এইমাত্র পাওয়া
অধ্যক্ষ মো. মইনুল ইসলাম পারভেজ। ছবিঃ সংগৃহীত

অনিয়মের হোতা অধ্যক্ষ মইনুলকে অধিদপ্তর শোকজ করলেও বন্ধ হয়নি এমপিও

আল আমিন হোসেন মৃধা, ঢাকাঃ কাবিননামা তৈরিতে জালিয়াতি, বাল্যবিবাহ, দেনমোহরের টাকা কমবেশি করা, বর ও কনে পক্ষকে নানা কায়দায় প্ররোচিত করে বিবাহ দেওয়া এবং বিবাহ বিচ্ছেদকরণ, নারীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার হলিয়াপাড়া জামেয়া কাসেমিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. মইনুল ইসলাম পারভেজের এমপিও স্থগিত/স্থায়ীভাবে কেন বন্ধ হবে না মর্মে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর শোকজ করার তিন মাস পার হলেও আজ পর্যন্ত তার এমপিও বন্ধ হয়নি। শুধুমাত্র শোকজ করেই আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর।

শুধু তাই নয় গত সেপ্টেম্বর মাসে টানা ১৬ দিন জেলহাজতে থাকলেও পুরো মাসের এমপিওর অংশ তার ব্যাংক হিসাবে যোগ হয়েছে। তিনি তা উত্তোলনও করেছেন।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অধ্যক্ষ মো. মইনুল ইসলাম পারভেজের বিরুদ্ধে কাবিননামা তৈরিতে জালিয়াতি, বাল্যবিবাহ, দেনমোহরের টাকা কমবেশি করা, বর ও কনে পক্ষকে নানা কায়দায় প্ররোচিত করে বিবাহ দেওয়া এবং বিবাহ বিচ্ছেদকরণ, নারীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। যা চাকরিবিধি পরিপন্থী এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এসব অভিযোগে গত ২৫ জুন মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অর্থ) মোঃ লুৎফুর রহমান স্বাক্ষরিত নোটিশে অধ্যক্ষ মো. মইনুল ইসলাম পারভেজের এমপিও স্থগিত/স্থায়ীভাবে কেন বন্ধ হবে না মর্মে শোকজ করা হয় এবং সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। তবে এই শোকজ নোটিশের তিন মাস পার হলেও আজ পর্যন্ত তার এমপিও বন্ধ হয়নি।

জানা গেছে, মাওলানা মঈনুল ইসলাম পারভেজের বিরুদ্ধে জগন্নাথপুর পৌর এলাকার কেশবপুর গ্রামের শাহনাজ পারভিন লিসা নামের এক মহিলার কাবিননামায় তার নাম মুছে মোসাম্মৎ সাজেদা বেগম নামের অন্য মহিলার নাম বসিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশ গমণে সহায়তার অভিযোগে শাহনাজ পারভীন লিসা বাদী হয়ে আদালতে (জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জে, সিআর মামলা নং-৩৮/২০২৩) দায়ের করেন। এ মামলাটি বর্তমানে পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন সিলেটে তদন্তাধীন আছে।

এছাড়াও  হলিয়ারপাড়া মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন, মাদ্রাসার উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সুবিধার্থে এগিয়ে আসা উপজেলার মিরপুর নিবাসী জোহির উল্লাহর ছেলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী নুর মিয়া ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪০ লাখ টাকা ব্যক্তিগত অনুদান দেন। কিন্তু অধ্যক্ষ মঈনুল ইসলাম পারভেজ অন্যান্যদের সহযোগিতায় সেই টাকার পুরো অংশই আত্মসাৎ করেন।বিষয়টি টের পেয়ে জুডিশিয়াল আদালত সুনামগঞ্জে ৪০৬/৪২০/৪৬৭/৪৬৪/৪৭১ ও ৩৪ ধারায়  ৪০ লক্ষ টাকা আত্মসাতের  সি/ আর মামলা -১৫ দায়ের করেন নুর মিয়া। সেই মামলায়  ১৬ দিন কারাভোগ করে অধ্যক্ষ জুডিশিয়াল আদালত সুনামগঞ্জে ৪০৬/৪২০/৪৬৭/৪৬৪/৪৭১ ও ৩৪ ধারায়  ৪০ লক্ষ টাকা আত্মসাতের  সি/ আর মামলা -১৫ দায়ের করেন নুর মিয়া। যা জগন্নাথপুর থানা কর্তৃক তদন্তে প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। আর এই মামলায় গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে অধ্যক্ষ ১৬ দিনের কারাবরণ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,  হুলিয়ারপুর জামেয়া কাসেমিয়া আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে (ইনডেক্স নং— ৩২০৮৫৮)  কর্মরত থেকে বেতন-ভাতার সরকারি অংশ (এমপিও) গ্রহণ করছেন মো. মইনুল ইসলাম পারভেজ এবং আইন ও নীতিমালা বহির্ভূতভাবে অবৈধ পন্থায় ২০০৪ সাল থেকে জগন্নাথপুর পৌরসভার ৩, ৪ ও ৬ নং ওয়ার্ডের মুসলিম বিবাহ তালাক নিবন্ধক ও নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী হিসেবে কর্মরত থেকে সরকারী সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন তিনি।

শিক্ষাবার্তা’র অনুসন্ধান ও আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ এই মাদ্রাসায় আরবী প্রভাষক হিসাবে যোগদানের পর সম্পূর্ণ বে-আইনী ভাবে জগন্নাথপুর পৌরসভার ৩, ৪ এবং ৬নং ওয়ার্ডের কাজী হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। কাজীপদে অবৈধ ভাবে, তথ্য গোপন করে নিয়োগ লাভের পর এক অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত হয়। লাভজনক কাজীর পদটি টিকিয়ে রাখার জন্য মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ মাদ্রাসার প্রভাষক পদ থেকে ২০০৪ সালের ৯ মে তারিখে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০০৪ সালের ২৮ মে তারিখে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয় থেকে মোঃ মঈনুল ইসলামকে জানানো হয়, যেহেতু তিনি জামেয়া কে.এস, মাদ্রাসার প্রভাষক পদ থেকে পদত্যাগ করিয়াছেন সেহেতু তাকে কাজীর পদে থাকিতে কোন অসুবিধা নাই।  মাদ্রাসায় তিনি মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ এবং কাজী পদে তিনি মোঃ মঈনুল ইসলাম নাম ব্যবহার করছেন। একই ব্যক্তির দুই নাম দুই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

শিক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮ এর ১১.১০ (ক) কোনো ব্যক্তি বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ প্রাপ্তির জন্য আবেদনকারী শিক্ষক-কর্মচারীগণ একই সাথে একাধিক পদে চাকুরিতে বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেন না।

দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ধারা ২ ও পেনাল কোড এর ধারা ২১ এর উপধারা ১২(ক) অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্তব্য সম্পাদনের জন্য সরকারের চাকুরিতে বেতনভোগী হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন ফি অথবা কমিশন আকারে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন’ সেও সরকারি কর্মচারী রূপে গণ্য হবেন।

সে হিসেবে একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক সরকারি কর্মচারী, একই বিধান মোতাবেক কমিশন আকারে পারিশ্রমিক গ্রহণ করায় নিকাহ রেজিস্ট্রার পদও সরকারি কর্মচারী হিসাবে গণ্য। দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী সরকারের দুই পদে দায়িত্ব পালন করার অপরাধ অর্থ আত্মসাতের সামিল।

এর আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারি দলের সদস্য আলী আজমের প্রশ্নের জবাবে বলেন, সরকারি লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রাররা একইসঙ্গে সরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রার তার নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে কোনো সরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে বা অন্য কোনো পদে চাকরি করলে তার লাইসেন্স বাতিলসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অথচ বর্তমানে মো. মইনুল ইসলাম পারভেজের দেদারচ্ছে দুটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছে।

এছাড়াও চতুর এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে,  মোঃ মঈনুল ইসলাম পারভেজ একই সনে ফাজিল এবং বি.এ. অনার্স ডিগ্রি পাস করেন (সমমনা একই ডিগ্রি এক সাথে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি প্রভাষক পদে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ছাড়াই দূর্নীতির মাধ্যমে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভ করেন।নিয়মিত প্রতিষ্ঠানে আসেন না এবং থাকেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিদর্শক (ঢাকা ও সিলেট বিভাগ) মুহাম্মদ সাজিদুল হক শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি আগে ছিলাম শুধু ঢাকা বিভাগে নতুন সিলেট বিভাগে দায়িত্ব পেয়েছি। তবে আগে যিনি সিলেট বিভাগে দায়িত্বে ছিলেন তিনি ভালো বলতে পারতেন। চিঠি যখন ইস্যু হয়েছে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি খোঁজ নিয়ে বিষয়টি দেখব।

মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ জাকির হোসাইন শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, মাদরাসা অধিদপ্তর থেকে প্রতিনিয়ত অনিয়মের বিরুদ্ধে সুপার-অধ্যক্ষকে শোকজ করা হয়েছে বা হচ্ছে। ঐ প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের বিষয়টি সর্বশেষ কি অবস্থায় আছে তা দেখতে হবে। আমি দেখে বিষয়টি জানাতে পারব। শোকজ করা হয়েছে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।

মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (অর্থ) মোঃ লুৎফুর রহমান শিক্ষাবার্তা’কে বলেন, আমি যতদুর জানি তিনি গ্রেপ্তার থাকা সময়টাতে বেতন ভাতা তোলেননি। অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাকে শোকজ করে সতর্ক করেছি। তবে তিনি যদি আবার গ্রেফতার হন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৮/১০/২০২৩    

দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.