এইমাত্র পাওয়া

শিক্ষায় শিক্ষকের অবদান

মো. সাজ্জাদ হোসেন।।

জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা । ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে । তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন । বাংলায় শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “শাস” ধাতু থেকে । যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা । অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ “এডুকেশন ” এসেছে ল্যাটিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে । যার অর্থ বের করে আনা অর্থাৎ ভিতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা । সাধারণভাবে বলা যায় মানুষের আচরণের কাঙ্খিত  বাঞ্চিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা ।

যুগে যুগে নানা মনীষী নানা ভাবে শিক্ষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ।

বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস এর ভাষায় “শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ ।”

এরিস্টটল বলেন “ সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা ।”

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় “ শিক্ষা হল তা, যা আমাদেরকে কেবল তথ্য পরিবেশনই করেনা,বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে ।”

শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার । একজন শিশু জন্মের পর তাকে সঠিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা এবং মানব সম্পদে পরিনত করা রাষ্টের দায়িত্ব । রাষ্ট এ গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করার জন্য সাংবিধানিক ভাবে জনগণের নিকট দায়বদ্ধ । ধনী, গরীব,ধর্ম,বর্ণ,উচু নিচু সকল ভেদাভেদ বাদ দিয়ে রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান  থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একজন নাগরিকের সাংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বলেছিলেন “শিক্ষিত জনশক্তি দেশের সম্পদ । আমি বাংলাদেশে এমন ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার চাই,যা দ্বারা প্রতিটি নাগরিক দেশের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে ।”

এই মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য রাষ্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়,প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা মন্ত্রনালয়,কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর,মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও সরকারের অন্যান্য দপ্তর সমূহ । এছাড়াও সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।রাষ্টের এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য সরকারের সকল অঙ্গসংগঠনের কর্তব্যক্তিগণ সর্বদা সচেষ্ট থাকে । তাদের আপ্রাণ চেষ্টা ও সর্বাত্মক সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার দাপ্তরিক ও গবেষণামূলক কাজ গুলো সুসম্পন্ন হয় । শিক্ষার আলো  ঘরে ঘরে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বদা তৎপর থাকে প্রাণ চঞ্চল,নিষ্ঠাবান আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশে দুমড়ে মুচড়ে না যাওয়া, সকল দুঃখ কস্ট নিরবে মেনে নেওয়া ,আবেগ অনুভুতিহীন সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারি একদল মানুষ ।

শিক্ষা প্রদানের  এই দায়িত্ব যারা গ্রহণ করে সমাজে তাদের কে শিক্ষক বলে । এক কথায় যে শিক্ষা দান করে তাকেই শিক্ষক বলে । বর্তমানে শিক্ষকদেরকে ইংরেজী শব্দে স্যার বলে সম্মোধন করা হয় । ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা শিক্ষাদানের দায়িত্বে থাকেন তাদেরকে ওস্তাদজী,গুরুজী,হুজুর বিভিন্ন নামে সম্মোধন করা হয় । প্রাচীনকালে ও শিক্ষকদেরকে বিভিন্ন নামে ডাকা হত । শিক্ষক শুধু শিক্ষা দানই করেনা শিক্ষা গ্রহণ ও করে এজন্য কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন “ বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র,নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র ।”

পরিবার একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল হাতিয়ার । একজন ব্যক্তিকে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি । পরিবার কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে মূল দায়িত্ব পালন করে একজন মা । মা ছাড়া কখন ও একজন সন্তান শিক্ষিত,সমাজ সচেতন ও সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না ।

বিশ্ব বিখ্যাত সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন “  তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি দেবো ।”

পরিবারের অন্যান্য সদস্য বাবা,ভাইবোন,দাদা-দাদী ও অন্যান্য আত্বীয় স্বজন একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে । সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে সবাই যার যার অবস্থান থেকে শিক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।

একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হলে সেই জাতি ধ্বংস হয়ে যায়,সেই দেশ ধ্বংস হয়ে যায় । দেশ চলে যায় নস্ট মানুষদের হাতে । নিজস্ব জাতিসত্তার বিলীন হয়ে যায়, রাষ্টীয় শাসন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় । দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব ধ্বংস হয়ে রাষ্টীয় শাসন ক্ষমতা চলে যায় বিদেশি শক্তির হাতে । তখন একটি জাতিসত্তার অকাল মৃতু হয় । বেঁচে থাকতে হয় পরনির্ভরশীল হয়ে । জাতিসত্তা,ধর্মীয় মূল্যবোধ নস্ট হয় । আর্থিক খাত ধ্বংস হয়ে যায় । বেঁচে থাকতে হয় দাস হয়ে ।

শিক্ষা মানুষের মানবিক মূল্যবোধ গুলোকে জাগ্রত করে । শিক্ষা মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে চলতে শেখায়,সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে শেখায় । অশিক্ষিত ব্যক্তি পশুর সমান । নিজের দাসত্ব পরিহার করে পশু নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে যেমন চলতে পারেনা,তেমনি ভাবে অশিক্ষিত ব্যক্তিকে নিজস্ব ব্যক্তিসত্তাটাকে বিলীন করে সমাজের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতে হয় । অশিক্ষিত জাতি মাথা উচু করে বেঁচে থাকতে পারে না । তাদের দুঃখ দুর্দশা নিত্য সঙ্গী,জীবনযাত্রার মান নেমে যায় দারিদ্র সীমার নিচে ।

শিক্ষক শুধু শিক্ষা দান করে না,শিক্ষক জাতি গঠনের মূল কারিগর । শিক্ষক তার সুচিন্তিত জ্ঞানের মাধ্যমে অশিক্ষা,কুশিক্ষা, অন্ধত্ববাদ থেকে বের করে এনে জাতিকে আলোর পথ দেখায় । বিশ্বকে নতুন ভাবে চিনতে শেখায় । সময় উপযোগী জ্ঞান দানের মাধ্যমে একটি জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহস সঞ্চার করে । জ্ঞান বিজ্ঞান ,তথ্য প্রযুক্তি,ধর্মীয় মূল্যবোধ সহ সকল জ্ঞান ভান্ডারের সাথে জাতি পরিচিত হতে পারে একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমে । জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল তত্ত্ব আবিষ্কারের পিছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দান করে একমাত্র শিক্ষক ।

সমাজের অবহেলিত পরিবার থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত,শিক্ষিত জ্ঞানী গুণী কোন পরিবারের একটি সন্তান যদি বখাটেপনায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে তার পরিবার সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য একমাত্র শিক্ষকের কাছে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করে । সমাজের অপসংস্কৃতি ও বিভিন্ন আসক্তি যখন যুব সমাজকে গ্রাস করে তখন শিক্ষক তার মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত করে অসুস্থ যুবসমাজকে রক্ষা করতে পারে । দেশ ও জাতির সংকট কালে শিক্ষক তার সুচিন্তিত মতামত ও সুপরামর্শ দিয়ে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে পারে । ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৬ সালের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক ঘোষণাকৃত ৬ দফা আন্দোলন,উনসত্তরের গণঅভ্যুথান,১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে ও দেশ মাতৃকার বীর সন্তানদেরকে যারা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে পরাস্থ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগীতা করেছিল শিক্ষক সমাজ । যুগে যুগে কালে কালে বিভিন্ন ধর্মমতে পথভ্রষ্ট জাতিকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য মহান সৃষ্টিকর্তা মহামানবদেরকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন ।

পুত্রের শিক্ষকের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেই ঐতিহাসিক চিঠিই প্রমাণ করে একজন প্রেসিডেন্ট তার পুত্রকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য শিক্ষকের উপর কতটা নির্ভরশীল ছিলেন তিনি । কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার শিক্ষা গুরুর মর্যাদা কবিতায় শিক্ষকের মর্যদা যথার্থ ভাবে তুলে ধরেছেন

“আমি ভয় করি না’ক,যায় যাবে শির টুটি,

শিক্ষক আমি শ্রেষ্ট সবার

দিল্লির পতি সে তো কোন ছার,

ভয় করি না’ক,ধরি না’ক ধার,মনে আছে মোর বল,

বাদশা শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল ।”

“ পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ ।

নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে

ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ ।”

“কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে

আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির ।”

কবি গোলাম মোস্তফা শিক্ষকদেরকে নিয়ে লিখেছিলেন তার অমর বাণী

“সকলের মোরা নয়ন ফুটাই,আলো জ্বালি সব প্রাণে

নব নব পথ চলিতে শেখাই-জীবনের সন্ধানে ।

পরের ছেলেরে এমনি করিয়া শেষে

ফিরাইয়া দেই পরকে আবার অকাতরে নিঃশেষে ।”

“ শিক্ষক- মোরা শিক্ষক,

মানুষের মোরা পরমাত্মীয়,ধরণীর মোরা দীক্ষক ।”

মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন “ যে শিক্ষায় মনুষত্বের বিকাশ হয়,যাহার ফলে দেহে স্বাস্থ্য ও চিত্তে প্রসন্নতা,জন্মে,যাহা মানুষকে আত্মার বলে বলীয়ান করে-দেহ ধারণের জন্য অনিবার্য যে দুঃখকে এই নির্মুল করবার চেষ্টা পায়,তাহাকে স্বীকার করিয়াই তদুর্ধে নিজেকে স্থাপন করিবার শক্তি কেবল শিক্ষায় সম্ভব ।”

কবি গোলাম মোস্তফা যথার্থ বলেছিলেন “পিতা গড়ে শুধু শরীর, মোরা গড়ি তার মন,

পিতা বড় কিবা শিক্ষক বড়-বলিবে সে কোন জন ?

লেখক-প্রভাষক,হিসাব বিজ্ঞান

লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ


Discover more from শিক্ষাবার্তা ডট কম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.