ধর্ম সম্পর্কে, তার নৈতিকতা বোধ সম্পর্কে। ঠিক তেমনি সেও জানেনি। এতে আমাদের নিজেদের যে বিশ্বাস সেটাকে মেন্যুপুলেট করা খুব সোজা। ঘৃণা প্রপাগেট করা খুব সোজা। বিদ্যালয় শেখাবে আন্তঃধর্মীয় নৈতিকতা, একটা নির্দিষ্ট ধর্মের শিক্ষা দেয়ার জন্য আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, পরিবার আছে, বিদ্যালয়ের কাজ সেটা নয়।

কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদ কিংবা কারিকুলাম স্পেশালিস্টরা কথা বলেন না। ভাবে এটা স্পর্শকাতর। এটা স্পর্শকাতর কেন হবে? এসব আলোচনা না করলে কি স্পর্শকাতরতা কমে যাবে? সমাজ দিনদিন সহিষ্ণু হবে? আমাদের প্রয়োজন আন্তঃধর্মীয় নৈতিক জ্ঞান। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মেই যে নৈতিক ও মানবিক জ্ঞান আছে সেটাকে ধারণ করার শিক্ষাই দিবে বিদ্যালয়। তাহলে সমাজে যারা নিজের ধর্মীয় ও কিংবা অন্য কোনো মতবাদ দিয়ে ঘৃণা ছড়াতে আসবে সেটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার আন্তঃধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে মোকাবেলা করতে পারবে। পুরো দুনিয়া উল্টাই ফালাচ্ছি। কিন্তু আমার প্রতিবেশীর ধর্ম সম্পর্কেই জানি না। এই না জানাই সব ঘৃণার উৎস। আমাদের না জানানোই আসলে আমাদের ঘৃণাকে লালন করতে থাকার কারণ, আর সেটাকে পুঁজি করে চলে ধর্মব্যবসা, রাজনীতি সব।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান, ইউনিভার্সিটি অব মেইন, যুক্তরাষ্ট্র

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/১১/২০২৩ 

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.