এইমাত্র পাওয়া

‘কোথা সে মুসলমান….’

অধ্যাপক মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ।।

‘ঈমান ও ইসলামে’র প্রকৃত স্বরূপ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিবেদন
“যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া
জ্বীন পরী ইনসান…….
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ্ ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।
আজাদ করিতে এসে ছিল যারা
সাথে ল’য়ে কোরআন।।

অন্যদিকে ঈমান ও ইসলামের ব্যাপারে অন্তহীন কথকতায় ‘ঈমান ও ইসলামে’র প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে বিভ্রান্তি ও রহস্য, সরলপথ বেছে পেতে সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্থ করে তোলে। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থে ধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অন্যরকম বিপদের জন্ম দেয় এবং তখন একজন ঈমানদারের বিশ্বাসে বিচ্যুতি ঘটাও অসম্ভব নয়। অথচ ‘ঈমান ও ইসলাম’ কতোই না মূল্যবান সম্পদ।
নৈতিকগুণাবলী, যোগ্যতা, মানবীয় তৎপরতা, সহযোগিতা, কর্ম-কীর্তি এবং ইবাদতমূলক চেতনার মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। এছাড়া শুধুমাত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণা, বংশবৃদ্ধি আর টিকে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত, সংগ্রামী তৎপরতা পাষবিক ! এর মধ্যে কোন মানবিক দিক নেই। এজন্যই মহান আল্লাহ্ বলেনÑ উলাইকা কাল আনআম বাল্হুম আদ্বাল অর্থাৎ “ওরা তো পশু বরং তারচেয়েও অধম”। শুধু তাই নয় ঈমানের পরিপন্থি ও ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শনকারী ব্যক্তি হলো ‘মুনাফিক’। ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী ‘মুনাফিকি’ জঘন্যতম পাপ। ‘মুনাফিক’রা কপটবিশ্বাসী, ভÐ, দ্বিচারী, দ্বিমুখী আচরণকারী, বর্ণচোরা ইত্যাদি। মুনাফিকরা বাহ্যতঃ ঈমানের দাবিদার অথচ এরাই বন্ধু বেশে ইসলাম ও মুসলমানের চরম ক্ষতি সাধন করে।

ঈমান-আমলের ফয়সালা হবে আখিরাতে এবং তার কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ্রই হাতে। আর আমাদের কাজ হলো ঈমান-আমলের পথে শুধু এগিয়ে যাওয়া। কেননা, আল্লাহ্ই তো বলে দিয়েছেন “মু’মিন তো তারাই যারা আল্লাহ্ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল এবং তা থেকে বিচ্যুৎ হয় না….. আর এরাই তো প্রকৃত সত্যনিষ্ঠ” (হুজরাত: ১৫)।

ঈমান-ইসলামের সবকিছু নির্ভর করে আমলের ওপর আবার আমলের মূল হলো ইবাদত ও আখলাক এবং এগুলোর মূল্যায়নস্থল হলো আখিরাত। তাই তো ইসলামের সব আমলের তাৎপর্যগত শিক্ষা একজন আমলকারীকে উন্নৎ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হিসেবে গড়ে তোলে। প্রিয়নবী (স.) বলেন “রোজা হলো (কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে ঢাল স্বরূপ) দান-খয়রাত গুনাহকে ঠাÐা করে দেয়, যেভাবে পানি আগুনকে ঠাÐা করে দেয় (এভাবে) মানুষের মধ্যরাত্রির নামাযও… দ্বীনের (সব কাজের) আসল হচ্ছে ইসলাম (কালেমা), তার স্তম্ভ নামায… ” (তিরমিযি)।

ঈমান-ইসলামের সবকিছুর সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধ, সৌজন্য- সেবা ও শান্তির সুনিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এমন কি বন্ধুত্ব অথবা বৈরিতার মধ্যেও ঈমানি চেতনা প্রকাশিত হয়। প্রিয়নবী (স.) বলেন “যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালবাসবে এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যই কারো সঙ্গে শত্রæতা পোষণ করবে আবার আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য দান করবে অথবা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যই দান করা থেকে বিরত থাকবে, সে-ই তার ঈমানকে পূর্ণতায় পৌছে দিল”(আবুদাউদ, তিরমিযি)।

ঈমানদার ব্যক্তির ব্যবহার-বক্তব্যে থাকবে শান্তি-নিরাপত্তা, ইসলামি মূল্যবোধ ও স্বার্থ। অকল্যাণ অনাচার ঈমান ও আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর এবং মুসলমান স্বভাবগত ভাবেই শান্তি প্রিয়। প্রিয়নবী (স.) বলেন “মুসলমান সে-ই যার মুখ ও হাতের অপকারীতা থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ… ”(নাসাই, তিরমিযি)। অনুরূপভাবে বিশ্বস্ততা ও অঙ্গিকার রক্ষা করা ঈমানদারের চরিত্রের অংশ। শান্তির সমাজে এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক সত্য ‘বিশ্বস্ততা ও অঙ্গিকার রক্ষা করা’কে এখন বোকামী মনে করা হয় অথচ প্রিয়নবী (স.) বলেন “যার মধ্যে আমানতদারীতা নেই তার মধ্যে ঈমানও নেই এবং যার কাছে অঙ্গিকার পালনের গুরুত্ব নেই তার কোনো ধার্মিকতা বা ধর্মও নেই” (বাইহাকি)। অনুরূপভাবে প্রিয়নবীর (স.) আরো দশটি বিশেষ উপদেশ হলো

(১) আল্লাহ্র সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়

(২) তুমি তোমার পিতামাতার অবাধ্য হবে না, যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার পরিজন ও তোমার ধন-সম্পদ ছেড়ে যেতে বলে

(৩) ইচ্ছাকৃত কখনো ফরজ নামায ত্যাগ করবে নাকেননা, যে ইচ্ছাকৃত ফরজ নামায ত্যাগ করবে, তার প্রতি মহান আল্লাহ্র দেওয়া ও প্রযোজ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব চলে যাবে

(৪) কখনো মদ্যপান করবে না কারণ, তা সব অশ্লীলতার মূল

(৫) সাবধান, সব সময় সবরকম পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে, কারণ পাপের কারণে আল্লাহ্র অসন্তোষ তৈরী হয়

(৬) খবরদার, ধর্মযুদ্ধের ময়দান ‘জিহাদ’ থেকে পালিয়ে যাবে না যদিও সব লোক ধ্বংস হয়ে যায়

(৭) কোনো এলাকায় যদি মহামারীর প্রদূর্ভাব হয়, তবু তুমি সেখানেই অবস্থান করবে (পালিয়ে যাবে না)

(৮) তোমার সামর্র্থ্য অনুযায়ী তুমি তোমার পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যয় করবে, কার্পণ্য করবে না

(৯) তাদেরকে (পরিবারের সদস্য) আদব-কায়দা শিক্ষা দানের ব্যাপারে শাসন থেকে বিরত থাকবে না

(১০) আল্লাহ্র সম্পর্কে তাদেরকে (পরিবারের সদস্য) ভয় প্রদর্শন করতে থাকবে” (আহমদ: মু’আজ রা. বর্ণিত)।

মানুষের বিবেক মানুষের জন্য যথার্থ বিচারক। পাপ-পূণ্য সবকিছু নির্ধারণের মাপকাঠি মানুষের বিবেক এবং এর মধ্য দিয়েই ঈমানের প্রকাশ ঘটে। তাই তো ঈমানের বিশুদ্ধতা প্রসঙ্গে প্রিয়নবী (স.) বলেন “যখন তোমার সৎকাজ তোমাকে আনন্দ দেবে এবং তোমার অসৎকাজ তোমাকে পীড়া দেবে তখন তুমি ‘মু’মিন’… যখন কোনো কাজ করতে তোমার অন্তরে বাধে তখন তা ছেড়ে দেবে ” (আহমদ)। অন্যদিকে মানুষের প্রতি ভালবাসা, মানুষের জন্য সৎচিন্তা সবই ঈমানের অংশ। এজন্যই প্রিয়নবী (স.) বলেন “অপরের জন্য তা-ই পছন্দ করবে যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ কর। এভাবেই অপরের জন্য তা-ই অপছন্দ করবে যা তুমি নিজের জন্য অপছন্দ কর” (আহমদ)।

ঈমান ও ইসলামের মূল শিক্ষা মানবিক উন্নতি ও অগ্রযাত্রা এবং ন্যায়বোধ ও নৈতিকতা। অধ্যাপক ডেড্ ওয়েলের ভাষায়“ ÒMorality is the basis of   human civilization ”। তাই আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণি যাকে আবার সে প্রাণি হতে হয়। গরু ‘গরু’ হয়ে জন্মায় এবং গরুই থাকে। কিন্তু অন্যসব প্রাণির মতোই মানুষ প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। পরে আবার তাকে ধর্ম, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ‘মানুষ’ হতে হয়। এখানে রাবিন্দ্রীক ভাবনা প্রসঙ্গতঃ খুবই প্রণিধানযোগ্য “মানুষ প্রথমবার জন্মগ্রহণ করে নিজের জন্য, পরে তাকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয় ‘মানুষে’র জন্য”। ঈমান ও ইসলামের মূল দাবি হলো মনুষ্যত্বের জাগরণের মধ্য দিয়ে ‘আল্লাহ্র প্রতিনিধিত্বে’র যোগ্যতায় পৌছা। মানুষকে এজন্যই বার বার ‘মানুষ’ হতে হয়। তা না হলে শুধু টাকা পয়সাওয়ালা লোককেও আমরা অমানুষ বলি, অন্যদিকে আমাদের কাছে দোয়া প্রার্থী সবার জন্যই আমরা দোয়া করি ‘মানুষ হও’ ! হোক না সে কোনো নবজাতক অথবা কোনো শিক্ষকের প্রিয়ছাত্র। আবার একজন ভাললোকের পরপারে চলে যাওয়ায় বলি ‘বড় ভালো মানুষ’ ছিলেন।

বস্তুতঃ ঈমান-আমলের অন্তর্নিহিত অনুভূতির প্রকাশ ঘটে একজন মুসলমানের সব কথা, কাজ ও বিশ্বাসে। এজন্যই শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ্ দেহলবি (রহ.) বলেন “প্রত্যেক ভাল কাজকে ঈমান বলা হয়, যার ওপর পরকালে মুক্তি নির্ভরশীল”। আর হাদিসের ভাষায় “সে-ই ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পেয়েছে যে, আল্লাহ্কে ‘রব’(প্রতিপালক) ইসলামকে ‘দ্বীন’(ধর্ম) ও মুহাম্মদকে (স.) রাসুল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট” (মুসলিম)। জীবনকে সত্য, সুন্দর, প্রেমময়, নিঃষ্পাপ, নির্দোষ হিসেবে গড়ে তোলা মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। পরম প্রভুর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরই আনুগত্যের শিক্ষায় চারিত্রিক উন্নতি মানুষ ও মনুষ্যত্বের দাবি-দায়িত্ব ও কর্তব্য। এজন্যই একজন মুসলমানের অন্তরে-বাহিরে পরিচ্ছন্ন সুন্দরের সাধনা চিরন্তন। কেননা, প্রিয়নবী(স.)বলেন “সদাচারই পূণ্য, আর যা তোমার মনে উদ্বেগ (খটকা) সৃষ্টি করে এবং যা মানুষ জেনে যাওয়াকে তুমি অপছন্দ কর তাই পাপ”। (মুসলিম)
পরিশেষে কবির ভাষায় নিবেদন
‘একটি আলোর কণা থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বলে
একটি মানুষ ‘মানুষ’ হলে বিশ্বভুবন টলে’।।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া গাজীপুর  


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading