মারিয়া হক শৈলী: বলা হয়ে থাকে একটি জাতিকে সভ্য জাতিতে রূপান্তরিত করতে হলে শিক্ষাই হতে পারে একমাত্র হাতিয়ার। আর সেই হাতিয়ার যারা সযতেœ হাতে তুলে দেন এবং সৎ পথে প্রয়োগ করতে শেখান তারা হলেন শিক্ষক। শিক্ষা যদি বৃক্ষ হয়ে থাকে, শিক্ষক হচ্ছেন জল। যে জলের সে াতধারা অনন্তকাল ধরে প্রবহমান, ঠিক সভ্যতার বয়সের মতো।
শিক্ষক হলেন মানব সন্তানের দ্বিতীয় জন্মদাতা। একটি ছোট্ট ভ্রুণ যখন মায়ের গর্ভে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পরিণত বয়সে পৃথিবীতে আসে, তখন সে থাকে অক্ষর জ্ঞানহীন। হ্যাঁ, দৈবিক ক্ষমতা বলে হয়তো এমন অনেকেই আছেন যারা মায়ের গর্ভ থেকেই পরিপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন; তবে এমন দুর্লভ ঘটনা না ঘটলে, প্রকৃতির নিয়মে মানুষ পৃথিবীতে জ্ঞানহীন ভাবেই জš§ গ্রহণ করে। আর সেই জ্ঞানহীনকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিপূর্ণ মানুষ ও মনুষ্যত্বের আলোয় দিক্ষীত করে দ্বিতীয়বার জš§ দিয়ে থাকেন শিক্ষাগুরুরাই। জৈবিকভাবে মা-বাবা জš§দাতার তালিকা ও পারিবারিক শিক্ষাদানে প্রথম হলেও, শিক্ষার্থীর চিন্তা ও মননে শিক্ষকের জায়গা সবসময়ই প্রথম। প্রাচীন ভারতে যখন বই পুস্তকের উদ্ভব ঘটেনি, তখন প্রাথমিক শিক্ষার একটি স্তর ছিল শিক্ষা গুরুর গৃহে জ্ঞানচর্চা। রাজা, জমিদারদের ছেলেরা তখন গুরুর গৃহে জ্ঞানচর্চা করতেন, সম্মান করতেন প্রচণ্ড। শিক্ষকের প্রতি এ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক অবিস্মরণীয় প্রতিফল ঘটতে দেখা যায় কবি কাদের নেওয়াজের লেখা শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতায়। ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) শিক্ষকের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমার শিক্ষক ইমাম মোহাম্মাদ (রহ.) যত দিন বেঁচেছিলেন, তত দিন আমি তার বাড়ির দিকে পা মেলে বসিনি। আমার মনে হতো, এতে যদি শিক্ষকের প্রতি আমার অসম্মান হয়ে যায়।’ তাছাড়া জাপানি এক প্রবাদেও বলা হয়েছে, ‘এক হাজার দিনের পরিশ্রমী অধ্যয়নের চেয়ে, একদিন একজন শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করা অধিক ভালো।’ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শিক্ষক প্রসঙ্গে বলেন, ‘যদি তুমি জীবনে সাফল্য অর্জন করে থাক, তাহলে মনে রেখ তোমার পাশে একজন শিক্ষক ছিল যে তোমাকে সাহায্য করেছিল।’
সভ্য মানুষ তৈরির এসকল কারিগরদের মর্যাদা যে কেবল সাহিত্য কিংবা কবিতায় সীমাবদ্ধ, বিষয়টা ঠিক তেমনও নয়। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা এবং জীবনের নিরাপত্তা প্রাচীনকাল পেরিয়ে এখন অনেকটাই শক্ত অবস্থানে। বিশ্বের অনেক দেশেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মর্যাদা আইন ও লিখিত সনদের দ্বারা সংরক্ষিত। যেমনÑ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্মেলনে শিক্ষকদের মর্যাদা বিষয়ে একটি সনদ গৃহীত হয়, যা ইতিহাসে একটি অন্যতম বিরল ঘটনা।
তাছাড়া, ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক এবং সোশ্যাল রিসার্চ প্রায়ই শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত সূচক তৈরি করতে। তাদের তৈরিকৃত এমন একটি সূচকের উঠে এসেছে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের ভালো থাকা এবং খারাপ থাকা সংক্রান্ত নানা তথ্য। তাদেরই এক গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বে যেসকল দেশে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা পেয়ে থাকেন, সে দেশগুলো হলো চীন, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ান। চীনের তালিকা সবচেয়ে ওপরে কারণ সে দেশের প্রায় ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে’; যা আন্তর্জাতিক গড়ে প্রায় ৩৫ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়াতেও শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এসকল দেশের ছেলেমেয়েরা থাকে সবচেয়ে এগিয়ে। এর অন্যতম কারণ শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা। মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে বলেই এ পেশাতে মেধাবীরাও নিযুক্ত হন এবং তাদের ধরে রাখা যায়। এ গবেষণায় আরও দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের ভারত, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষকতা পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে উৎসাহ দিচ্ছেন।
এই যখন বিশ্ব পরিস্থিতি তখন বাংলাদেশের দিকে তাকালে অনেকেই মনে করেন শিক্ষকের মর্যাদা এবং এ পেশার গুরুত্ব অনেকটা ঐতিহাসিক দুর্লভ বস্তুর মতো, যা জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয় এবং স্মরণ করে গর্ব করা হয়। সমাজবিজ্ঞানী এবং নীতিনির্ধারকরা যেখানে অবিরত বলে চলেছেন যে, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের একটি দেশের জন্য সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষায় বিনিয়োগ, সেখানে এদেশের শিক্ষকরা আজও অনেকটাই উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। যার কারণে এদেশের অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী শিক্ষকদের দ্বারা নিজেদের শিক্ষিত করেও নিজেরা কখনোই শিক্ষতায় আসতে চাইছেন না। এমনকি বহুল কাক্সিক্ষত চাকরি বিসিএসের ক্যাডারগুলোর মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারকে কোনো পরীক্ষার্থী প্রথম তালিকায় রেখেছেন, এমন প্রার্থীও বর্তমানে খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। বিসিএসএ নিয়োগ প্রাপ্ত অন্যান্য ক্যাডারদের সঙ্গে শিক্ষা ক্যাডারদের তুলনা করলে দেখা যাবে, সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে শিক্ষা ক্যাডাররা অনেকটা পিছিয়ে। প্রাথমিক শিক্ষকরা এদেশে অনেকটা ?তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর মতো জীবনযাপন করেন, আর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন তাদের সর্বোচ্চ পদমর্যাদা যুগ্ম সচিবের সমান।
১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন আমলে এবং ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে এদেশের শিক্ষকদের ভাগ্যে তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষকদের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা ভাতা চালু করে। সেই থেকে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা শুরু। স্বাধীনতা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমান সরকার একসঙ্গে ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক লাখ ৬২ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন। তারপর সরকারীকরণ, জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তির কার্যক্রম। বিশাল পথ অতিক্রম করে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন হলেও শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের প্রশ্নসহ শিক্ষাব্যবস্থা আজও বহুবিধ সমস্যা ভারাক্রান্ত। তাছাড়া বর্তমানে দেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দু’ভাবেই শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো অপ্রতাশিত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পত্রপত্রিকা খুললে কিংবা টিভি অন করলেই প্রায়ই এসব ঘটনা সামনে আসে।
উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি ঘটনা আবারও স্মরণ করা যাক। লক্ষ্মীপুরে ১৬ জুলাই ২০১৯ মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন প্রকাশ পিচ্চি কামালের হাতে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন লাঞ্ছিত হন, ৮ আগস্ট ২০১৯ নওগাঁয় বিদ্যালয় সভাপতি কর্তৃক প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত হন, ২০২১-এর ৯ অক্টোবর গোপালগঞ্জে উন্নয়নের টাকায় ভাগ না দেয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোজ কান্তি বিশ্বাসকে মারধর করেন উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির লোকজন, শিক্ষার্থীকে চড় মারায় ১০ অক্টোবর ২০২১ রাজধানীর রমনার খ্যাতনামা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাসির উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তাছাড়া ধর্মের নানান অপব্যাখ্যা প্রদান করে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের অপদস্তের ঘটনাও উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করাই যাই। এমন আরও নানা ঘটনা অবিরতই ঘটে চলেছে এবং দৃষ্টান্তামূলক শাস্তি না হওয়ায় সম্প্রতি আরও একটি ঘটনার সাক্ষী হলো দেশ। যে ঘটনাটি ঘটেছে চুয়াডাঙ্গায়; যা সত্যিই অতন্ত ন্যক্কারজনক।
সময় পাল্টেছে। পরিবর্তন ঘটেছে সমাজব্যবস্থায়, মানুষের চিন্তাধারায়। কিন্তু এতটা পরিবর্তন, এতটা আধুনিকতার আসলেই কোনো ভিত্তি আছে কি যে পরিবর্তন বা আধুনিকতা শিক্ষকের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে? যে শিক্ষক হাতে হাত ধরে জীবন গঠনের সহযোগী হচ্ছেন, যে শিক্ষক একটা সময় ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে ঘাতকের বুলেটের সামনে নিজের অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎকে সঁপে দিয়েছেন নির্দ্বিধায়; ভরসার বদলে, সম্মানের বদলে চড়-থাপ্পড়ই কি তার প্রাপ্য?
শিক্ষককে অপদস্ত করা বন্ধ করতে হবে, নৈতিকতার নামে ম্যানেজিং কমিটি এবং রাষ্ট্র কর্তৃক হয়রানি বন্ধ করতে হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে সংস্কার আনতে হবে, পারিবারিক সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, মনে রাখতে হবে মা-বাবার পরেই শিক্ষক; যার কাছে গেলে আপনি কখনও শূন্য হয়ে ফেরত আসবেন না।
লেখকঃ শিক্ষার্থী,রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১১/১০/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়
Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম
Subscribe to get the latest posts sent to your email.